Advertisement
E-Paper

রোগ সারা কঠিন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

তৃতীয় বিশ্বের গরিব পরিবারে সাত সন্তানের এক জন। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে যাকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অহরহ লড়তে হয়েছে। সেই লড়াইয়েই হয়তো প্রত্যাঘাতের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল কামড়। উরুগুয়ে তারকা লুই সুয়ারেজের প্রতিপক্ষকে কামড়ে দেওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে এমনই নানা তত্ত্ব নাড়াচাড়া করছেন বিশ্বের বিশিষ্ট ক্রীড়া-মনোবিদরা। তাঁরা একটা ব্যাপারে একমত যে, সুয়ারেজের কামড়ে দেওয়ার পিছনে কোনও পূর্ব পরিকল্পনা নেই। সবটাই মুহূর্তের আবেগের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০৩:১১
ঘটনার ঠিক পরে। কাঁধ চেপে চিয়েলিনি, দাঁত চেপে সুয়ারেজ।  ছবি: এপি।

ঘটনার ঠিক পরে। কাঁধ চেপে চিয়েলিনি, দাঁত চেপে সুয়ারেজ। ছবি: এপি।

তৃতীয় বিশ্বের গরিব পরিবারে সাত সন্তানের এক জন। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে যাকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অহরহ লড়তে হয়েছে। সেই লড়াইয়েই হয়তো প্রত্যাঘাতের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল কামড়।

উরুগুয়ে তারকা লুই সুয়ারেজের প্রতিপক্ষকে কামড়ে দেওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে এমনই নানা তত্ত্ব নাড়াচাড়া করছেন বিশ্বের বিশিষ্ট ক্রীড়া-মনোবিদরা। তাঁরা একটা ব্যাপারে একমত যে, সুয়ারেজের কামড়ে দেওয়ার পিছনে কোনও পূর্ব পরিকল্পনা নেই। সবটাই মুহূর্তের আবেগের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ। যখন তাঁর বোধকে পুরোপুরি চাপা দিয়ে দিচ্ছে একেবারে আদিম এক তাড়না। যাকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অড ইমোশনাল রিলিজ’ বা আবেগের বিকৃত বহিঃপ্রকাশ।

সুয়ারেজের এই আচরণ বদলানো সম্ভব কি? বিশেষজ্ঞ মহলে একাধিক মত রয়েছে। কেউ মনে করছেন, তারকা স্ট্রাইকার চেষ্টা করলে কামড়ে দেওয়ার বিদঘুটে অভ্যাসটা বদলে ফেলতে পারবেন, তবে প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ। অন্য মত হচ্ছে, যে হেতু কামড়ে দেওয়ার জন্য একাধিক বার শাস্তি পেয়েও সুয়ারেজ নিজেকে বদলাতে পারেননি, তাই ভবিষ্যতে তিনি আবার কামড়ে দিতেই পারেন। কামড়ানোটা তাঁর এমনই মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, প্রথম থেকে কাজটা অন্যায় বলে সুয়ারেজকে কেউ সম্ভবত থামানোর চেষ্টা করেনি। তাই কামড়ে দেওয়াটাকে তিনি অস্বাভাবিক বলে মনেই করেন না।

মঙ্গলবার ইতালি-উরুগুয়ে ম্যাচের পর ঠিক এটাই হয়েছিল। সুয়ারেজের আচরণের নিন্দা দূরে থাক, উরুগুয়ে অধিনায়ক দিয়েগো লুগানো উল্টে ইতালির জিওর্জিও চিয়েলিনির সমালোচনা করে বলেন, “ওই ভাবে কান্নাকাটি করে সুয়ারেজের নামে নালিশ করাটা ওকে মানায় না। এটা পুরুষমানুষের মতো কাজ হয়নি।” উরুগুয়ের কোচ অস্কার তাবারেজও নিজের স্ট্রাইকারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “সুয়ারেজের উপর অনেকেরই রাগ রয়েছে। সে জন্যই পুরনো ঘটনা টেনে এনে ওকে হেনস্থার চেষ্টা হচ্ছে।” খেলার শেষে স্বদেশের টিভি চ্যানেলে ঘটনা নিয়ে কথা বলার সময় সাতাশ বছরের স্ট্রাইকারের নিজের গলাতেও অনুশোচনা বা অপরাধ বোধের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

মাঠে চিয়েলিনির ঘাড়ে কামড়টা বসানোর পরেই সুয়ারেজ দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে বসে পড়েছিলেন। হিংস্র এবং সমাজ বিরোধী আচরণের বিশেষজ্ঞ, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপিকা ইভা কিমোনিসের কথায়, “ভিডিও ফুটেজে যা দেখলাম, হতাশা আর রাগ থেকেই কামড় বসায় সুয়ারেজ। তার পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজে আহত হওয়ার ভান করে।” ইভার মতে, হয় বিপদ এড়ানোর চেষ্টায়, না হলে দাপট দেখাতে বা অধিকার বোধ থেকে এই ধরনের আগ্রাসন তৈরি হয়। এমন আচরণের পূর্বমুহূর্তে সাধারণত তীব্র চাপ বা হতাশা থাকে। সুয়ারেজের কামড়ানোর এই প্রবণতার শিকড় অবশ্য আরও গভীরেও থাকতে পারে। ইভা বলেছেন, বাচ্চারা কামড়ায়। কিন্তু বড় হওয়ার পরেও কামড়ানোর ঘটনা খুবই বিরল। সে ক্ষেত্রে ওই আচরণের পিছনে ধারাবাহিক আগ্রাসন বা দুর্বব্যহারের ইতিহাস থাকতে পারে। “এই ধরনের লোকেরা কথায় কথায় মারপিট বা দাদাগিরি পছন্দ করে। এরা সাধারণত রগচটা আর হঠকারী হয়।”

সুয়ারেজের ক্ষেত্রে এর কতটা প্রযোজ্য, সেটা অবশ্য খতিয়ে দেখা জরুরি। তবে ইভার বিশ্বাস, সুয়ারেজের নিজেকে পাল্টানোর সদিচ্ছা থাকলে, মনোবিদদের সাহায্য ভবিষ্যতে কামড়ানোর ইচ্ছেটা সংবরণ করার কৌশল শিখে নিতে পারেন।

ব্রিটিশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ টম ফসেট আবার এতটা আশাবাদী নন। তিনি বলেছেন, “কামড়ানোটা ওর মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে। মনোবিদ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েকটা সেশনে এটা ওর চরিত্র থেকে ছেঁটে ফেলা যাবে না। ও আগেও কামড়েছে। ভবিষ্যতেও কামড়াবে।” গত বছর প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল বনাম চেলসি ম্যাচে চেলসির ফুটবলার ব্রানিসলাভ ইভানোভিচের হাতে কামড়ে দিয়েছিলেন সুয়ারেজ। ফসেট সে কথা মনে করিয়ে বলেছেন, “লিভারপুর ওকে লম্বা সময়ের জন্য মনোবিদের কাছে পুনর্বাসনে পাঠিয়েছিল। তার পরে ও সেরে গিয়েছে বলে দাবি করেছিল। কিন্তু রোগটা ফিরে এল।” ফসেটের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে চাপের মুখে ফের কামড়াবেন সুয়ারেজ।

এক কামড়ে। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

কলকাতার বিশিষ্ট মনোবিদ সুদীপ বসু বিষয়টা বোঝাতে গিয়ে বলছিলেন, দশ বছর বয়সেই মানুষের আবেগ প্রকাশের ধরনগুলো মোটামুটি ঠিক হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে বহিঃপ্রকাশটা একই থাকে। তবে আগ্রাসনকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেটা মানুষ ধীরে ধীরে শেখে। সুদীপবাবুর কথায়, মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব বা গুরু মস্তিষ্ক বোধ-বুদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। লোয়ার কর্টেক্স নিয়ন্ত্রণ করে তাৎক্ষণিক বা প্রাথমিক আবেগগুলো। সাধারণত তাৎক্ষণিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বোধ-বুদ্ধি। কিন্তু খেলাধুলোর সময় হরমোন ক্ষরণ বেড়ে গিয়ে আবেগটাই প্রধান হয়ে ওঠে। চরম পরিস্থিতিতে বোধকে গ্রাস করে আবেগ। সুয়ারেজ যখন কামড়াচ্ছেন, তখন তাঁকে পুরোপুরি চালনা করছে লোয়ার কর্টেক্স।

বস্টন বিশ্ববিদ্যায়ের ক্রীড়া-মনোবিদ অ্যাডাম নেলর এই ব্যাপারটার বৈপরীত্যটা বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, “তীব্র আবেগই খেলার মাঠে অসাধারণ সব পারফরম্যান্সের মূলে। কিন্তু এই আবেগের বশেই একেবারে নির্বোধের মতো আচরণও করে ফেলি। মজার কথা হল, চাপের মুখে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে নিজেকে সংযত রাখার কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায়।”

সুয়ারেজ নিজে যে তাঁর কামড়ানোর স্বভাবে গর্বিত, এমন নয়। ক’দিন আগে বলেছিলেন, “আমার এই ভাবমূর্তিটা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। আমি সত্যিই বদলাতে চাই। চাই না ইতিহাস আমাকে এর জন্য মনে রাখুক।”

কিন্তু মঙ্গলবারের পর সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসে তিনি পাকাপাকি ঢুকে গেলেন এই কামড়ের জন্যই!

fifaworldcup suarez
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy