Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
ইডেনের শারদোত্‌সব শুরু

দুরানি বলে গেলেন, এই মাঠ না থাকলে ইঞ্জিন ড্রাইভার হতাম

ইডেনের মোহিনী সন্ধেয় ইতিহাস-উদযাপন মঞ্চে যে তিন জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনকে ভারতবর্ষ ‘প্রিন্স’ বলে ডাকে। এক জনের নামকরণের ক্ষেত্রে একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন জিওফ্রে বয়কট। ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ বলতে কাকে বোঝায়, কোন ঔদ্ধত্য বোঝায়, ভারত জানে।

শুরু হল ইডেনের দেড়শো বছর পূতির্র অনুষ্ঠান। এক ফ্রেমে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, চাঁদু বোরডে, সেলিম দুরানি ও ঝুলন গোস্বামী। বৃহস্পতিবার। ছবি: উত্‌পল সরকার

শুরু হল ইডেনের দেড়শো বছর পূতির্র অনুষ্ঠান। এক ফ্রেমে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, চাঁদু বোরডে, সেলিম দুরানি ও ঝুলন গোস্বামী। বৃহস্পতিবার। ছবি: উত্‌পল সরকার

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৪৯
Share: Save:

ইডেনের মোহিনী সন্ধেয় ইতিহাস-উদযাপন মঞ্চে যে তিন জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনকে ভারতবর্ষ ‘প্রিন্স’ বলে ডাকে।

এক জনের নামকরণের ক্ষেত্রে একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন জিওফ্রে বয়কট। ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ বলতে কাকে বোঝায়, কোন ঔদ্ধত্য বোঝায়, ভারত জানে। ভারত জানত আরও এক জনকে। অবশ্যই তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রজন্মের নন, আগের। জন্মসূত্রে ভারতীয়ও নন, আফগান। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে যেমন তাঁকে বাদ দিলে আর কোনও ভিনদেশীয় ক্রিকেটার খেলেননি, ঠিক তেমনই ক্রিকেটলিখিয়েদের আর ওই অমর লাইনটাও তাঁর বাইরে আর কাউকে নিয়ে লিখতে হয়নি‘হি ক্যান হিট সিক্সেস অন পাবলিক ডিমান্ড!’

সেলিম দুরানিকে বাদ দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না।

সেলিম দুরানিকে বাদ দিয়ে ইডেন-ইতিহাসও অসমাপ্ত থাকে।

ইডেনে ক্রিকেটের সার্ধশতবর্ষ উদযাপনে সিএবি-আয়োজন দেখে মনে হবে, ঠিকই হল। ইডেনের নতুন অধ্যায় শুরুর প্রথম দিনে মঞ্চে সেলিম দুরানি, চাঁদু বোরডে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থাকবেন না তো কারা থাকবেন? প্রথম দু’জনের হাত ধরে অর্ধশতাব্দী আগে ইডেনে প্রথম বার ভারতকে টেস্ট জিততে দেখা, জিততে দেখা ইংরেজদের হারিয়ে। ’৬১-’৬২-তে। তৃতীয় জনের ক্রিকেটের আঁতুরঘরই এটা। সৌরভের ক্রিকেটজীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন কোনটা দেখেনি ইডেন?

আর এই তিনের কাছে ইডেনের অর্থগুলোও বেশ অদ্ভুত।

ইডেন বলতে সেলিম দুরানি বোঝেন, তাঁর সামনে ক্রিকেটের দরজা খুলে যাওয়া। নইলে ভারতের পূর্বতন ‘প্রিন্স’-কে নাকি ইঞ্জিন ড্রাইভার হতে হত!

ইডেন বলতে চাঁদু বোরডে বোঝেন, একটা পেয়ারা। যা মাঠে পড়েছিল, আর বল তাতে লেগে বাউন্ডারি পেরোনোয় তাঁকে গ্যালারি থেকে শুনতে হয়েছিল, ‘বোরডে, খেলা ছোড় দে!’

ইডেন বলতে সৌরভ গঙ্গোপাাধ্যায়ের মনে পড়ে, দুখীরাম ক্রিকেট কোচিং সেন্টার থেকে পিতা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রথম বারের জন্য ইডেনে ঢুকে পড়া। বা ইডেনের চিত্‌কারে বিপর্যস্ত নাসের হুসেনকে ‘ভারতের ব্যাটসম্যানদের আউট করতে পারছি না, ইডেনকে চুপ করাতেও পারছি না, জিতব কী ভাবে’ বলতে শুনে ইংরেজ অধিনায়ককে তাঁর টোটকা দিয়ে দেওয়ার কথা। যা এ রকম ছিল: নাসের, ইন্ডিয়ায় তা হলে আর জেতার কথা ভেবে এসো না। বরং ভেবো, তুমি ম্যাচটায় স্রেফ অংশ নিতে এসেছ!

আতসবাজির কত যে রং ধরল একে একে। ভারতের দিকপাল ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাংলার বিখ্যাতদের মেলবন্ধন। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক গোপাল বসুকে বহু দিন পর দেখা গেল সিএবি-তে। রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। ইডেন নিয়ে যাঁর বই উদ্বোধন করে সার্ধশতবর্ষের অনুষ্ঠান-প্রবাহের শুরু হল, সেই রাজু মুখোপাধ্যায় ছিলেন। প্রণব রায়, চুনী গোস্বামী থেকে রণদেব বসু-সৌরাশিস লাহিড়ী, ভারতের প্রাক্তন অধিনায়িকা ঝুলন গোস্বামী বাদ কেউ যাননি। প্রদীপ জ্বালিয়ে বই প্রকাশ থেকে ইডেনের উপর তথ্যচিত্রের উন্মোচন, সবই ঘটল। ইডেনের জন্মবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে এ মাঠে রোহন কানহাইয়ের অমর ইনিংস, বিশ্বকাপ ফাইনাল, পেলে ম্যাচ, ভিভিএস-দ্রাবিড়ের কাঁধে চেপে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়, কুখ্যাত ১৬-ই অগস্ট কিছু বাদ যায়নি। অনুষ্ঠানের বাড়তি ঔজ্জ্বল্য নিশ্চিত ভাবে অতীতের দুই মুখ। যাঁদের মধ্যে দুরানি বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় মঠ ঘুরে ইডেন এলেন। আর বোরডে অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে রাজু মুখোপাধ্যায়কে বলে দিলেন, ‘‘চলো তো, আগে মাঠের ভেতরে এক বার যাব।”

বোরডের এখনও মনে আছে ইডেনে টেস্ট খেলতে আসার দীর্ঘ যাত্রার দিনগুলো। “মুম্বই থেকে তেতাল্লিশ ঘণ্টা লাগত আসতে। কিন্তু কোনও কষ্ট টের পেতাম না। ইডেনই আমাদের কাছে লর্ডস ছিল,” অনুষ্ঠানে বলছিলেন বোরডে। ’৫৮-৫৯-এ প্রবল পরাক্রমী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইডেনে তাঁর খেলা প্রথম টেস্টের কথা ছবির মতো মনে আছে। ভোলেননি, ইডেন দর্শক নিয়ে নিজস্ব ‘প্রিন্সিপল’ও। “এক বার এ দিক ও দিক হয়েছে তো তুমি গেলে। গ্যালারি তোমার বারোটা বাজিয়ে দেবে। আমার তো দিয়েছিল। আর এক বার জেতার পর দর্শক এমন ছুটল আমাদের জন্য যে দেখে ক্যারিবিয়ান টিমকে দেখলাম প্রাণভয়ে দৌড়তে। ওরা ভেবেছিল ওদের ধরতে আসছে,” সহর্ষ করতালিতে ডুবে যায় বোরডের গলা।

যার ডেসিবেল আরও বাড়ে দুরানির কথায়। “কার্তিকদা (বসু) না থাকলে আমি ইডেনে খেলতে আসি না মুম্বইয়ের স্কুলের হয়ে। আমাকে তো মুম্বই নেয়নি। কার্তিকদা তখন সিসিআইয়ে। ওঁর চাপেই হয়েছিল।” যে ম্যাচে দু’ইনিংস মিলিয়ে তিনি বারোটা উইকেট পেয়েছিলেন, যার পর গুজরাতের হয়ে তাঁর রঞ্জি খেলা, যে পথ গিয়ে মিশেছিল শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। বোরডে টেস্ট ম্যাচের টিকিট চেয়ে গেলেন সিএবি যুগ্ম-সচিব সৌরভের কাছে। সিএবি কর্তাদের বলে গেলেন, ইডেনে ভারত-পাক রজতজয়ন্তী ম্যাচে ডাক না পেয়ে দুঃখ পেয়েছিলেন। দুরানি আবেগাপ্লুত। তাঁর মতো প্রাক্তনদের যে এখনও কেউ ভাবে, জানা ছিল না তাঁর। সৌরভ? আবেগের মঞ্চে তাঁর ঘোষণা বাংলা থেকে একটা পঙ্কজ রায়, একটা গাঙ্গুলি বার করতে আর তিরিশ বছর খরচ করলে চলবে না। নিয়মিত তুলে আনতে হবে।

আর নস্ট্যালজিয়া, আবেগ, প্রতিশ্রুতিতে মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় ক্লাবহাউসের দৃশ্যটাও বড় প্রতীকী মনে হবে ক্রিকেটপ্রেমীর। সারি-সারি ক্রিসমাস ট্রি-র আদলে সাজানো আলোর গাছ, আকাশে আতসবাজি।

ঠিকই আছে। আজ থেকে তো রোজই ইডেনের ‘বড়দিন’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE