Advertisement
E-Paper

সুন্দরী, পানশালা ও কোচ বনাম মেসি

বেলো হরাইজন্তে মানে কী? বিমানবন্দরের অভ্যর্থনা ডেস্কে কিছু হাসিখুশি মুখ। তাদের কারও কারও আবার গলায় ছোট ব্যাগ ঝুলছে— আই স্পিক ইংলিশ। তেমনই এক তরুণী উত্তর দিল, বেলো হরাইজন্তে মানে বিউটিফুল হরাইজন। বাংলায় অপরূপ দিগন্ত। শহরের দিকে কিছু দূর যেতে না যেতেই বোঝা গেল এটা আদতে শৈলশহর। দিগন্ত শোভার মধ্যে পাহাড়ের শ্রেণিটা ধরতেই হবে। কারণ চার দিকে পাহাড়। শহরটাকেই পাহাড়ই ঘিরে রেখেছে।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০৩:৪৭
এ বার প্রতিপক্ষ ইরান। সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই অনুশীলনে খোশমেজাজে মেসি। বেলো হরাইজন্তেতে উৎপল সরকারের তোলা ছবি।

এ বার প্রতিপক্ষ ইরান। সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই অনুশীলনে খোশমেজাজে মেসি। বেলো হরাইজন্তেতে উৎপল সরকারের তোলা ছবি।

বেলো হরাইজন্তে মানে কী? বিমানবন্দরের অভ্যর্থনা ডেস্কে কিছু হাসিখুশি মুখ। তাদের কারও কারও আবার গলায় ছোট ব্যাগ ঝুলছে— আই স্পিক ইংলিশ।

তেমনই এক তরুণী উত্তর দিল, বেলো হরাইজন্তে মানে বিউটিফুল হরাইজন। বাংলায় অপরূপ দিগন্ত। শহরের দিকে কিছু দূর যেতে না যেতেই বোঝা গেল এটা আদতে শৈলশহর। দিগন্ত শোভার মধ্যে পাহাড়ের শ্রেণিটা ধরতেই হবে। কারণ চার দিকে পাহাড়। শহরটাকেই পাহাড়ই ঘিরে রেখেছে।

কিন্তু বিচ? ব্রাজিলে সুদৃশ্য গিরিশৃঙ্গ তো বোঝা গেল। কিন্তু ভাই বিচ কোথায়? ব্রাজিল আবার ফুটবল, বিচ আর বিকিনি বাদ দিয়ে হয় নাকি?

বহু দিন বাদে এক ট্যাক্সিচালকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যাকে প্রশ্ন করতে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য লাগে না। ভাল ইংরেজি জানে।

সে বলল, বেলোর বিখ্যাত মন্তব্যটা জানেন না? তেমোস মার্মাস, তেমোস বার।

আমাদের বিচ নেই, আমাদের বার আছে!

ছেলেটি বলল, “স্টেডিয়াম যাওয়ার তাড়া না থাকলে আপনাকে স্ট্রেট বারে নিয়ে যেতাম। সকাল থেকে লোকে এখানে মদ খায় আর খুব এনজয় করে। বারে যে কত এনজয় করা যায়, ওখানে গেলে বুঝবেন। দু’একটা বার আছে স্যার, আপনি বেশি খেয়ে ফেললে আপনাকে রাত্তিরের জন্য রেখে দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে।”

ড্রাইভারকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই কারণ সে কি না ট্যুর গাইড হিসেবেও কাজ করে। এই শহর থেকেই উঠে এসেছেন টোস্টাও। এখনকার ব্রাজিল দলের রামিরেজ। গোটা ব্রাজিলের ঠিক এই মুহূর্তের চক্ষুশূল ফ্রেড। ফ্রেডও অনেক বছর নাকি এই শহরে কাটিয়েছেন। দু’টো বড় ফুটবল ক্লাব আছে শহরে। ফুটবল-সংস্কৃতি যথেষ্ট উচ্চমার্গের।

কিন্তু বেলো হরাইজন্তের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নাকি তার মহিলায়। চালক খুব গর্বের সঙ্গে বলল, “সারা ব্রাজিলের মধ্যে আমাদের এখানকার মেয়েরা সবচেয়ে সুন্দরী। রিওয় যত মডেল আর ব্রাজিলিয়ান অভিনেত্রী দেখবেন, মনে রাখবেন তার বেশির ভাগই বেলো সাপ্লাই দিয়েছে।”

কালকেই নেটে পড়ছিলাম ইরান কোচ বলেছেন, “শনিবারের আর্জেন্তিনা ম্যাচ হল ইরানের ফুটবল ইতিহাসের বৃহত্তর দিন।” তা চির-রক্ষণশীল, পর্দানসীন ইরান কি না তার ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক দিন এমন একটা শহরে এসে পাচ্ছে, যেখানে উদ্দাম পানশালা আর বাছাই করা সেরা সুন্দরী!

কোথায় কি একটু ধাক্কা লাগে? সেটার মাত্রা আরও বেড়ে যাবে স্টেডিয়ামের ভেতর আর্জেন্তিনার প্রেস কনফারেন্সে ঢুকলে। আর্জেন্তিনীয় কোচ সেখানে হাজির— আলেসান্দ্রো সাবেয়া। ম্যাচের আগের দিন এ সব প্রেস কনফারেন্স কী হবে, চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। বিপক্ষ নিয়ে প্রশ্ন হবে। আর সাবেয়ার মতো হুঁশিয়ার, সতর্ক মানুষ পরের পর পলিটিক্যালি কারেক্ট উত্তর দেবেন। বিপক্ষ যত না ভাল তার চেয়ে বেশি নম্বর দেবেন। নিজেদের সম্ভাবনা নিয়ে কাছা খুলে কিছু বলবেন না। এ তো কলকাতায় এবিপি অফিসে বসেই বলে দেওয়া যায়, এস্তাদিও মিনেরোর কনফারেন্স রুমে কী ঘটছে!

আধ ঘণ্টার সাংবাদিক সম্মেলন। সেখানে বেশির ভাগই আর্জেন্তিনীয় সাংবাদিক। তাঁরা দেশজ কোচকে যে ভঙ্গিতে পরপর আক্রমণাত্মক প্রশ্নে বিঁধলেন, তা ভিডিও করে সবার আগে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে দেখানো উচিত! যে, ভারতীয় ক্রিকেট মিডিয়া এখনও কত সভ্যভব্য।

ইরান নিয়ে প্রশ্ন মাত্র একটা। মনে হল আর্জেন্তিনা কালকে মাকড়দহ স্পোর্টিং বা পূর্ব পুঁটিয়ারি সম্মিলিত একাদশের সঙ্গে খেলছে। পুরোটাই, কোচ আপনার সঙ্গে কি মেসির ঝগড়া লেগেছে? দলে কি আপনার কথা আর প্রথম ও শেষ কথা নয়? এই সব প্রশ্ন।

ধোনি হলে পুরো মরসুমটাই নির্ঘাত প্রেস বয়কট করতেন। সাবেয়ার অনন্ত ধৈর্য। ফেরার সময় আবার সেই সাংবাদিকদের অনুরোধেই ছবির জন্য মিনিট পাঁচেক পোজ দিলেন।

আর্জেন্তিনা প্র‌্যাকটিসে মেসি। শুক্রবার। ছবি: উৎপল সরকার

অপরূপ দিগন্তশোভার এই শহরের পাশেই আর্জেন্তিনার ঘাঁটি। যাকে বলে, বেসক্যাম্প। আর সেখানে নাকি টিমের অন্তর্লীন সৌন্দর্যটা মোটেও অপরূপ যাচ্ছে না। কোন সিস্টেমে খেলা হবে তা নিয়ে তীব্র খটাখটি লেগেছে ক্যাপ্টেন আর কোচের। কোচ বসনিয়া ম্যাচে শুরু করেছিলেন পাঁচ ডিফেন্ডার নিয়ে। ৫-৩-২ ছকে। সেটা নাকি মেসির একেবারেই পছন্দ হয়নি। এই ছকে তিনি একেবারে একা হয়ে যাচ্ছিলেন। বল পাচ্ছিলেন না। বিরতির পর আর্জেন্তিনা সামনে লোক বাড়ায়। মেসিও গোল পান।

ফুটবলের সুপার-পাওয়াররা ইরানের মতো প্রতিপক্ষ পেলে, সামনে আরও লোক এনে গোল বাড়িয়ে রাখবে তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু মেসি যেহেতু দু’দিন আগে মিডিয়াকে বলেছেন আর্জেন্তিনার যে কোনও অবস্থাতেই ৪-৩-৩ খেলা উচিত, তীব্র জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে যে, তিনি কোচের ওপর খবরদারি করছেন। কাল প্র‌্যাকটিসে কোচ যে টিম খেলিয়েছেন, তাতে সামনে আর্জেন্তিনার সেই বিখ্যাত ফ্যাব ফোর। আগেরো, ইগুয়াইন, মেসি এবং পেছনে ডান দিক থেকে আক্রমণে অংশ নেওয়া দি’মারিয়া।

গোটাটাই নাকি মেসি-বিপ্লব। কোচের ভিতু-ভিতু রক্ষণাত্মক স্ট্র‌্যাটেজি তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। সাবেয়া এই অভিযোগগুলো শুনে বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “হতেই পারে লিওর সেটা মতামত। আমাদের টিমে সবার স্বাধীন ভাবে কথা বলার অধিকার আছে। আর সেই অধিকারটা আমি দিয়েছি। মেসিকে প্রেসের কাছে তো আমিই পাঠিয়েছি।”

সাবেয়া এর পর সবিস্তারে বললেন, মেসির বিপরীতধর্মী মন্তব্যে তিনি এতটুকু আহত নন। তাঁরা পরস্পরকে যথেষ্ট সম্মান করেন। আর সেই সম্পর্কে এতটুকু চিড় ধরেনি। এর পর আর্জেন্তাইন কোচ বললেন, তাঁর নিজের ধারণা বসনিয়া ম্যাচে প্রথমার্ধে মাত্র এক গোলে এগোলেও আর্জেন্তিনা যথেষ্ট ভালই খেলেছে। সব সময় স্কোরবোর্ডটাই আসল নয়।

বোঝা গেল, এই জায়গাটায় অধিনায়ক আর তাঁর বক্তব্যের ভিন্নতা থেকেই গেল। যদিও তা থেকে মতান্তর সত্যিই হয়েছে কি না, বোঝার উপায় নেই। শনিবার আর্জেন্তিনা যে ৪-৩-৩ খেলছে, সেটা কোচ আজই জানিয়ে দিলেন। এটাও আশ্চর্য। যাঁকে প্রথম দিন থেকে কোনও কিছু ফাঁস করতে না চাওয়া, সতর্ক এবং ঝানু পেশাদার হিসেবে দেখছি, তিনি ম্যাচের আগের দিন কোন ছকে খেলবেন তা উপুড় করে দিচ্ছেন।

এটা কি গৃহযুদ্ধের সম্ভাব্য দাবানলে জল ঢেলে মেসিকে শান্ত করতে চাওয়া?

মেসির এমন একটা দেবদূত সদৃশ ভাবমূর্তি আছে যে, তিনি কোচের পেছনে লাগবেন। তাঁকে গুরুত্বহীন করে দেবেন, এটা ঠিক ভাবাই যায় না। যদিও বার্সা ক্যাম্প থেকে খবর বেরিয়েছিল যে, তিনি নাকি তখনকার কোচ গুয়ার্দিওলাকে প্রকাশ্য অপমান করেছিলেন।

ইরান ম্যাচের আগে মেসি। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

লা লিগা ম্যাচের আগে মেসি নাকি সফ্ট ড্রিঙ্ক চেয়েছিলেন। কোচ চেঁচিয়ে বলে দেন, ম্যাচের তিন ঘণ্টা আগে-পরে তোমরা কেউ সফ্ট ড্রিঙ্ক খেও না। পরের দৃশ্য এ রকম যে, একটা কোকের বট্ল নিয়ে এসে পা ছড়িয়ে সবার সামনে মেসি খাওয়া শুরু করেন। অপমানিত কোচ কিছুই বলতে পারেননি। বাসার্রই এক প্লেয়ার পরে ঘটনাটা বলে মন্তব্য করেছিলেন, “দেবদূত দেখায় মানেই ওরা ঈশ্বরতুল্য নয়।” ওরা বহুবচন কিন্তু এখানে বুঝতে হবে একবচন, তা হৃদয়ঙ্গম করতে কারও অসুবিধে হয়নি।

কিন্তু সত্যি যদি আর্জেন্তিনীয় ক্যাম্পে হালকা গৃহযুদ্ধের রেশ থাকে, তার সুযোগ নিতে পারবে ইরান? এশীয় দেশগুলোর মধ্যে যারা বিশ্বকাপ খেলছে, সেই তালিকায় ইরানই এক নম্বর। ইরানের র‌্যাঙ্কিং ৩৭। জাপান ৪৭। কোরিয়া ৫৫। বিশ্বকাপ প্রস্তুতি পর্বে ইরান সবচেয়ে ভাল খেলেছে। শতকরা তিরিশ ভাগ গোল সেট পিস থেকে করলেও বিশেষত্ব দেখিয়েছে মজবুত ডিফেন্স। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দ্রুতগামী নাইজিরিয়ান ফরোয়ার্ডদেরও ইরানি ডিফেন্স গোল করতে দেয়নি।

আর্জেন্তিনা ফরোয়ার্ড লাইন যদিও অন্য গ্রহের বস্তু হবে! তা ছাড়া ইরান অর্থনৈতিক সমস্যা আর দেশের টালমাটাল পরিস্থিতিতে এমনই বিপন্ন যে, টাকার অভাবে টিমের জন্য ফ্রেন্ডলি ম্যাচ পর্যন্ত ব্রাজিলে আয়োজন করতে পারেনি। তাদের বিশ্বকাপ ইতিহাস দূরতম কল্পনাতেও গর্বের মিনার নয়। তিনটে বিশ্বকাপ খেলে একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারানো ছাড়া তেহরান গর্বিত করার কিছু ঘটেনি।

আর খেলাটা যতই ব্রাজিলে হোক, কার্যত হচ্ছে বুয়েনস আইরেসে। ব্রাজিলের আর সব শহরের মধ্যে বেলোতেই সবচেয়ে বেশি আর্জেন্তিনীয় থাকেন। আর দেশ থেকে তো বিশ্বকাপ দেখতে আসা পর্যটক আছেই। শুনলাম মাঠে সাতাশ হাজার আর্জেন্তিনীয় থাকবে। সাতাশ, পঁচিশ না তিরিশ, কোনওটাতেই কিছু আসে যায় না। মোদ্দা কথা হল, দিনের শেষে এটা মেসিদের হোম ম্যাচ!

ইরানের সম্মান কুড়োনো ছাড়া ম্যাচে আরও কিছু করার থাকলে সেটা বিশ্বকাপের অন্যতম চমক হবে। কিন্তু ইরান, ইরান বারবার এখানে বসে শুনতে শুনতে, সাংবাদিক সম্মেলন ফার্সিতে অনুদিত হচ্ছে দেখে কোথাও যেন ভারতীয় সাংবাদিকের বিষণ্ণতাটা থেকেই যায়! তার বারবার মনে হতে থাকে, এই ইরানকেই তো বিরাশি-তিরাশি সালেও ভারত নিয়মিত হারিয়েছে, তারা আজ মেসির সামনে চলে গেল আর ভারত কি না ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৪৭।

ঠিক ওই সময়টাতেই বেলো হরাইজন্তের অপরূপ দিগন্ত, একগুচ্ছ পানশালা, সুন্দরী মহিলা আর মেসি ছাড়িয়ে ভারত সমর্থক অন্য একটা উপত্যকায় পৌঁছে যায়।

ফুটবল-দুঃখের উপত্যকা!

fifaworldcup gautam bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy