Advertisement
E-Paper

শিষ্টাচার ছাপিয়ে যাচ্ছে আবেগ আর জয়ের উদগ্র বাসনা! মাঠে রীতি মানছেন না খেলোয়াড়েরা, কেন আগ্রাসী শুভমন-দানিলরা

ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছেন খেলোয়াড়েরা। ‘বডি কন্ট্যাক্ট’ নয়, এমন সব খেলাতেও মেজাজ হারাচ্ছেন অনেকে। পরোয়া করছেন না শিষ্টাচার বা রীতির। তবে তাঁদের আগ্রাসন উপভোগ করছেন তরুণ প্রজন্মের সমর্থকেরা।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:১৮
picture of Shubman Gill and Daniil Medvedev

(বাঁ দিকে) শুভমন গিল এবং দানিল মেদভেদেভ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

সদ্যসমাপ্ত ইউএস ওপেনে প্রথম রাউন্ডেই ছ’মিনিট খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। অবাছাই বেঞ্জামিন বনজ়ির কাছে পাঁচ সেটের লড়াইয়ে হেরে গিয়ে র‌্যাকেট আছড়ে ভেঙে ফেলেছিলেন দানিল মেদভেদেভ। চেয়ার আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হওয়ায় দর্শকদের তাতিয়েও দিয়েছিলেন।

হইচই, সমালোচনা, নিন্দা হয়েছে। কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে দানিল এবং তাঁর আগ্রাসনের ধরনকে। মোটা টাকা জরিমানাও দিতে হয়েছে। টেনিসে এ সব নতুন নয়। কিন্তু যে ভাবে এর মাত্রা চড়ছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে, টেনিস শিষ্টাচারকে কি ছাপিয়ে যাচ্ছে খেলোয়াড়দের বদমেজাজ? এ সব খুব সহজে মেনে নেয় না টেনিস সমাজ। বিশেষত, কৌলীন্য অর্জন করা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে। অতি রক্ষণশীলদের চোখে এ সব ‘অভব্যতা’। কিন্তু দানিলদের থামানো যাচ্ছে না।

২০২৪ সালের আইপিএলে আম্পায়ারের দেওয়া আউটের সিদ্ধান্তে রেগে গিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। ইডেন গার্ডেন্সের সাজঘরে ফেরার সময় মাঠের বাইরে রাখা ডাস্টবিনে লাথি মেরেছিলেন। গত আইপিএলে ‘নোটবুক উচ্ছ্বাস’ দেখিয়ে জরিমানা দিয়েছেন লখনউ সুপার জায়ান্টসের দিগ্বেশ রাঠি। এক ম্যাচ নিলম্বিতও (সাসপেন্ড) হয়েছেন। তবু উচ্ছ্বাসের ধরন বদলাননি। ভারত-ইংল্যান্ড গত টেস্ট সিরিজ়ে ভারতের অধিনায়ক শুভমন গিলকে নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ইংল্যান্ডের ওপেনার জ্যাক ক্রলি অহেতুক সময় নষ্ট করায় বিরক্ত শুভমন মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি। ছাপার অযোগ্য ভাষায় আক্রমণ করে বসেন ক্রলিকে। সঙ্গে হাতের বিশেষ মুদ্রা! লোকেশ রাহুলের মতো শান্ত স্বভাবের ক্রিকেটারও তর্ক করেছেন আম্পায়ারের সঙ্গে।

২০০৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে ইটালির মার্কো মাতেরাজ্জির বুকে মাথা দিয়ে গুঁতো (হেড বাট) করেছিলেন ফ্রান্সের জিনেদিন জ়িদান। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেমারের মতো ফুটবলারের ক্রোধের শিকার হয়েছেন রেফারিরা। তাঁদের ‘পরিকল্পিত’ শক্তিশালী শট ধেয়ে গিয়েছে রেফারিদের দিকে। আহতও করেছে।

তবে ফুটবলে এসব নিয়ে ‘গেল-গেল’ রব ওঠে না। ধরে নেওয়া হয়, ‘বডি কন্ট্যাক্ট’ খেলায় মেজাজ সব সময় সংযত রাখা কঠিন। টেনিস বা ক্রিকেট তা নয়। বস্তুত, টেনিস চিহ্নিত হয়ে এসেছে সমাজের ‘এলিট’ অংশের খেলা হিসাবে। ক্রিকেটকে তো বলাই হয় ‘ভদ্রলোকের খেলা’। একটা সময় পর্যন্ত সাদা পোশাক (জার্সি) পরতেন ক্রিকেটার এবং টেনিস খেলোয়াড়েরা। টেনিসের উইম্বলডন এবং ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচে সেই রীতি এখনও অটুট। তবু নোভাক জোকোভিচ, মেদভেদেভ, কোহলি, শুভমনেরা বিতর্কে জড়ান। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, আধুনিকতা মানুষের ধৈর্য এবং সহনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। অস্থির আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাও অনেকাংশে দায়ী। মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী নিরাপত্তার অভাব বোধ, প্রত্যাখ্যান, অসম্মান, বঞ্চনা মানুষকে উত্তেজিত করে। কোনও বিষয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হলেও মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অথবা স্বার্থ বিঘ্নিত হলে। খেলোয়াড়েরাও মানুষই বটে।

তার সঙ্গে রয়েছে খেলোয়াড় হিসাবে কেরিয়ার। পেশাদার খেলায় যত বেশি সাফল্য, তত বেশি আয়। ম্যাচ ফি থেকে আয়। পুরস্কারমূল্য থেকে আয়। বিজ্ঞাপন থেকে আয়। ফলে কঠোর অনুশীলনের সঙ্গে যোগ হয় সফল হওয়ার চাপ। প্রত্যাশার চাপ। সেই চাপের কাছে ভেঙে পড়লে ভিতরের আগ্রাসন বেরিয়ে আসে ক্রোধ হয়ে। সে ক্রোধ শাস্তি বা জরিমানারও পরোয়া করে না। দানিল যেমন নির্বিকার। শুধু বলেছেন, ‘‘আমায় প্রচুর অর্থ জরিমানা করা হয়েছে।’’ আইপিএলে জরিমানা নিয়ে মাথাও ঘামান না ক্রিকেটারেরা। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই অর্থ দেয় তাঁদের ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি।

ভারতের প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের পছন্দ হয়নি দানিলের আচরণ। তাঁর কথায়, ‘‘দর্শকদের তাতানোর জন্য মেদভেদেভের শাস্তি হওয়া উচিত। ও ওটা ঠিক করেনি। ঘটনাটা যখন ঘটেছে, সে সময় বনজ়ি জয়ের কাছাকাছি ছিল। চেয়ার আম্পায়ার হয়তো গেমটা ঠিক ভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেদভেদেভ দর্শকদের তাতিয়ে সময় নষ্ট করেছে। বনজ়ির মনঃসংযোগ নষ্ট হয়েছে। খেলায় প্রভাব পড়েছে। এটা ঠিক নয়।’’

আমেরিকার তরুণ খেলোয়াড় বেন শেলটন মনে করেন না মেদভেদেভ বাড়াবাড়ি করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং টেনিসের ঐতিহ্য বজায় রেখে খেলতেই পছন্দ করি। আসলে মানুষ অনেক সময় ছোটখাটো বা ভুল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কোনও একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকে। এ সবই অযথা বিষয়টাকে আরও বড় করে দেয়।’’ গত বারের ফাইনালিস্ট টেলর ফ্রিৎজ বলেছেন, ‘‘আমি সবসময়েই নিয়মের পক্ষে। তবে তুলনায় সহজ নিয়মের পক্ষে। নিয়ম এমন হওয়া উচিত, যাতে খেলোয়াড়েরা তাদের আবেগ আর অনুভূতি স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পারে। তা হলে টেনিস আরও উত্তেজক হবে।’’

তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা যেমন শাস্তি নিয়ে ভাবছেন না বা আগ্রাসী আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন না, তেমনই নবীন প্রজন্মের দর্শকেরাও গ্যালারিতে রীতিনীতির ধার ধারছেন না।

এই ‘বেপরোয়া’ মানসিকতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের বলছেন, ‘‘বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি আগ্রাসী। এই সামাজিক পরিবর্তনটা সর্বত্র হয়েছে। খেলোয়াড়েরা আলাদা নন। এখন খেলা শুধু মাঠের পারফরম্যান্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এনডোর্সমেন্ট, সমাজমাধ্যম সব মিলিয়ে একটা প্যাকেজ। খেলোয়াড়েরা মাঠে পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করেন। প্রতিপক্ষ, আম্পায়ার বা রেফারিকে চাপে রাখার চেষ্টাও থাকে। তাতে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সুবিধাও হয়। খেলোয়াড়দের আগ্রাসনটা ওই প্যাকেজেরই অংশ।’’ প্রাক্তন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘এখনকার খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত আগ্রাসী মানসিকতার মূলে সামাজিক অবক্ষয়। মূল্যবোধের অভাব। কারও ধৈর্য নেই। সকলে তাৎক্ষণিক ফল চায়। জিততে চায়। তাই পছন্দমতো কিছু না হলেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে।’’

বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন খেলার নিয়ম বদলাচ্ছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য। তরুণ প্রজন্মের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে খেলার মাঠের পরিবেশ এবং খেলোয়াড় বা দর্শকদের আচরণ। অনেকের মতে, নিউ ইয়র্কের দর্শক ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন লিগ (এনবিএ), ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল) বা বেসবলের গ্যালারিতে বসতে অভ্যস্ত। চরিত্রগত দিক থেকে এই খেলাগুলি টেনিস কোর্টের সংস্কৃতির ঠিক উল্টো। হুল্লোড়ে সংস্কৃতির নিউ ইয়র্কবাসীরা টেনিসের আবহের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়েন। জয়দীপের কথায়, ‘‘আমেরিকার দর্শকেরা বরাবরই বেশি আগ্রাসী। গত কয়েক বছর সেটা আরও বেড়েছে। ফরাসিও ওপেনের দর্শকেরাও আগ্রাসী। সেটা তাদের পছন্দের খেলোয়াড়দের সমর্থন করার সময়। ইউএস ওপেনের গ্যালারি দেখে আমার আমেরিকান ফুটবলের মতো লেগেছে।’’

আমেরিকায় যা এনবিএ-এনএফএল, ভারতে সেটাই আইপিএল। ভারতের তরুণ ক্রিকেট দর্শক প্রতি মুহূর্তে বিনোদনের মশলা চায়। তাদের আলাদা নজর থাকে ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠা ক্রিকেটারের দিকে। যাঁরা অক্রিকেটীয় বিনোদনও সরবরাহ করেন। যা চার-ছক্কার চেয়েও বেশি আলোচিত হয়।

জয়ের উদগ্র বাসনা, সফল হওয়ার অনন্ত চাপ ছাপিয়ে যাচ্ছে কৌলীন্য আর প্রাচীন শিষ্টাচারকে। গ্যালারি আর মাঠ হাত ধরাধরি করে চলেছে পাল্টে যাওয়া ভবিষ্যতের দিকে।

US Open 2025 Shubman Gill Daniil Medvedev
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy