Advertisement
E-Paper

অভাবে বাড়ি থেকে বার করে দেয় মা, সেই আজ সোনার মেয়ে

সিনেমার মতোই এর পর দেখানো হল একটি বক্সিং রিং। আর বাড়ি থেকে বিতাড়িত সেই মেয়ের গ্লাভস পরা হাত আকাশে তুলে আম্পায়ার ঘোষণা করছেন, এই হল নতুন চ্যাম্পিয়ন!

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৯
যোদ্ধা: ভানলালহারিতপুই

যোদ্ধা: ভানলালহারিতপুই

মিজোরামের প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র পরিবার। অভাব এতটাই প্রকট যে, তিন সন্তানের প্রত্যেককে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে আত্মীয়দের বাড়িতে। চতুর্থটিকে নেবে কে?

আত্মীয়স্বজন বলে দিল, আর কাউকে নেওয়া যাবে না। তাতেও শেষ হল না মন্দ ভাগ্যের অভিশাপ। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। মা চরম বাণী শুনিয়ে দিলেন মেয়েকে— যেখানে পারিস চলে যা। আর তোর দায়িত্ব কেউ নিতে পারবে না।

ধরা যাক, সিনেমার মতোই এর পর দেখানো হল একটি বক্সিং রিং। আর বাড়ি থেকে বিতাড়িত সেই মেয়ের গ্লাভস পরা হাত আকাশে তুলে আম্পায়ার ঘোষণা করছেন, এই হল নতুন চ্যাম্পিয়ন!

কেউ বিশ্বাস করবে?

ভানলালহারিতপুই কিন্তু কোনও কল্পকথা নয়। মিজোরামের সতেরো বছরের মেয়ে ঠিক এ রকমই প্রেক্ষাপট থেকে বক্সিংয়ের নতুন বিস্ময়-বালিকা হিসেবে উপস্থিত। অত দীর্ঘ নাম কেউ ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না বলে সবাই যাকে ডাকছে ‘পুই’ নামে।

আরও পড়ুন: আইএসএলের উদ্বোধন চলে গেল কোচিতে

এমনিতে বক্সিং মানেই বাগ্‌রুদ্ধ করে দেওয়া সব কাহিনি। বাইসাইকেল হারানো ক্যাসিয়াস ক্লে-র চোরকে ধরে প্রতিশোধ নিতে চাওয়া। আর পুলিশকর্তা জো মার্টিনের তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা— ‘‘জানো, কী করে লড়াই করতে হয়? ফাইট করতে শেখো আগে। তার পরে অন্য কাউকে শিক্ষা দেবে!’’ মার্টিনের সেই পরামর্শ থেকেই শুরু হবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ মহম্মদ আলির যাত্রা। অথবা ইংল্যান্ডের নিকোলা অ্যাডামস। লন্ডন ও রিও অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী মেয়েকে ছোটবেলায় লড়তে হয়েছিল দুরারোগ্য সব ব্যাধির সঙ্গে। তাঁকেও সহ্য করতে হয় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা।

পুই সবে স্কুল গেমস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। জুনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছে। পরবর্তী মেরি কম হতে পারবে কি না, সময় বলবে। কিন্তু কয়েক দিন আগে সার্বিয়ায় জুনিয়র আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপ ‘গোল্ডেন গ্লাভস’ টুর্নামেন্টে সোনা জিতে এসেছে সেমিফাইনাল আর ফাইনালে রাশিয়ার সেরা বক্সারদের হারিয়ে।

জন্মানোর পরে অভাবের সংসারে পুই-এর খাবারটুকুও জুটত না। বাবা ছিলেন ড্রাইভার, মা কাজ করতেন বাড়ি-বাড়ি। চার ভাইবোনের মধ্যে প্রথম তিন জনের কাউকে নিয়ে গিয়েছিলেন কাকা, কেউ স্থান পেয়েছিল মামার বাড়িতে। পুই কনিষ্ঠতম। তাকে আর কেউ নিতে চায়নি। অভাবের তাড়নায় মা বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার পরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে দিন কাটত। সেই সময়েই একদিন পাড়ার এক অগ্রজ এসে বলেন, ‘‘অ্যাই, তুই উশু লড়িস না?

একটা বক্সিং ট্রায়াল আছে সামনে। যা না, গিয়ে ট্রায়াল দে। যদি ভাল করতে পারিস, থাকা-খাওয়ার চিন্তা আর করতে হবে না।’’

কে জানত, সেটাই ঘুরিয়ে দেবে তার জীবনকে! ২০১৪-র সেই ট্রায়ালে দীর্ঘদেহী, লম্বা-লম্বা হাতের পুই-কে দেখে মিজোরাম বক্সিং সংস্থার কর্তাদের এত ভাল লেগে যায় যে, তাঁরা সাই (স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া)-এর হস্টেলে তার নাম পাঠান। ব্যস, সেই যে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল মেয়েটির, এখনও সেটিই তার আস্তানা। এমনই অবস্থা ছিল যে, সব সময়ে ট্রেনিংয়ের টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরেই কাটাতে হয়েছে। আর কোনও জামা জোটেনি পরার জন্য।

ভারতীয় মেয়েদের ‘ইয়ুথ’ অর্থাৎ অনূর্ধ্ব-১৮ বক্সিং দলের প্রধান কোচ ভাস্করচন্দ্র ভট্ট। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মেয়েদের সিনিয়র দলের দায়িত্বেও ছিলেন বলে মেরি কম, সরিতা দেবী, পিঙ্কি জ্যাংগরা-দের দেখছেন তিনি। তাঁর অধীনেই এখন আছে পুই। ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পথে মোবাইলে ভট্ট বললেন, ‘‘বক্সিংয়ে একটা জিনিস আমরা দেখি। জান আছে কি না। মেয়েটিকে প্রথম বার দেখেই মনে হয়েছিল, এর মধ্যে জান আছে।’’ এর পর যোগ করলেন, ‘‘বেশ ক্ষিপ্র। লম্বা আছে। এগুলো ওকে সুবিধে দেবে। তবে এখনও অনেক রাস্তা যাওয়া বাকি।’’

মিজোরাম সাই-তে বেশ কড়াকড়ি। ছাত্রীদের মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। শুধু রবিবার দিন পেতে পারে মোবাইল। স্যারের ফোনেই তাই কথা বলতে হল পুইয়ের সঙ্গে। কোচই বলে দিলেন, ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে পারবে পুই।

স্বপ্ন কী? প্রশ্ন করে কিন্তু পরিষ্কার জবাব পাওয়া গেল। ‘‘অলিম্পিক্সে মেডেল জেতা,’’ বলার সময়ে একটুও কাঁপে না পুইয়ের গলা। শুনেই মনে হবে, জীবনের ঝড় পারেনি তার চোখ থেকে স্বপ্ন কেড়ে নিতে।

মেরি কমের সঙ্গে দেখা হতে হতেও হয়নি পুইয়ের। তবে ১৯-২৬ নভেম্বর গুয়াহাটিতে জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। ৩৯টি দেশের ২৯০ জন প্রতিযোগী ইতিমধ্যেই নাম দিয়ে ফেলেছে। পুই এই প্রতিযোগিতায় নামছে ভারতের সেরা সম্ভাবনা হিসেবে। আর এখানে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে যুব অলিম্পিক্সে সরাসরি নামার সুযোগ পাওয়া যাবে। গুয়াহাটিতে মেরির সঙ্গে দেখা হলে কথা বলার ইচ্ছে রয়েছে তার।

প্রিয় বক্সার কে? উত্তর এল, ‘‘ম্যানি প্যাকিয়াও।’’ সেই প্যাকিয়াও, ছোটবেলায় যাঁর পুইয়ের মতোই রোজ খাবার জুটত না। আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বক্সার হওয়ার পরে বেভারলি হিল্‌সে প্রাসাদোপম বাড়ি কিনলেও মিজোরামের মেয়ের মতোই কত রাত কেটেছে রাস্তায় শুয়ে!

বক্সারের জীবন! রিংয়ের লড়াইটা মাঝেমধ্যে এত ক্ষুদ্র হয়ে দাঁড়ায়!

Vanlalhriatpuii Boxer Boxing Gold Medal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy