Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দেশের নয়, মেসির গাণ্ডীবে হারল ইরান

সারা বিশ্ব ব্রাজিলীয় সমর্থকদের ফুটবল মাঠ রূপসী হলুদে রাঙিয়ে দেওয়ার কথাই বলে! বলে তাদের মায়াবী উচ্ছ্বাস আর শব্দব্রহ্মের কথা, যা ফুটবল ম্যাচের চেহারাই বদলে দেয়। খোদ ব্রাজিলে বসে বারবার মনে হচ্ছে এমন একপেশে বিচার আর্জেন্টাইন সমর্থকদের প্রাপ্য নয়। শনিবার যেমন বেলো হরাইজন্তের মাঠে তাঁরা শুধু রঙিন নন। পাহাড়ি ঝর্নার কলরবে হাজির ছিলেন আর ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে থেকে দৃশ্যকল্প তৈরি করে গেলেন! নীল- সাদা জার্সি। কারও হলুদ। মাথায় শিঙের মতো টুপি।

অবশেষে গোল। সতীর্থ দি মারিয়ার আলিঙ্গনে মেসি। তবে তিনি দেশকে জেতালেও জার্মানিকে রুখে দিল ঘানা। উৎপল সরকারের তোলা ছবি।

অবশেষে গোল। সতীর্থ দি মারিয়ার আলিঙ্গনে মেসি। তবে তিনি দেশকে জেতালেও জার্মানিকে রুখে দিল ঘানা। উৎপল সরকারের তোলা ছবি।

গৌতম ভট্টাচার্য
বেলো হরাইজন্তে শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

সারা বিশ্ব ব্রাজিলীয় সমর্থকদের ফুটবল মাঠ রূপসী হলুদে রাঙিয়ে দেওয়ার কথাই বলে! বলে তাদের মায়াবী উচ্ছ্বাস আর শব্দব্রহ্মের কথা, যা ফুটবল ম্যাচের চেহারাই বদলে দেয়। খোদ ব্রাজিলে বসে বারবার মনে হচ্ছে এমন একপেশে বিচার আর্জেন্টাইন সমর্থকদের প্রাপ্য নয়। শনিবার যেমন বেলো হরাইজন্তের মাঠে তাঁরা শুধু রঙিন নন। পাহাড়ি ঝর্নার কলরবে হাজির ছিলেন আর ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে থেকে দৃশ্যকল্প তৈরি করে গেলেন! নীল- সাদা জার্সি। কারও হলুদ। মাথায় শিঙের মতো টুপি। কিক অফের আগে থেকেই গান গেয়ে-নেচে এমন অসামান্য কোরিওগ্রাফি যে, হে অধিনায়ক আসুন, মঞ্চ তৈরি। এ বার আপনি শুধু পারফর্মটা করে যান। আজ দুর্বল এশীয় দলকে আমাদের গোলের মালা পরানোর দিন।

আপাদমস্তক লিওনেল মেসির মঞ্চে এর পর যা ঘটল গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছে আর্জেন্তিনা ১ : ইরান ০।

গোলের অব্যর্থ সুযোগ তৈরি এবং নষ্টের যদি ম্যাচ স্কোরবোর্ড হয়, তা হলে দাঁড়ায় ইরান ৩ : আর্জেন্তিনা ২।

কী লিখব বুঝতেই পারছি না! গ্যালারিতে থাকা মারাদোনার সামনে মেসির দুর্ধর্ষ গোল?

এশিয়ার হেরে গিয়েও বিশ্বমঞ্চে সোনার দিন?

নাকি ইরানের কোস্টারিকা হয়ে যেতে যেতে মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্য থেমে যাওয়া?

ইরানি ডিফেন্স যা খেলছিল ইরান-ইরাক যুদ্ধে তাদের সেনাবাহিনী সেই লড়াই করলে গোটা দেশ গর্বিত থাকবে! আগেরো, ইগুয়াইন, অ্যাঞ্জেলো দি’মারিয়া, এরা সব কোটি কোটি টাকার ইউরোপীয় লিগের এক একজন তারকা। কিন্তু ভেদই করতে পারছিলেন না ইরানি ডিফেন্স। পেনিট্রেটিভ জোনে যে কোনও সময় অন্তত ছয় থেকে সাত জন লাল জার্সি। আর তারা এত ক্ষিপ্র এবং শক্তিধর যে, লাতিন আমেরিকান ক্ষিপ্রতাও জমি তৈরি করতে পারছে না।

শনিবার খেলার একানব্বই মিনিটে খাওয়া গোলে ইরান হারলেও প্রমাণ করে গেল, অন্তত দেশজ মঞ্চে এখন বড় টিম আর ছোট টিমের তফাত অনেক কমে গিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। জিম করে, ওজন তুলে, স্প্রিন্ট করে সবাই এখন এত ফিট যে জায়গাই পাওয়া যায় না। চারটে লোককে ফেলে দিয়ে দুরন্ত গোল করে দিলাম, সেটা হয়তো এখনও এক-আধ দিন ঘটবে। কিন্তু হাতে গোনা যাবে। এত দিন লোকে সামনে একশো মিটার টানত দশ সেকেন্ড বা তারও কমে। এখন দশ সেকেন্ডে নিজের গোলে উল্টোমুখী ফিরে আসছে। শুধু তো ডিফেন্ডারদের হারালেই হবে না, দ্রুত গতির মিডফিল্ডার সারাক্ষণ ট্যাকলের ছোবল নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। পুলিশম্যান মার্কিং আর হচ্ছে না। এমনকী মেসির জন্যও না। রোনাল্ডো থেকে মেসি সবাইকে এখন জোনাল মার্কিংয়ের মধ্যে ফেলা হচ্ছে। যখন বল পাবেন শনিবারের মতো তিন জন করে থাকবে। কিন্তু আলাদা করে কেউ অন ডিউটি মেসি না।

প্রথমার্ধে একটা সময় মনে হচ্ছিল ৪-৩-৩ নিয়েও আর্জেন্তিনা গোল করতে পারছে না তো ঠিক আছে। এ তো কলকাতা মাঠে ছোট দলও লিগে ফার্স্ট হাফ আটকে দেয়। একবার গোল শুরু হলে পরপর বন্যা বইবে। তখনও স্বপ্নেও ভাবিনি দিয়েগো মারাদোনাকে মাঠে বসে দেখতে হবে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ৩৭ নম্বরে থাকা কোথাকার কে ইরান তাঁর দেশের ফুটবল-গরিমায় এমন হাত দিতে যাচ্ছে।

সের্জিও রোমেরো আজ ইরানি ডিফেন্সের মতোই দুর্ভেদ্য না থাকলে মেসিরা হয় হারতেন। না হয় বড়জোর ড্র হত। শেষ পনেরো মিনিটে মনে হল মেসি খেলাটা ব্যক্তিগত গর্বে ধরলেন। এতক্ষণ চলছিল আর্জেন্তিনার অ্যাকাউন্টে। তিনি নাগাড়ে স্কিমিং করে বল বাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আর সহ-ফরোয়ার্ডরা অপচয় করে যাচ্ছিল। এ বার যেন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টটার চেক বই বার করলেন। যা গ্রেট প্লেয়াররা চরম বিপন্নতায় আপনাই বের করে আনতে জানে!

এই জন্যই সে গ্রেট। আগেরো নন। ডান প্রান্ত থেকে ভেতরে ঢোকা একটা নিরামিষ আক্রমণ যেটা পঁচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকের নোটবইয়েই ওঠে না। সেটাকে তাঁর মহিমায় জীবন্ত করে দিলেন মেসি! একটা ফলস দিলেন, যেন পাস করবেন। ডিফেন্ডার ডান দিক দেখছে। এ বার বাঁ পায়ে রাইট ইনসাইডের জায়গা থেকে শট নিলেন। সোয়ার্ভ করে গোলপোস্টের কোনা দিয়ে ঢুকে গেল। মুগ্ধ সাবেয়া তাঁর অধিনায়কের সঙ্গে যদি কোনও ঝগড়াও থেকে থাকে তা থামিয়ে, মোহাবিষ্টের মতো সাংবাদিক সম্মেলনে বলে গেলেন, ‘দু’টো গোলকিপার মিলিয়েও ওই শট বাঁচাতে পারত না।” একেবারে হক কথা।

দশ দিনের বিশ্বকাপের সেরা গোল। খেলার পরেও নাগাড়ে কাঁদছিলেন ইরানি গোলকিপার হাঘিগি। কিন্তু টিমমেটদের তাঁকে বোঝানো উচিত তুমি আর্জেন্তিনার কাছে অপরাজিত, তুমি হেরেছো মেসির কাছে।

মনে রেখো তোমায় হারাতে ওকে গাণ্ডীবটাই বার করতে হয়েছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE