Advertisement
E-Paper

অবিরাম বৃষ্টিতে মারাকানা ফাইনালের জল-হাওয়া সেই জার্মান টিম বনাম ব্যক্তি

রিও শহরের চারশো সত্তর মাইল উত্তরে একটা মাঠে শুক্রবার সকালে তাঁর গোপন অনুশীলন চলছিল। বেলো হরাইজন্তের প্রধান বিমানবন্দর থেকে দশ মিনিট দূরত্বের এই মাঠটায় আজ বাইরের লোক তো দূরে থাক, স্বদেশীয় মিডিয়ারও ঢোকার অধিকার নেই। টিম বাদ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রায় কাকচক্ষুর আড়ালে এই ভেসপাসিয়ানোতেই মারাকানা ফাইনালের মহড়া সেরে নিলেন লিওনেল মেসি!

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০৪:২২
টিম অ্যানালিস্টকে নিয়ে জোয়াকিম লো। সমুদ্র সৈকতেও ফাইনালের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা। ছবি: এএফপি।

টিম অ্যানালিস্টকে নিয়ে জোয়াকিম লো। সমুদ্র সৈকতেও ফাইনালের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা। ছবি: এএফপি।

রিও শহরের চারশো সত্তর মাইল উত্তরে একটা মাঠে শুক্রবার সকালে তাঁর গোপন অনুশীলন চলছিল। বেলো হরাইজন্তের প্রধান বিমানবন্দর থেকে দশ মিনিট দূরত্বের এই মাঠটায় আজ বাইরের লোক তো দূরে থাক, স্বদেশীয় মিডিয়ারও ঢোকার অধিকার নেই। টিম বাদ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রায় কাকচক্ষুর আড়ালে এই ভেসপাসিয়ানোতেই মারাকানা ফাইনালের মহড়া সেরে নিলেন লিওনেল মেসি!

রিও পৌঁছে শনিবার মারাকানায় ট্রেনিংয়ের সুযোগ থাকবে। টেকনিক্যালি ফাইনালের আগে ওটাই শেষ প্র্যাকটিস। কিন্তু সেখানে কোনও প্রাইভেসি আছে নাকি! পুরো মিডিয়াকে যদি বারও করে দেওয়া যায়, কর্মকর্তা গোছের কিছু লোকজন থেকেই যাবে। তারা ফিফার হোক কী স্থানীয়। এই বাজারে তাদের এতটুকু বিশ্বাস করার কারণ নেই। তাই শুক্রবার নিজেদের বেসক্যাম্পেই শেষ সুযোগ, জার্মান চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা করার!

আর্জেন্তিনা ফুটবল সংস্থার কর্তারা রিওতে। তাঁরা আজ বেসক্যাম্প যাননি। কিন্তু খবর তো বেসক্যাম্প থেকে প্রতিনিয়তই আসছে যে, জার্মানদের মাস্টারপ্ল্যানটা কী হতে যাচ্ছে! কেপটাউনে আগের সাক্ষাতে মেসিকে ঠুঁটো করে দেন সোয়াইনস্টাইগার আর খেদিরা। এ বার নাকি একটা ত্রিভুজ তাঁর জন্য তৈরি থাকছে— হুমেলস, সোয়াইনস্টাইগার আর সামি খেদিরা।

সকাল থেকে আর্জেন্তিনীয়দের মুখে বদলাতে থাকা ব্রেকিং নিউজের মতো এক-এক বার মেসির জন্য এক-এক জন জার্মান রক্ষীর নাম শুনলাম। জার্মানদের মেসি-মডেল জানার জন্য যে পরিমাণ আর্জেন্তিনার ছোঁকছোঁকানি, তাতে সিআইএ-কে প্রয়োজনে কাজে লাগানো গেলে তারা বোধহয় সেই সুযোগটা নিয়ে নিত!

ব্রাজিলের ১-৭ নিধন সম্পূর্ণ হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যে জনৈক ফুটবলার টুইট করেছিলেন। ব্রাজিলের আছে নেইমার। পর্তুগালের আছে রোনাল্ডো। আর্জেন্তিনার আছে মেসি। জার্মানির আছে একটা টিম! এটা ব্রাজিলে ফুটবল দেখতে আসা দীপেন্দু বিশ্বাস জাতীয় কেউ করলে বলার ছিল না। সাধারণ ভাবে মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এটা করেছিলেন স্টিভন জেরার।

কোনও ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন কখনও এত মুক্ত ভাবে তার চিরশত্রু জার্মানদের এমন প্রশংসা করেনি। অথচ সর্বাঙ্গীন ব্যালান্স শিটের মাপকাঠিতে জোয়াকিম লো-র এই টিমটা নব্বইয়ে তার কাপ জেতা টিম বা চুয়াত্তরের বেকেনবাউয়ারের ছেলেদের হারাতে পারত বলে মনে হয় না।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

যদিও একটা পরম্পরা সব প্রজন্মেই জার্মানি অটুট রেখে দিয়েছে। এরা যেমন রেখেছে। দ্রুতগামী এবং অসম্ভব বলশালী ডিফেন্স। লোকে জার্মানির আক্রমণ করাটাই দেখে। কিন্তু আরও অনেক রোম্যান্টিক জার্মান টিম যখন আক্রান্ত হয়। একটা জাতির মেজাজটা তখনই চামড়ার গোলকের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে!

বোয়াতেং আর হুমেলস দু’জনেই বড় চেহারার। কিন্তু পেছনে দৌড়নোর সময়ও অসম্ভব ক্ষিপ্ত। তাঁরা দুঃস্বপ্নেও মার্সেলো বা দাঁতে নন যে হা-রে-রে-রে করে সামনে গেলাম তো মাল্টিপ্লেক্সের টিকিট নিয়ে চলে গেলাম। ওভারল্যাপে যাওয়া জার্মান ডিফেন্স যদি আক্রান্তও হয়, প্রত্যেকটা ডিফেন্ডার ফেরে থিয়েটার স্টাইল সেটিংয়ে। কখনও কেউ কারও সমান্তরাল নয় যে, এক জনকে পেরোলাম তো বাকিরাও কেটে গেল। এদের সঙ্গে আবার সোয়াইনস্টাইগার। পিকাসো আর ভ্যান গঘকে দেখে যদি বিপক্ষের স্বাদ না মেটে, তিনি সোয়াইনস্টাইগার আবির্ভূত হয়ে পড়েন জার্মানদের মাইকেল্যাঞ্জেলো হয়ে! এর সঙ্গে সুইপারে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানুয়েল নয়্যার। কার সাধ্য এই টিমকে ফুটোফাটা করে দেয়!

বার্সা বা রিয়াল হলে তা-ও কথা ছিল। সব পজিশনে তারকা প্লেয়ার তাদের। টানা খেলে খেলে দারুণ কম্বিনেশন তৈরি। জাতীয় দলে তো সে সবের বালাই নেই। সুব্রত ভট্টাচার্য কলকাতায় টিভিতে খেলা দেখেও আনন্দবাজারে খুব নিখুঁত লিখছেন, কেন মেসির অসহায়তা ক্রমে বাড়ছে। বার্সার মেসি অনেক বেশি ওয়ান-টু খেলতে পারতেন। কিন্তু ব্রাজিলের মাঠে বল দিয়ে অর্ধেক সময় ফেরতই পাচ্ছেন না। অসহায়ের মতো দূরে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের ইঙ্গিত করছেন, নিলি যে বলটা, আবার ঠিক জায়গায় আমাকে দে!

মোরিনহো এ দিন কী লিখেছেন, গোটা ফুটবলবিশ্বের পড়া হয়ে গিয়েছে। মেসি দারুণ, কিন্তু কিছুতেই গ্রেটেস্ট নয়। এই মারাকানাতেই বসনিয়া ম্যাচের অসাধারণ গোল দিয়ে ঠিক সাতাশ দিন আগে লিও মেসির বিশ্বকাপ অভিযান ব্রাজিলে নতুন টেক অফ করেছিল। আর গ্রুপ লিগ হতে না হতেই ফ্লাইটটা দুর্যোগে পড়ে সেই উচ্চতা আর পাচ্ছে না! বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডস পরপর দুই ম্যানেজারের কৌশল তাঁকে আটকেছে। আর্জেন্তিনা টিমটাও যে আগের মতো মেসি-সিদ্ধ নয়, মাসচেরানো-জাবালেতারা ক্রমশ দেখাচ্ছেন।

তা হলে জার্মানির মতো একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ টিমের মধ্যে তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা কেন? আর্জেন্তিনাই বা বারবার দক্ষ গুপ্তচরের খোঁজ করছে কেন, যারা জার্মান ক্যাম্পের মেসি সংক্রান্ত হাঁড়ির খবর তাদের এনে দিতে পারে!

সিনিয়র জার্মান সাংবাদিক বলছিলেন, “ইউ টিউবে যান। উত্তরটা নিজেই পাবেন। ফ্রাঙ্কফুর্টে দু’বছর আগের ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মেসি কী করেছিল দেখে নিন।” গিয়ে দেখা গেল ম্যাচটা ৩-১ আর্জেন্তিনা জিতেছিল। মেসি গোল করেছিলেন আর করিয়েছিলেন। জার্মান গোলে নয়্যার ছিলেন না। কিন্তু বাকিরা মোটামুটি এক। মুলার, লাম, বোয়াতেং। দু’দেশের ওটাই শেষ সাক্ষাৎ। মেসি যদিও সেই ফ্রাঙ্কফুর্টের ফর্মে নেই, জার্মানরা ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে চায় না।

হামবুর্গ থেকে আসা সাংবাদিক বলছিলেন, টিম আমাদের দুটো কথা বলেছে। ফাইনালে ওদের অগ্রাধিকার সম্পর্কে। এক, বলের দখল রেখে দিতে পারা। নেদারল্যান্ডসের মতো বলের দখল হারিয়ে ফেললে হবে না। দুই, মেসিকে কন্ট্রোল করতে হবে। ও যেন দু’পাশে হাওয়া চলছে সেটাও বুঝতে না পারে। ঐতিহাসিক ভাবে জার্মান টিম নাকি একটা আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে এসেছে। মরণাপন্নের নিঃশ্বাস পড়ে। তাই সে জীবিত। অর্থাৎ শত্রু মরার আগে মরেনি!

সব মিলেমিশে সেই নব্বইয়েই যেন টাইমমেশিনে পরিস্থিতিটা ফিরে গেল।

চব্বিশ বছর পরেও পরম্পরাটা অক্ষুণ্ণ থেকে গেল— ব্যক্তি বনাম দল! মারাদোনার জায়গায় শুধু মেসি।

রিও-র ফাইনাল পরম্পরায় কাল রাত্তির থেকে ক্রমাগত হতে থাকা বৃষ্টিটা একটু আঘাত বসাচ্ছে। চৌষট্টি বছর আগে তো বৃষ্টির জল লাগেনি। গোটা ব্রাজিলের চোখের জল পড়েছিল বলে!

পরম্পরা অবশ্যই এমনিতে তো ভাঙছে। বৃষ্টি অর নো বৃষ্টি। লাতিন আমেরিকার বিশ্বকাপে এই প্রথম ইউরোপের দল অবিসংবাদী ফেভারিট— সেই পরম্পরা নয়। লাতিন দেশে এই প্রথম ইউরোপের দল পাগলের মতো স্থানীয় জনসমর্থন পাবে বলে।

এমনিতে ব্রাজিল টুর্নামেন্ট থেকে সরে গিয়ে উদ্দীপনার মাত্রাটাই ধপ করে নেমে গিয়েছে। আর্জেন্তিনীয়রা জঙ্গি মেজাজে রিও-র অধিকার নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু ফুটবল-আবহাওয়ায় ঝলমলে রোদ্দুর তাতেও উঠছে না। ব্রাজিলের সেন্টিমেন্টই হল, জন্মদিনের পার্টির জন্য আগাম ভাড়ার টাকা নিয়েছিলাম বলে নেহাত করতে দিচ্ছি। নইলে এমন শোকের সময় কিছুতেই দিতাম না। স্থানীয় মিডিয়া অবশ্য কাপ ফাইনালের উপযুক্ত কভারেজ দিয়ে যাচ্ছে। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে গাইতে মাঝরাত্তিরে এসে পৌঁছেছেন শাকিরা। ক্যামেরা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত তাঁকে এমন ফলো করল যেন মারাকানায় খেলার জন্য ফিলিপ লাম নামলেন! অমিতাভ বচ্চনও তাঁর প্রথম ব্রাজিল সফরে সপুত্র এসে পড়েছেন। প্রাক্তন মহাতারকাদের মধ্যে বেকেনবাউয়ার আসছেন না। কিন্তু জিনেদিন জিদান আর জোহান ক্রুয়েফকে বিশেষ আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে। পেলে-রোনাল্ডোরা তো থাকছেনই!

কোপাকাবানা বিচ সংক্রান্ত এলাকা যারা অধিগ্রহণে এক রকম বুয়েনস আইরেস বানিয়ে দিয়েছে, সেই আর্জেন্তিনীয়রা আবার ব্রাজিলের টিভিতে উত্তেজিত বাইট দিচ্ছে, ব্রাজিল তোমার লজ্জা করে না! যারা তোমাদের সাত গোলের মালা পরিয়েছে, তাদের রোববার সাপোর্ট করছ?

ব্রাজিলীয়রা যদিও অবিচলিত। নেইমার দ্য সিলভা কাল থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং আম-ব্রাজিলীয়র মনে তীব্র ক্ষোভ জারণ করেছেন এই বলে যে তিনি মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চান। কাল রিও বিমানবন্দরের টিভিতে নেইমারের সাংবাদিক সম্মেলন লাইভ দেখাচ্ছিল। যেখানে তিনি কাঁদলেনও।

কিন্তু ওই যে বলা, মেসি ফুটবলকে এত দিয়েছে। ওর হাতে কাপ দেখতে চাই, এটায় ব্রাজিলীয়রা চটে অস্থির। বিমানবন্দরে ট্যাক্সির লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ ব্রাজিলীয় ইঞ্জিনিয়ার বলছিলেন, শিরদাঁড়া ভাঙলে কি মাথারও গণ্ডগোল হয়? জানতাম না তো!

সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত অংশেরই এমন মনের ভাব! তো যে ট্যাক্সি ড্রাইভার সকালে মারাকানায় নামিয়ে দিয়ে গেল, তাকে দোষ দিই কী করে? মেসি পাতালে বলতে বলতে সে মোবাইল গুগল ট্রান্সলেটর বার করল। ভাষা সমস্যায় আক্রান্ত হোটেলকর্মীদের গুগল ট্রান্সলেটর বার করা ছাড়া অনেক সময়ই উপায় থাকে না। কিন্তু গত চল্লিশ দিনে এখানে কোনও ট্যাক্সিচালককে গুগল ট্রান্সলেটর বার করতে শুনিনি।

বোঝা গেল, এ উত্তেজিত ভাবে কিছু বলতে চায়। তার টাচস্ক্রিনে যা ফুটে উঠেছে একটা লাইন। বাংলা করলে দাঁড়ায়— ভূমিকম্প একটা হয়ে গিয়েছে, রোববার আর যেন না হয়!

মেসির চক্রব্যূহের রংয়ে রোববার হলুদও থাকছে।

fifaworldcup gautam bhattacharya final germany
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy