ফিকরুর গোল-উত্সব। বৃহস্পতিবার গুয়াহাটিতে। ছবি: পিটিআই
টিমের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করায় জুড়ি নেই। কখনও পিছনে লাগেন কেভিন লোবোর, কখনও বা টিমের ফিজিও পুষ্পকেতু কোনারের। মাঝে একটু মাথা গরম করতেন, কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টের উপদেশে এখন একদম বরফশীতল।
কে তিনি? তিনি আটলেটিকোর দে কলকাতার গোলমেশিন ফিকরু তেফেরা। দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই যিনি দলের কাছে পরিণত হয়ে গেলেন গোলমেশিন হিসেবে। যাঁর আফ্রিকান নেশনস কাপে গোল আছে ষাট গজ দূর থেকে। গোল আছে দিদিয়ের দ্রোগবার আইভরি কোস্টের বিরুদ্ধেও।
ইথিওপিয়ার এই স্ট্রাইকার এ বার পরপর দুই অলিম্পিকে ম্যারাথনে জোড়া সোনা জয়ী তাঁর দেশের কিংবদন্তি দৌড়বীর আবেবে বিকিলার ভক্ত। সেই বিকিলা একটা কথা বলতেন সব সময়। “যখন আমার দেশের কেউ যে কোনও খেলাতেই মাঠে নামবে, তখন সে যেন সর্বদা মনে রাখে দেশের সম্মানের কথা। ইথিওপিয়ানদের সাহস ও শৌর্যের কথা। তা হলেই মাঠে পারফরম্যান্সে কখনও পিছিয়ে পড়তে হবে না।”
আটলেটিকো কেচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের এই গোল মিসাইল কি বিকিলার সে কথা মাথায় নেমেই রোজ মাঠে নামেন? মিক্সড জোন দিয়ে যখন স্টেডিয়াম ছাড়ছিলেন তখন প্রশ্নটা করতেই একটু থমকে দাঁড়ালেন। তার পর চোখ টিপে থাম্বস আপ দেখিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলেন টিম বাসের দিকে।
প্রথম ম্যাচের পর দ্বিতীয় ম্যাচেও গোল। আরব সাগরের তীরবর্তী মুম্বইয়ের দলও যেমন তাঁকে বুঝতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিল, তেমনই অবস্থা হল দেশের উত্তর-পূর্বের টিমেরও। দু’দিনই লুই গার্সিয়ার থেকে বল পেয়ে দেশের দু’প্রান্তের রক্ষণকেই শাসন করে শুধু গোলই করলেন না, সামারসল্টও দিলেন। তফাত একটাই যে, কলকাতায় ফিকরুর গোলের পর সামারসল্ট দেখে হাততালির বন্যা বয়ে গিয়েছিল যুবভারতীতে। আর এ দিন ফিকরুর গোলের পর ৩৫ হাজারের গর্জন পরিণত হল শ্মশানের স্তব্ধতায়।
ম্যাচের পর ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়াম থেকে বিরস মুখে বেরিয়ে আসছিল একের পর এক। এঁদেরই মধ্যে কেউ একজন তখনই ভাসিয়ে দিলেন কথাটা বিপাশা কি কলকাত্তা কে সামনে জন কা টিম ক্যায়সে হার গিয়া ও তো আভিভি সমঝ নেহি আয়া!
দর্শককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফিকরু-গার্সিয়া জুটি নিয়ে নর্থইস্টের কিউয়ি কোচ আশঙ্কা করেছিলেন আগের দিনই। এ দিন ম্যাচে ঠিক তাই হল। দু’পাটি জুতোর মতোই যেন বোঝাপড়া গার্সিয়া-ফিকরু জুটির। গার্সিয়ার পাসিং। বল হোল্ড না করা। গার্সিয়ার জায়গা নেওয়া যেমন আটলেটিকো দে কলকাতার একটা অন্যতম শক্তি, তেমনই ফিকরুর বল স্ক্রিনিং, বক্সের মধ্যে হেলায় দু’তিন জনকে কাটানোর সহজাত দক্ষতাও টিমের একটা বড় অস্ত্র। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে উচ্চতাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা। এতেই কিস্তিমাত পর পর দুই ম্যাচে।
আর কিস্তিমাতের নেপথ্য-কাহিনি?
আটলেটিকোর ড্রেসিংরুম থেকে শোনা গেল, গুয়াহাটি থেকে গত সোমবার ফিরে এসে ব্যারেটো সোজা চলে গিয়েছিলেন কোচ হাবাসের কাছে। সেখানেই তিনি কোচকে বলেন নর্থইস্টের টিম গতিতে শুরু করলেও রক্ষণের আগে পাঁচিল তুলে দিলে ম্যাচ পকেটে পুরে নেওয়া কঠিন হবে না। তার পরেই এ দিন চার ডিফেন্ডারের সামনে আগের ম্যাচের ফর্মেশন রেখে টিম মাঠে নামিয়ে দিয়েছিলেন আটলেটিকো কোচ। ব্যাক ফোরের আগে দাঁড়িয়ে নর্থইস্টের জেমস কিন এবং কোকেকে পালা করে ধরলেন বোরহা ফার্নান্দেজ এবং অফেন্তসে নাতো। এই দুই ডাবল পিভটের একজন বোরহা নিচে নামলেন আর নাতো তাঁর সামনে। আর তাতে যাবতীয় অঙ্ক গুলিয়ে গেল নর্থইস্টের। শুরু থেকে ঝড়-ঝাপটা আমদানি করেও লাভ হল না। খোলা গেল না আটলেটিকোর গোলমুখ।
আর ভাগ্যও সব সময় সাহসীদেরই সহায় হয়। নর্থইস্ট কোচ ম্যাচের পর বলছিলেন, “শেষ ছ’দিনে তিনটে ম্যাচ। তাই ফুটবলারদের তরতাজা অবস্থায় পাওয়াই সমস্যা। ম্যাচের আগে আগের ম্যাচে দুরন্ত পারফর্ম করা মিগুয়েল গার্সিয়া বলে বসে কাফ মাসলে চোট।” এরই সঙ্গে কাফ মাসল শক্ত হয়ে যাওয়ায় পাওয়া যায়নি লেফট ব্যাক রবিন গুরুংকেও। আর এখানেই ম্যাচটা বিশ্বকাপার কোচ হার্বার্টের পকেট থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেল হাবাসের পকেটে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের দিনে নর্থইস্টের রক্ষণকে এরপর একপ্রকার ‘খাদ্য’ই বানিয়ে ফেলেছিলেন গার্সিয়া-ফিকরুরা। যার সামনে থরথর করে কাঁপছিলেন গার্সিয়ার স্বদেশীয় কাপদেভিয়াও। এ দিন যাঁদের ডুয়েল দেখার জন্য প্রায় তৈরি হয়েই স্টেডিয়ামে এসেছিলেন হাজার পঁয়ত্রিশ দর্শক। ‘উই আর নর্থইস্ট, উই আর ইউনাইটেড’ বলে দলকে চাগানোর জন্য তাঁদের প্রচেষ্টারও খামতি ছিল না। কিন্তু ম্যাচের পনেরোর মিনিটে গার্সিয়ার লব ধরে যে ভাবে চেস্ট ট্র্যাপ করে গতিতে বিপক্ষ স্টপার কোন্দওয়ানিকে ছিটকে গোলটা করে এলেন ফিকরু— তা দেখে দর্শকরা যেমন স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তেমনই ফিকরুর গোলের পর সামারসল্ট দেখে আইবররাও কেমন যেন চুপসে গেলেন।
দ্বিতীয়ার্ধে খেলা ধরার বদলে হারবার্টের দল আবার খেলা ধরার বদলে মাথা গরম করে ফেলায় আরও গণ্ডগোল হয়ে গেল। তবে এই সময় নিজেদের কাউন্টার অ্যাটাকের গেম প্ল্যানের তাস পকেট থেকে বের করেছিলেন লিও বার্তোসরা। চাপ তখন বাড়ছিল আটলেটিকো রক্ষণে। আর তার ফলেই শেষ লগ্নে বার্তোসকে বেমক্কা পা চালিয়ে বোরহার লাল কার্ড দেখা। যার ফলে ম্যাচ জিতেও দেল পিয়েরোর দলের বিরুদ্ধে নামার আগে একটু অস্বস্তিতেই রইল আটলেটিকো।
আর গার্সিয়া-কাপদেভিয়া টক্কর দেখার বদলে শেষ লগ্নে অবশ্য আটলেটিকো কোচ হাবাস এবং নর্থইস্টের ফুটবলার ও কোচের তর্কাতর্কি দেখা গেল। খেলা শেষ হওয়ার আগে পদানির গোলের পর হাবাসের আনন্দ-উচ্ছ্বাসেই এই ঘটনার সূত্রপাত। যা ছড়িয়ে পড়ে খেলোয়াড়দের মধ্যেও। হার্বার্ট সাংবাদিক সম্মেলনে বলে গেলেন, “আইএসএল ভারতীয় ফুটবলের স্প্রিং বোর্ড। সেখানে এই আচরণ কাম্য নয়। আর হাবাস? তিনি বললেন, “আমার সেলিব্রেশন দেখে ওদের মনে হয়েছিল উপহাস করছি। এমনিতেই চাপে ছিলাম। পদানির গোলের পর লাফিয়েছিলাম। এতে যদি কেউ আহত হয়ে থাকেন তা হলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
হাবাস যখন এ কথা বলছেন সাংবাদিক সম্মেলনে তখন হাজির ম্যাচ কমিশনার জে রবিশঙ্কর এবং রেফারি অ্যাসেসর ওয়াল্টার পেরিরা। দু’জনের মন্তব্যই রেকর্ড করেন তাঁরা।
কে জানে, দু’ম্যাচে ছ’পয়েন্ট নিয়ে হোটেলে ফেরার আগে এটাই কাঁটা কি না আটলেটিকো শিবিরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy