Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিজয়দের সেঞ্চুরির দিনে বিরাট ব্যাটেই বিনোদন

কোহালি ক্রিজে আসার আগে ম্যাচটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একবিংশ শতাব্দীর কোনও স্টেডিয়ামে বিংশ শতাব্দীর ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। পুরনো সেই অতি সতর্কতার ক্রিকেট— যেখানে রক্ষণ সামলে তবেই আক্রমণে যাওয়ার পাসওয়ার্ড রয়েছে।

নাগপুরে বিনোদনের নাম সেই কোহালি। ছবি: পিটিআই

নাগপুরে বিনোদনের নাম সেই কোহালি। ছবি: পিটিআই

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:১৭
Share: Save:

নাগপুরের স্টেডিয়াম হঠাৎই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল শনিবারের পড়ন্ত বেলায়। সচিনোত্তর যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন নায়ক নামছেন দেখে!

তখন বাইশ গজের উপরেও ফিল্ডিং দলের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। প্রথাগত ভাবে, সময়টা বোলারদের। কমে আসা আলো, দীর্ঘতর হতে থাকা ফিল্ডারদের ছায়া পড়ে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানো, শেষ বেলায় পেয়ে যাওয়া সুইং বা স্পিন— ব্যাটসম্যানদের জন্য সময়টা বেহুলার বাসরঘরের মতো। কখন যে ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়বে কালনাগিনী!

রঙ্গনা হেরাথের ফুলটস বল সুইপ করতে গিয়ে আউট হলেন মুরলী বিজয়। ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন বিরাট কোহালি। নাগপুরের জামথা স্টেডিয়ামে শনিবার হাজার দশেক মতো দর্শক হয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেটের বাজার অনুপাতে সংখ্যাটা খুব খারাপ নয়। কোহালির শরীরটা দেখা মাত্র গ্যালারি গর্জন করে উঠল। সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফিরছেন, কে বলবে! বিসর্জনের শোক নেই, বরং বেজে উঠেছে আগমনীর সুর!

মুরলী বিজয়কে বলা যেতেই পারে, আপনার মন খারাপ করার কারণ নেই। ভারতীয় ক্রিকেটে আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের শোকে মূহ্যমান না হয়ে জনতার নতুন ব্যাটসম্যানের আগমনে উদ্বেলিত হওয়ার এমন ঘটনা আগে অনেক বার ঘটেছে। যত দিন সচিন তেন্ডুলকর খেলেছেন, রাহুল দ্রাবিড়কে এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। অথচ, কে না জানে দ্রাবিড় কম বড় কোনও কিংবদন্তি নন! কে না জানে, দেওয়াল না উঠলে বাড়ি-ঘরই হয় না!

সচিন অবসর নিয়ে ফেলেছেন, জনতার কাছে নতুন হ্যারি পটার এখন বিরাট কোহালি। নাগপুরের জনতার তাঁকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠার মধ্যে কোনও চমক নেই। অত্যাশ্চর্য হল, কোহালি নামা মাত্র খেলাটা যেভাবে আমূল পাল্টে যেতে শুরু করল। ভারতীয় দলের স্কোরিং রেট লাফিয়ে বাড়তে থাকল, দর্শকরা ঝিমুনি ছেড়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন, চেতেশ্বর পূজারার ছোটাছুটি পর্যন্ত বেড়ে গেল, প্রতিপক্ষের মুখচোখে প্রতিজ্ঞা ছাপিয়ে ক্রমশ হতাশার ফ্যাকাসে ভাব ফুটে উঠল।

কোহালি ক্রিজে আসার আগে ম্যাচটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একবিংশ শতাব্দীর কোনও স্টেডিয়ামে বিংশ শতাব্দীর ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। পুরনো সেই অতি সতর্কতার ক্রিকেট— যেখানে রক্ষণ সামলে তবেই আক্রমণে যাওয়ার পাসওয়ার্ড রয়েছে। প্রাচীন আমলের মতো ঢিমেতালে খুচরো রান নেওয়ার প্রবণতা। কোহালি আসার আগে পর্যন্ত সাদা-কালো টিভি চলছিল। তিনি আসার পরে রঙিন চিত্রহার। খেলাটাকেই ‘সুপারফাস্ট মোড’-এ নিয়ে চলে গেলেন ভারত অধিনায়ক।

এক বার এমন ছুটিয়ে দুই রান নেওয়ালেন যে, হাঁফাতে হাঁফাতে পূজারা পর্যন্ত হেসে ফেললেন! টি-টোয়েন্টি প্রজন্মে টেস্ট ক্রিকেট যেমন হওয়া উচিত। ইউসেইন বোল্টের ভঙ্গিতে স্প্রিন্ট টেনে এক রানকে দুই করো, খারাপ বলের জন্য অপেক্ষা করে না থেকে ভাল বলকেও খারাপ বানিয়ে নাও, দুরন্ত এনার্জি দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে দিশাহারা করে দাও। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ফিল ফডেন-রা যে ভাবে গতি দিয়ে দুমড়ে দিয়েছিল ব্রাজিল আর স্পেনকে, টি-টোয়েন্টি যুগে আধুনিক ক্রিকেটও সে ভাবে খেলা হচ্ছে। গতি আর শক্তি থাকলে তবেই স্কিল কাজে আসবে। আগের মতো স্কিল একক ভাবে আর উৎকর্ষের এভারেস্টে নিয়ে যেতে পারবে না। নেট যেমন দরকার, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ জিমে সময় দেওয়া। টেস্টে ভারতের মাটিতে নতুন ভাবনার এই সুপারফাস্ট ক্রিকেটের বোধন ঘটে গেল সুপারফিট কোহালির হাত ধরে। শনিবারের নাগপুর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ক্রিকেট নয়, ক্রিকেট সংস্কারের ছবিও সেখানে তোলা হয়ে থাকল।

চেতেশ্বর পূজারা ৩৮৫ মিনিট ব্যাট করে ফেলেছেন। টেস্টে চোদ্দোতম সেঞ্চুরি হয়ে গেল। কোহালি এখনও পর্যন্ত ব্যাট করেছেন মাত্র ৯৬ মিনিট। কিন্তু তাতেই এমন গতিসম্পন্ন ক্রিকেট উপহার দিয়েছেন যে, জীবন্ত হয়ে উঠেছিল গ্যালারি। তাঁর দুরন্ত অ্যাথলেটিসিজম আর ফিটনেসের সৌজন্যে ফিল্ডিংয়ে হাফ চান্সকে অনেক সময় ফুল চান্স করে নেন কোহালি। এ দিন ব্যাট হাতেও যেন সেটা করলেন। ক্রিজের বাইরে দাঁড়ালেন। তার পরেও অনেকটা করে পা বাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছিলেন ড্রাইভ শটে। যে বলটা অন্যদের ক্ষেত্রে হয়তো গুডলেংথ, সেটাকে তিনি করে নিচ্ছিলেন হাফভলি। ক্রিজের মধ্যে তাঁর নড়াচড়া যদি কেউ ভাল ভাবে লক্ষ্য করে, মনে হবে রিংয়ের মধ্যে থাকা কোনও শিকারি বক্সার। বিদ্যুতের মতো দ্রুত পায়ের নড়াচড়া।

সঙ্গে অসাধারণ কব্জির ব্যবহার। এ দিন শ্রীলঙ্কার মিডিয়াম পেসার শনাকাকে একটা ব্যাকফুট পাঞ্চ করলেন। বুলেটের মতো বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়ল বল। কব্জিতে অবিশ্বাস্য জোর না থাকলে এমন শট কল্পনাও করা যাবে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে সময় দেওয়া আর আপসহীন ক্রিকেট রুটিন তৈরি করে দিয়েছে এই সব শট খেলার শরীর। যা দেখে কব্জির বাদশা মহম্মদ আজহারউদ্দিন পর্যন্ত মুগ্ধ। ‘‘অফ-মিডল থেকে অনায়াসে বল পাঠিয়ে দিচ্ছে বাউন্ডারিতে। অবিশ্বাস্য সব শট খেলছে। বিরাট কিন্তু ক্রিকেট প্রেমীদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে দিচ্ছে টিভি-র সামনে,’’ বলছেন আজ্জু।

অন্যদের সঙ্গে রান করার গতিতেও কত তফাত! পূজারা করলেন ২৮৪ বলে ১২১। স্ট্রাইক রেট ৫৩.৭৭। মুরলী বিজয় ২২১ বলে করলেন ১২৮। স্ট্রাইক রেট ৫৭.৯১। সেখানে কোহালি হাফ সেঞ্চুরি করলেন ৬৬ বলে। দিনের শেষে ৭০ বলে ৫৪ অপরাজিত। সহবাগীয় ঘরানার স্ট্রাইক রেট নিয়ে ফিরলেন ড্রেসিরুমে— ৭৭.১৪। ইডেনেও বোলারদের সহায়ক পিচ ও পরিবেশে তিনি ১১৯ বলে ১০৪ নট আউট করেন। স্ট্রাইক রেট ৮৭.৩৯। সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছিলেন ছক্কা মেরে। কে কত বড় ব্যাটসম্যান সেই তর্কে এটাই সবার আগে দেখা হয় যে, কে বোলারদের শাসন করে রান করেছেন এবং কে বেশি ম্যাচ জিতিয়েছেন। কোহালি দু’টো ব্যাপারেই অন্যদের অনেক পিছনে ফেলে দিচ্ছেন।

তর্ক হতেই পারে যে, বিজয় এবং পূজারা দ্বিতীয় উইকেটে ২০৯ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ভিত তৈরি করেছেন। তবেই না কোহালি এসে এমন টপ গিয়ারে গাড়ি চালানোর সুযোগ পেলেন! ঘটনা হচ্ছে, অন্যরা ব্যাট করার সময় ক্রিকেটকে সেই রাজাদের খেলা মনে হচ্ছিল। আর কোহালি ব্যাট করার সময় মনে হচ্ছে, ক্রিকেট পরিশ্রমী পেশাদারদের খেলা।

এখানে সে-ই জিতবে, যে বেশি ফিট, শক্তিশালী আর প্রাণবন্ত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE