Advertisement
E-Paper

আই লিগেই শুরু ফ্র্যাঞ্চাইজি যুগ

আইএসএলের আগেই ভারতীয় ফুটবলে ফ্র্যাঞ্চাইজি যুগ শুরু হয়ে গেল! আই লিগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল টুর্নামেন্টের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম বেঙ্গালুরু এফসি। ফেডারেশন যে দলকে এ মরসুমেই ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম হিসাবে গ্রিন কার্ড দিয়ে আই লিগে সরাসরি অম্তর্ভুক্ত করেছিল। ডেম্পো পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল তিন বার।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৬
বেঙ্গালুরু কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ফুটবলারদের। সোমবার। ছবি: এআইএফএফ

বেঙ্গালুরু কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ফুটবলারদের। সোমবার। ছবি: এআইএফএফ

বেঙ্গালুরু এফসি ৪ (রুনি, রবিন, মেয়ঙ্গার, সুনীল)

ডেম্পো ২ (বেটো, রোমিও)

আইএসএলের আগেই ভারতীয় ফুটবলে ফ্র্যাঞ্চাইজি যুগ শুরু হয়ে গেল!

আই লিগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল টুর্নামেন্টের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম বেঙ্গালুরু এফসি। ফেডারেশন যে দলকে এ মরসুমেই ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম হিসাবে গ্রিন কার্ড দিয়ে আই লিগে সরাসরি অম্তর্ভুক্ত করেছিল। ডেম্পো পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল তিন বার। মোহনবাগান তিন বার। কিন্তু এরা সবাই ‘পাবলিক’ বা ‘কোম্পানি’ ক্লাব এবং দীর্ঘ দিন ধরে খেলছে ভারতীয় ফুটবলে। কিন্তু প্রথম বছর নেমেই চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি। যা পেল অ্যাশলে ওয়েস্টউডের বেঙ্গালুরু। এখন অবধি দেশের সবচেয়ে দামি ফুটবল টুর্নামেন্ট আই লিগে আজ পর্যন্ত এ রকম নাটকীয় উত্থান কোনও টিমের হয়নি। যদিও আই লিগ যখন জাতীয় লিগ ছিল তখন প্রথম বার খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান।

সুনীল ছেত্রীদের লড়াই অবশ্য মসৃণ ছিল না। কখনও সালগাওকর, কখনও ইস্টবেঙ্গল আবার কখনও স্পোর্টিং ক্লুব ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে গিয়েছে। সোমবার মারগাওয়ের ফতোরদা স্টেডিয়ামে জনসন-রুনিরা যখন খেলতে নামেন দরকার ছিল মাত্র তিন পয়েন্টের। তীব্র চাপের ম্যাচে ডেম্পোকে হারাতে কালঘাম ছুটেছে বেঙ্গালুরুর। ৩-০ ম্যাচ এক সময়ে ৩-২ হয়ে গিয়েছিল। মাত্র ছ’মিনিটের মধ্যে জোড়া গোল করে ম্যাচ জমিয়ে দিয়েছিলেন বেটো, রোমিও ফার্নান্ডেজরা। এর আগে অ্যাওয়ে ম্যাচে এ রকম চাপের মুখে অনেক সময় ভেঙে পড়েছিল দেশের সবচেয়ে পেশাদার পরিকাঠামোর দলটি। কিন্তু এ দিন তাঁদের ব্রিটিশ কোচ শাস্তি পেয়ে গ্যালারিতে থাকা সত্ত্বেও চাপের মুখে থেকে ম্যাচ বের করে আনেন সুনীল ছেত্রীরা। অধিনায়ক সুনীলই শেষ গোল করে ৪-২ করেন। গত বার চার্চিল ব্রাদার্সকেও চ্যাম্পিয়ন করার পিছনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক। এত দিন যাঁর সম্পর্কে ফুটবলমহলে চালু কথা ছিল, সুনীল দেশের হয়ে সুন্দর কিন্তু ক্লাবের হয়ে নয়। সেই ধারণা ভেঙে দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের স্পোটির্ং ক্লুব দ্য পর্তুগালে খেলে আসা সুনীল দেখালেন তিনি সঠিক পরিকাঠামো এবং পরিবেশ পেলে কোটি কোটি টাকার বিদেশিদের টপকে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতেও পারেন। এত দিন যে জায়গাটা যেন ছিল ইয়াকুবু, ওডাফা, র্যান্টিদের জন্যই সংরক্ষিত, সেই সর্বোচ্চ গোলদাতার আসন দখল করতে চলেছেন এক ভারতীয় ফুটবলার। যদিও লাজংয়ের বিশ্বকাপার কর্নেল গ্লেনের সঙ্গে আপাতত যুগ্ম ভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে রয়েছেন সুনীল। দু’জনেরই ১৪ গোল। দু’জনেরই একটি করে ম্যাচ বাকি। সুনীলের লড়াই স্পোর্টিং ক্লুব দ্য গোয়ার বিরুদ্ধে। গ্লেনের লড়াই মোহনবাগানের বিপক্ষে।

মারগাওতে এ দিন বেঙ্গালুরু হেরে গেলে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেতাবের লড়াইটা তুঙ্গে উঠত। মেয়ের বাগদান উপলক্ষে গোয়ায় রয়েছেন লাল-হলুদ কোচ আর্মান্দো কোলাসো। তিনি মাঠে না গেলেও নজর রেখেছিলেন ম্যাচের দিকে। কলকাতায় টিভি-তে চোখ রেখেছিলেন চিডি-সুয়োকা-অর্ণবরা। ময়দানে ক্লাব তাঁবুতে ম্যাচ দেখছিলেন ইস্টবেঙ্গলের কিছু কর্তা এবং সমর্থক। ম্যাচের শেষ দিকে হঠাৎই ডেম্পো ফিরে আসায় তাঁদের সবাই ভেবেছিলেন হয়তো কোলাসোর সেই বিখ্যাত কপাল এ বারও কাজ করবে। কিন্তু সুনীলের গোলে অন্ধকার নেমে আসে লাল-হলুদে। চিডি বলে দেন, “ব্যাড লাক ছাড়া আর কী বলব। এখন দ্বিতীয় হওয়ার জন্য খেলতে হবে।” সুয়োকার মন্তব্য, “বেঙ্গালুরুর চ্যাম্পিয়ন হওয়া কোনও অঘটন নয়।” যদিও তাৎপর্যের হল, এক ম্যাচ বাকি থাকতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া বেঙ্গালুরু এফসি কিন্তু আই লিগে দু’বারের এক বারও ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারেনি। সে জন্যই লাল-হলুদ শিবিরে হতাশাটা ছিল বেশি।

ডেম্পো, সালগাওকরের মতো বড় কোম্পানির দল, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো কোটি কোটি সমর্থক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী ক্লাব, পুণে এফসি-র মতো এএফসি-র লাইসেন্স প্রাপ্ত দেশের একমাত্র ক্লাব খেলছে আই লিগে। তা সত্ত্বেও জন্মের প্রথম বছরেই জিন্দাল গ্রুপের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্লাব কী ভাবে আই লিগে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা পেল?

চৌম্বকে উঠে আসছে নানা কারণ।

অন্যতম হল, দল তৈরির আগেই ভাল বিদেশি কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডকে নির্বাচন। দেশের অনেক পোড়খাওয়া কোচ লাইন দিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর দায়িত্ব পাওয়ার জন্য। কিন্তু জেএসডব্লিউ-র কর্পোরেট কর্তারা বেছে নেন ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের সহকারী ম্যানেজারকে। টিম গড়ার দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দেন তাঁর উপরই।

তিনি চার বিদেশি শন রুনি, জনি মেয়ঙ্গার, জন জনসন, কার্টিস ওসানোকে নিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে আই লিগে পুরোনো একমাত্র রুনিই। যাঁকে সালগাওকর ছাঁটাই করেছিল।

ভারতের তারকা ফুটবলারদের পিছনে বেঙ্গালুরু ছোটেনি। ব্যতিক্রম শুধু জাতীয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী আর কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে রবিন সিংহ। এবং মরসুম শেষে দেখা যাচ্ছে রুনির পাশাপাশি সুনীল, রবিনরাই দলের সিংহভাগ গোল করেছেন বেঙ্গালুরুকে চ্যাম্পিয়ন করতে।

টিম হারলেও অন্য বড় ক্লাবের কর্তাদের মতো কোচ বা ফুটবলারদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ায়নি বেঙ্গালুরুর টিম ম্যানেজমেন্ট। কোচ তাড়ানোর কথা বলেননি। ফুটবলারদের সমালোচনা করেননি। কোচও একতাবধ্য রাখতে পুরো টিমকে একই কমপ্লেক্সে রেখেছেন। সুনীল, রবিন, জনসনরা একই রাঁধুনির হাতের রান্না খেয়েছেন, একসঙ্গে প্র্যাকটিস করেছেন। কার্যত সারা দিন একসঙ্গে কাটায় পুরো টিম।

দলের অন্দরমহল নিয়ে অহেতুক মাথা না গলিয়ে টিম-বিপণন এবং বেঙ্গালুরুর মতো কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত শহরে সমর্থক তৈরি করেছেন কর্তারা। সমাজের উচ্চবিত্ত লোকজন, যাঁরা সাধারণত ক্রিকেট মাঠে যেতে অভ্যস্ত তাঁদের টেনে এনেছেন মাঠে। বেঙ্গালুরুর প্রতি ম্যাচেই মাঠ ছিল কার্যত ভর্তি।

অ্যাওয়ে ম্যাচে যাতে সমর্থকেরা খেলা দেখতে যেতে পারেন সে জন্য প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করেছেন বেঙ্গালুরুর ক্লাবকর্তারা। যা ভারতীয় ফুটবল কখনও দেখেনি। এ দিন মারগাওতে টিমের জার্সি পরে, পতাকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পাঁচশো সমর্থক। টিমের খেতাব জয়ের সেলিব্রেশনে যোগ দিতে।

এ সব পেশাদারিত্বের জন্যই বেঙ্গালুরুর মতো ফ্রাঞ্চাইজি টিম তাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে মানতে অবশ্য নারাজ ইস্ট-মোহন কর্তারা। এ বারও অল্পের জন্য লিগ হারিয়ে বিমর্ষ লাল-হলুদের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার বললেন, “অন্য কিছু নয়, বেঙ্গালুরুর লাক ফ্যাক্টর ওদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণ। সব ক্লাবের মধ্যে আমাদের সাফল্যই সবচেয়ে বেশি। তিন বার চ্যাম্পিয়ন, সাত বার রানার্স, তিন বার তিন নম্বর। আমাদের ম্যানেজমেন্টও ভাল না হলে এই সাফল্য আসত কী?” মোহনবাগান কর্তা দেবাশিস দত্ত বললেন, “ফ্র্যাঞ্চাইজি কোনও ব্যাপার নয়। ওটা তো আসলে একটা ক্লাবই। আমরাও জাতীয় লিগে প্রথম বছর নেমেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আসলে চাপ নেই বলেই ওরা বেরিয়ে গেল।”

ইস্ট-মোহন কর্তারা যাই বলুন, ফেডারেশন দারুণ খুশি। দক্ষিণ ভারত থেকেও ভারতসেরা হওয়ায়। তাঁদের ধারণা, বেঙ্গালুরুর হাত ধরে দক্ষিণে ফের দ্যূতি ছড়াবে ভারতীয় ফুটবল।

নজিরের নেপথ্যে

• ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের মতো দলের সহকারী ম্যানেজার অ্যাশলে ওয়েস্টউডকে কোচ করে আনা।

• কোচের হাতেই দল গড়ার পুরোপুরি দায়িত্ব তুলে দেওয়া।

• টাকার থলি নিয়ে দেশের তারকা ফুটবলারদের পিছনে না ছুটে কেবল বিদেশি লিগে খেলে আসা জাতীয় অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীকে নেওয়া।

• দল হারলেও কর্তাদের টিমের অন্দরমহলে মাথা না গলানো।

• একসঙ্গে খাওয়া, থাকা, প্র্যাকটিস কার্যত সারা দিন টিমকে একসূত্রে রাখার কোচের স্ট্র্যাটেজি।

• অ্যাওয়ে ম্যাচে প্যাকেজ ট্যুরের বন্দোবস্ত করে কর্তাদের সমর্থককুল তৈরি করা। কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত বেঙ্গালুরবাসীকে মাঠে টেনে আনতে পারা।

iLeague sunil chetri bengaluru champion 2014
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy