Advertisement
E-Paper

বড় ম্যাচে জার্মানি আহামরি নয়, আতঙ্কে ভুলেছে ব্রাজিল

ধা-আ-আ-ক-ধা-আ-আ-ক-ধা-আ-আ-ক। ঢাক আর মাদল মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে বেলো হরাইজন্তে শহরের মধ্যপ্রদেশ থেকে। তৈরি করা একটা স্টেজ। তার ওপর নানান বাদ্যযন্ত্র। সেগুলোর ব্যবহার না করে হলুদ শার্টে একদল ঢাক বাজাচ্ছে। এক বার করে সেটা বন্ধ হতেই ড্রামের আওয়াজ। ড্রামধারীরাও হলুদে!

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৪ ০২:৪৩

ধা-আ-আ-ক-ধা-আ-আ-ক-ধা-আ-আ-ক।

ঢাক আর মাদল মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে বেলো হরাইজন্তে শহরের মধ্যপ্রদেশ থেকে। তৈরি করা একটা স্টেজ। তার ওপর নানান বাদ্যযন্ত্র। সেগুলোর ব্যবহার না করে হলুদ শার্টে একদল ঢাক বাজাচ্ছে। এক বার করে সেটা বন্ধ হতেই ড্রামের আওয়াজ। ড্রামধারীরাও হলুদে!

ঢাক তো জানতাম যাবতীয় ব্রাজিলীয় নগরীর মধ্যে সালভাদরের বৈশিষ্ট। কয়েক’শো বছর আগে সালভাদর বন্দর দিয়েই আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ব্রাজিল নিয়ে আসা হয়। তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল আফ্রিকান মাদল আর ঢাক। তার পরম্পরা আজও চলছে। হঠাৎ বেলোয় বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল প্রাক্কালে সোমবার এই ঢাকের উৎসব কেন?

ঠিক যেন, অরণ্যদেব করোটি গুহায় শহর থেকে তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে ঢুকলেন। ডায়নাকে সম্মান জানাতে মজবুড়োরা অনুপম সব বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা রেখেছেন। সেগুলোই বাজছে। এখানে কি তাই? নাকি উল্টোটাও হতে পারে। করোটি গুহা ছেড়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছেন অরণ্যদেব! এটা তাঁর বিদায়ী সংবর্ধনা!

সোমবার ভোরসকালে যারা মাদল আর ঢাক নিয়ে ব্যস্ত ছিল, সে তল্লাটে এমন এক জনকেও পেলাম না যে ইংরেজি জানে এবং ব্যাখ্যা করতে পারে এটা কীসের জন্য? ব্রাজিলের ওপর সৌভাগ্য বর্ষণের আধিদৈবিক আবাহন? নাকি স্কোলারির টিমের বিদায়ী সংবর্ধনা রঙিন করে রাখতে?

আসলে শঙ্কা আর বিষণ্ণতা মিলিয়ে এমন অদ্ভুত একটা মুড হয়ে রয়েছে বেলো-সহ গোটা ব্রাজিলের যে, বাজনাও আর পাঁচ দিনের মতো টিমের শুভকামনায় হতে পারে, তেমন ভরসাই পাওয়া যাচ্ছে না!

নইলে পৃথিবীতে কেউ কখনও শুনেছে ব্রাজিল টিম হলুদ কার্ডের বিরুদ্ধে আবেদন করে? বা কোনও সভ্য ফুটবল দেশে করে বলে? ভারত ১৪৭ নম্বরে থাকতে পারে ফিফায়, কিন্তু তারাও কখনও এমন আবেদন জানায়নি যে, আমাদের অমুকের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় হলুদ কার্ডটা অযৌক্তিক দেখানো হয়েছে। ওটা প্লিজ তুলে নিন। রেড কার্ডের বিরুদ্ধে আবেদন হতে পারে। হয়েওছে। কিন্তু হলুদ কার্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ফুটবলের অবিসংবাদী সম্রাট ব্রাজিল যে প্রাক সেমিফাইনাল আবেদন করল এবং প্রত্যাখ্যাত হল, তা থেকেই পরিষ্কার, কেমন দুঃসহ চাপে রয়েছে!

ব্রাজিলীয় ফুটবল সংস্থার আবেদন নাকচ করে দিয়ে ফিফা বলেছে, থিয়াগো সিলভার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড প্রত্যাহার করা সম্পর্কে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কিছুই করার নেই। এটা বিবেচনা করার আইনি ভিত্তি নেই। এমনকী নেইমারের চোটের ব্যাপারেও ফিফার কিছু করণীয় নেই কারণ, রেফারি সংশ্লিষ্ট কলম্বিয়ান ফুটবলার ক্যামিলো জুনিগাকে না হলুদ, না লাল, কোনও কার্ডই দেখাননি!

ফিফা আবেদনে ০-২ প্রত্যাখ্যাত ব্রাজিল ফুটবল মহল আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তাদের বেলো সেমিফাইনালে ফিফা মার্কো রদ্রিগেজকে পোস্টিং দেওয়ায়। মার্কো সেই মহাবিতর্কিত উরুগুয়ে-ইতালি ম্যাচের রেফারি ছিলেন। যেখানে সুয়ারেজের কামড়ে দেওয়াটা তিনি দেখতেই পাননি। ফিফার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি পরে ভিডিও দেখে সুয়ারেজকে ন’ম্যাচ নির্বাসনে পাঠায়।

এ দিন ফিফার রায় বেরনোর পর বেসরকারি ভাবে ব্রাজিল ফুটবল সংস্থার লোকেরা বলতে থাকেন, এটা কী দ্বিচারিতা? যে কমিটি ভিডিও দেখে সুয়ারেজকে শাস্তি দিল, তারাই কি না ভিডিও দেখেও জুনিগাকে বেকসুর খালাস দিয়ে দিল? ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসেই বোধহয় এমন নজির নেই যে, সেমিফাইনাল খেলার আগে জেতায় মন না দিয়ে তারা মাঠের বাইরের ব্যাপার নিয়ে তিতকুটে!

নেইমার দ্য সিলভা তিনিও টিমকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার বদলে এ বার নিজের অবচেতনে খানিকটা আতঙ্কই ছড়াচ্ছেন। সোমবার নিজের বাড়ি থেকে তিনিও আচমকা ব্রাজিলীয় মিডিয়াকে জানান, টিম ফাইনালে গেলে মারাকানায় নামার একটা অসম্ভব চেষ্টা করবেন। পেনকিলারে তাঁর ব্যথা নাকি অনেকটা কমেছে। যদি ১৩ জুলাইয়ের আগে আরও ভাল হয়ে যায়, নামার চেষ্টা করতে অসুবিধে কী? ব্রাজিলীয় টিমের ডাক্তার দ্রুত বিবৃতি দিতে বাধ্য হন, নেইমারের যা অবস্থা খেলার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ওই শিরদাঁড়ার হাড় ভাঙাটা নিয়ে মাঠে নামা যায় নাকি? ব্রাজিলীয় জনগণ যেন দূরতম কল্পনাতেও না ভাবেন যে নেইমার বিশ্বকাপে আর খেলতে পারবেন।

রবিনহো এ দিন গিয়েছিলেন নেইমারকে দেখতে। কাকার মতো তিনিও স্কোলারির বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়া এক বিক্ষুব্ধ। নেইমারকে দেখে বার হওয়ার পর যথারীতি অপেক্ষমান মিডিয়া পেয়ে একপ্রস্ত নুন-লঙ্কা ছিটিয়ে দিয়েছেন। নেইমার ছাড়া সম্ভাবনা কী দেখছেন? রবিনহো বলেছেন, “নেইমার থেকেও তো সম্ভাবনা বিশেষ ছিল না!”

নেইমারের বদলি কে, এই লাখ টাকার প্রশ্নের উত্তর পেতে ব্রাজিলীয় মিডিয়া এ দিন ভিড় করেছিল তেরেসোপলিসের বেসক্যাম্পে। সেখানে প্র্যাক্টিস দেখে কিছু বুঝতে পারেনি। স্কোলারি অনেক ঝানু পেশাদার। স্বদেশীয় মিডিয়া তো আসলে নয়, জার্মানদের তিনি শেষ মিনিট পর্যন্ত ধন্ধে রেখে দিলেন, ওই জায়গাটায় কাকে ব্যবহার করবেন? সোমবার স্কোলারির প্রথম একাদশ ছিল জুলিও, আলভেজ, লুইজ, মার্সেলো, দাঁতে, গুস্তাভো, ফার্নান্দিনহো, পওলিনহো, অস্কার, হাল্ক আর ফ্রেড। এর পরে নামানো হয় উইলিয়ান আর বার্নার্ডকে। ব্রাজিলীয় মিডিয়া পুরো ঘেঁটে গিয়েছে যে, তা হলে কোনটা প্রথম এগারো? জার্মানদেরও একই অবস্থা হওয়া উচিত।

ব্রাজিলীয় মিডিয়া বা প্লেয়ারদের মধ্যে একটা কথা দেখলাম কেউ বলছে না যে, জার্মানির নিজেদেরও সেমিফাইনালে যথেষ্ট ঘাবড়ে থাকা উচিত! সেই ছিয়ানব্বইয়ে ইউরো কাপ জেতার পর মাঝের আঠারো বছরে জার্মানদের কোনও আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই। বিদেশি মিডিয়ায় যেমন তাদের বড় ম্যাচের রাজা বলে সম্মান করে, স্বদেশীয় প্রেসের কাছে তারাই হল বকলমে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট টিম। যাদের বলা হয় চোকার্স। যারা বড় বড় টুর্নামেন্টের শেষ দুই বা শেষ চারে যায় এবং অবধারিত ট্রফি না জিতে ফেরে। এ বারও জার্মান মিডিয়া বলছিল রিয়াল মাদ্রিদের কাছে মিউনিখে যে বায়ার্ন টিম চার গোলে হেরেছে, তার ছ’টা প্লেয়ার এই টিমে। ম্যানুয়েল নয়্যার, ফিলিপ লাম, জেরোম বোয়াতেং, টনি ক্রুজ, টমাস মুলার, বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, এঁদের বিশ্বকাপ মনোবল বলেই কিছু থাকবে না।

অথচ এঁরাই দেখা যাচ্ছে জোয়াকিম লো-র টিমের ধারক ও বাহক। লো নিজেও প্রচুর সমালোচনা সহ্য করেছেন গত কয়েক বছর সমেত এই বিশ্বকাপে। কাল তিনিও শুধুই লুই ফিলিপ স্কোলারির সঙ্গে লড়ছেন না!

মিডিয়া শাটল করে মাঠে আসার সময় দেখছিলাম একটা বাড়ির ছাদে পাশাপাশি ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার পতাকা টাঙানো। যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। ভাব হয়ে গেল নাকি দু’পক্ষে ইউরোপীয় আগ্রাসনে দু’জনই বিপন্ন দেখে? হওয়ার তো কথা নয়। এ দিনই আর্জেন্তিনীয় পোপ ইয়র্গে মারিও বার্গোলিও জানিয়েছেন ভাটিকানে এক ব্রাজিলীয় কর্তা তাঁকে বলেছেন, বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনার জন্য একদম প্রার্থনা করবেন না। এত বৈরিতার মধ্যে কি প্রাক্ সেমিফাইনাল মৈত্রী সম্ভব? কে জানে।

বেলোর ফুলের দোকানে এত সাদা ফুল আজ উপচে পড়ছে কেন, তা-ও তো বুঝলাম না। কলকাতার ফুলের দোকানে পনেরো-কুড়িটা তোড়া দিনে বিক্রি হলেই দোকানি কাস্টমারকে হতাশ করে ফিরিয়ে দেয়। এ তো যা ফুল, এস্তাদিও মিনেইরোর সব গ্যালারি ভরিয়ে দেওয়া যাবে।

শহরের দোকানে এত সাদা ফুল কি ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দশমী অনুমানে? না বেলো মাঠে কাল সুখের অষ্টমী?

আজকের মতো কোনও উত্তর নেই!

brazil germany fifaworldcup world cup semifinal gautam bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy