Advertisement
E-Paper

মুলারদের যোগ্য সঙ্গতে গোলকিপারও

ম্যানুয়েল নয়্যার আগের ম্যাচে বিশ্বকাপ রেকর্ড করার পর গোটা ফুটবল বিশ্ব খুব আগ্রহের সঙ্গে মারাকানা ম্যাচের দিকে তাকিয়ে ছিল। রেকর্ড উন্নত হয়, না কাছাকাছি যায়? আলজিরিয়া ম্যাচে পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে বলে ২৭ স্ট্রোক করেছিলেন নয়্যার। গড়পড়তা ডিফেন্ডার যা গোটা ম্যাচে করে কি না সন্দেহ। ফুটবলে জার্মান গোলকিপার একটা বিবর্তনই নিয়ে এসেছেন। তাঁকে বলা হচ্ছে সুইপার-কিপার। শুক্রবার অবশ্য সুইপার খেলার সুযোগ পাননি। একটা ভূমিকাতেই ছিলেন আর তাতে দুরন্ত ভাবে থেকে নিজের দেশকে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল তুলে দিলেন।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৭
তেরো মিনিটেই গোল। জার্মানিকে সেমিফাইনালে তুললেন ম্যাট হুমেলস (ডান দিকে)। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জোয়াকিম লো-র দল জিতল ১-০ গোলে।  ছবি:  উৎপল সরকার

তেরো মিনিটেই গোল। জার্মানিকে সেমিফাইনালে তুললেন ম্যাট হুমেলস (ডান দিকে)। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জোয়াকিম লো-র দল জিতল ১-০ গোলে। ছবি: উৎপল সরকার

ম্যানুয়েল নয়্যার আগের ম্যাচে বিশ্বকাপ রেকর্ড করার পর গোটা ফুটবল বিশ্ব খুব আগ্রহের সঙ্গে মারাকানা ম্যাচের দিকে তাকিয়ে ছিল। রেকর্ড উন্নত হয়, না কাছাকাছি যায়?

আলজিরিয়া ম্যাচে পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে বলে ২৭ স্ট্রোক করেছিলেন নয়্যার। গড়পড়তা ডিফেন্ডার যা গোটা ম্যাচে করে কি না সন্দেহ। ফুটবলে জার্মান গোলকিপার একটা বিবর্তনই নিয়ে এসেছেন। তাঁকে বলা হচ্ছে সুইপার-কিপার। শুক্রবার অবশ্য সুইপার খেলার সুযোগ পাননি। একটা ভূমিকাতেই ছিলেন আর তাতে দুরন্ত ভাবে থেকে নিজের দেশকে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল তুলে দিলেন।

বত্রিশ বছর আগের এক জার্মান গোলকিপারের অতীত পাপকে জ্বালানির ইন্ধন করে বদলা নিতে এসেছিল ফ্রান্স। কিন্তু জার্মানির বর্তমান গোলরক্ষী সেই বদলা নিতে দিলেন না। একটা শেষ মিনিটে করিম বেঞ্জিমার শট আর একটা ম্যাথেউ ভ্যালবুয়েনার ভলি। দু’টি অব্যর্থ গোল বাঁচিয়ে ঐতিহাসিক বিশ্বযুদ্ধে নয়্যার জিতিয়ে দিলেন জার্মানিকে!

মেট্রোয় সকালে মাঠে আসার সময় অপ্রত্যাশিত চমক। মেট্রো স্টেশনের গায়ে গাঁধীজির বিশাল মূর্তি। রিওয় গাঁধী মূর্তির খবর কখনও পড়িনি। তার ওপর রাস্তাটাও দেখলাম গাঁধী প্লাজা। মেট্রোয় নেমে আর একপ্রস্ত চমক।

সমর্থকরা যা গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে তা হল:

ব্রাজিল তোমার সঙ্গে আছি

ব্রাজিল আমরা একটা দেশ

ব্রাজিল ওরা যা বলে বলুক

ব্রাজিল তুমি তো জানো হলুদ জার্সি মাহাত্ম্য

ব্রাজিল এটা আমার প্যাশন

ব্রাজিল এটা আমাদের প্যাশন

ব্রাজিল এটা আমাদের কাপ

ব্রাজিল টেনশন কোরো না

ব্রাজিল আমরা ঠিক হয়ে যাব।

ব্রাজিলের এক ফুটবল কবি গত পরশু নাকি গানটা লিখেছেন। এ বারের স্পনসররা সেটার পঁয়ত্রিশ হাজার লিফলেট ছাপিয়ে গোটা দেশে বিলি করছে। আর সব মেট্রো স্টেশন এখন সমস্বরে গাইছে। শুনলাম কলম্বিয়াও নাকি একটা গান তৈরি করেছে। প্রচণ্ড ভিড়ের মেট্রোয় কিছু পিঠে কলম্বিয়া লেখা সমর্থকও দেখছি। যদিও তাদের গাইতে শুনছি না সেই গানটা:

হামেস তুমি আমাদের সেরা

হামেস তুমি ইতিমধ্যেই নেইমারের সমান

হামেস তুমি পেলেরও সমান হবে

হামেস তুমি এ দিন পেলেকেও ছাপিয়ে যাবে

একটা জিনিস তখনও মাথায় ঢুকছে না। মারাকানায় তো হবে ফ্রান্স-জার্মানি। ব্রাজিলের খেলা শুরু প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বাদে অনেক দূরের ফোর্তালেজায়। তা হলে লোকে এই মেট্রোয় এত ব্রাজিল-ব্রাজিল করছে কেন? মাঠে ঢুকে বোঝা গেল, হয়তো ব্রাজিল দূর দেশ বলেই যথেষ্ট সংখ্যক ফ্রেঞ্চ বা জার্মানরা আসেননি।

জার্মানির অবশ্য তাতে কিছু আসে যায়নি। বিশ্বকাপে ‘চোকার’ বলে কুখ্যাতি আছে তাদের। কথিত আছে, তারা ফাইনাল হারে, কিন্তু নকআউট পর্বের এমন সব বড় ম্যাচে অন্য খেলা বের করে আনে। স্রেফ বড় ম্যাচ টেম্পারামেন্টে তারা খেলাটায় তফাত করে দিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সবচেয়ে ভাল বুঝবেন। ক’দিন আগে সালভাদরেও একই প্রেসক্রিপশন তিনি পেয়েছিলেন। পর্তুগাল ডিফেন্স যাচ্ছেতাই বলে চার গোল হয়েছিল। এখানে ফ্রান্স পাল্টা আক্রমণের ক্ষমতা রাখে বলে এক গোলে থেকে গেল। কিন্তু প্রেসক্রিপশন এক! বড় ম্যাচে সাদা জার্সিকে ছুঁতে যেও না!

তেরো মিনিটেই গোল। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের

বিরুদ্ধে জার্মানিকে এগিয়ে দিলেন ম্যাট হুমেলস। ছবি: এপি।

প্রথম দশ মিনিটের খেলা বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল, সাদা জার্সিতে কারা খেলছে? জোয়াকিম লোর জার্মানি না পেপ গুয়ার্দিওলার বায়ার্ন মিউনিখ?

ফুটবলে ঐতিহাসিক ভাবে বলা হয়ে এসেছে মাঝমাঠ যার, ম্যাচের মালিক সে। মেসি-নেইমারদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দৌরাত্ম্যে এ বারের বিশ্বকাপে সেই ইতিহাসের তাৎপর্য নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছে। আজকের মারাকানা ম্যাচে সেটা অবশ্যই হওয়ার কথা ছিল না।

আর হয়ওনি।

কিন্তু ফিলিপ লামেরা শুরু থেকে যে স্টাইলে মাঝমাঠ থেকে পেনিট্রেটিভ জোন অবধি খেলাটা নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা মোটেও সাবেকি জার্মান স্টাইল নয়। বায়ার্নের তিকিতাকা। টাক-টাক-টাক-টাক। নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পাসে মাঝমাঠ থেকে বিপক্ষকে ভাসান দিয়ে দেওয়া।

আজ দুপুর অবধি রিও ফুটবলমহল এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এটাই আলোচনা ছিল যে, ফ্রান্স বড় ম্যাচের আগেও কি অস্বাভাবিক রিল্যাক্সড! আর জার্মানি চোক করছে। নইলে জোয়াকিম লো ওই ভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে কখনও বলতে পারেন, “আমরা কাল জিতছি।” বোঝাই যাচ্ছে দেশ এবং জাতীয় মিডিয়ার চাপ আলজিরিয়া ম্যাচ পরবর্তী এমন অসহনীয় হয়ে উঠেছে যে, কোচকে চরিত্রবিরোধী কথা বলে দলের মনোবল তাগড়াই রাখতে হচ্ছে।

মাঠে ঠিক উল্টোটাই ঘটল। ওই যে শুরুর পনেরো মিনিটে জার্মানদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া মাঝমাঠ মডেল আর তারই মধ্যে ফ্রি-কিকে মাথা ছুঁইয়ে ম্যাট হুমেলসের গোল— ওটাই ঠিক করে দিল বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য। টনি শুমাখারকেও জার্মান টিভি স্টুডিও বিশেষজ্ঞ হিসেবে অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে পড়তে দিল না— বিরাশিতে আপনার বাতিস্তাকে মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়ার বদলা তা হলে নিয়ে নিল ফরাসিরা? আপনি কী বলেন?

অসম্ভব ট্যাকটিক্যাল একটা ম্যাচ হল। যার মধ্যে হয়তো কোনও আবেগের বাহার নেই। কোনও সুদৃশ্য ফুল ফুটছে না। ঝর্নার জল এসে ধুইয়ে দিচ্ছে না। কিন্তু এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলে সেরা দুই অঙ্কের চার্টের সংঘর্ষ! মাঝখান দিয়ে কেউ কোনও জায়গা বার করতে পারছে না। যা আক্রমণ তার নিরানব্বই ভাগ উইং থেকে ভেসে আসা নিচু ক্রসে।

ফ্রান্স গোল শোধের প্রাণপণ দায়ে ছিল বলে জার্মান স্টপারদের ওপর ঝড়ঝাপ্টাটা শেষ দিকে বেশি গেল। কিন্তু জার্মান ডিফেন্স যে টেম্পারামেন্টের জন্য বিশ্বযুদ্ধে বরাবর ভয়ঙ্কর, সেটাই অবিরাম দেখিয়ে গেল। নয়্যার এমন অসাধারণ গোল রক্ষার পরেও হুমেলস ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে গেলেন। কারণ তিনি জয়সূচক গোল ছাড়াও অনবদ্য সব ট্যাকল করেছেন।

তিনি আর নয়্যার যে সেমিফাইনালটাও বিপক্ষকে জ্বালাবেন বেশ বোঝা যাচ্ছে। এ দিন তাঁদের যৌথ নৈপুণ্যই শুমাখারকে নতুন করে স্পেন বিশ্বকাপের দগদগে ঘা প্রত্যাবর্তন থেকে রক্ষা করে গেল।

আর বাতিস্তা সে দিনকার সেই ফরাসি প্রতিপক্ষ তাঁকে রেখে দিল চার বছরের নতুন অপেক্ষায়। মধ্যিখানে ইউরোয় দেখা হতে পারে। কিন্তু ওটা তো ফুটবলের লড়াই, বিশ্বযুদ্ধ নয়। বিশ্বযুদ্ধে শুমাখারের পাগলামিতে এতগুলো দাঁত খুইয়েছিলেন বলেই তো এই সাতান্ন বছরেও বাতিস্তা বসেছিলেন প্রতিশোধের আগুন-সহ।

রাশিয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপের সময় তাঁর বয়স হবে একষট্টি। সে বার যদি ফ্রান্স পারে? নাকি সেমিফাইনালের আগে জার্মানদের খেললে ঐতিহাসিক বদলাটা হবেই না!

ম্যাচের সেরা

ম্যাটস হুমেলস

শেষ আটের লড়াইয়ে একার হাতেই ছিটকে দিলেন ফ্রান্সকে। ১৩ মিনিটে

সোয়াইনস্টাইগারের ফ্রি-কিক থেকে দুর্দান্ত হেডের সৌজন্যে হামেলস জার্মানিকে

১-০ এগিয়ে দেন। ঘরোয়া ফুটবলে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে দু’টো বুন্দেশলিগা

জিতেছেন। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ক্লাবকে ফাইনালে তুলতেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল।

fifaworldcup gautam bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy