Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
State news

পুরুলিয়ার জঙ্গলে পাখি থেকে হরিণ খেয়ে সাফ, সৌজন্যে নাগা পুলিশ

মদনটাক বা লেসার অ্যাডজুটান্ট স্টর্ক। শিকার করে ফিরছে নাগা বাহিনী — নিজস্ব চিত্র।

মদনটাক বা লেসার অ্যাডজুটান্ট স্টর্ক। শিকার করে ফিরছে নাগা বাহিনী — নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৮ ১৮:১৯
Share: Save:

অভিযোগটা দীর্ঘ দিনের। সেই ২০০৯-১০ সালের, যখন পুরুলিয়াতে মাওবাদী অভিযানের জন্য নাগা বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে বাঘমুন্ডি হোক বা শিরকাবাদ, যেখানেই নাগা বাহিনীর ক্যাম্প, সেখানেই একটাই অভিযোগ— নাগা জওয়ানরা আশেপাশের সব ধরনের পশু-পাখি সুযোগ পেলেই মেরে উদরস্থ করছেন। শুধু জঙ্গলের ময়ূর-হরিণ নয়, গ্রামের কুকুর-বেড়ালও সুযোগ পেলেই হাপিস করে দিচ্ছেন এই জওয়ানরা। কিন্তু এত দিন অভিযোগ জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি। কারণ অভিযোগকারী গ্রামবাসীরা খুব জোরাল কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি অভিযোগের স্বপক্ষে।

স্থানীয় প্রশাসনও খুব একটা ঘাঁটাতে চায় না এঁদের। তাই গত কয়েক বছর ধরে বিনা বাধাতেই অযোধ্যা পাহাড়ের বুকে এয়ারগান বা গুলতি নিয়ে শিকার চালিয়ে যাচ্ছেন এই নাগা পুলিশ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এঁদের শিকারের দাপটে জঙ্গলের প্রাণী প্রায় সব সাফ।

শেষ পর্যন্ত এই কীর্তিকলাপের প্রমাণ পেতে, এ বছরই উদ্যোগী হয় স্থানীয় একটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠন। তাদের ব্যবস্থাপনাতেই অযোধ্যা লাগোয়া কয়েকটি গ্রামের যুবকরা লুকিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন এই নাগা বাহিনীর শিকারের।

সেই ভিডিয়োতেই দেখা যাচ্ছে, হাতে এয়ারগান নিয়ে বাঘমুণ্ডির ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের উপর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন থান্ডারিং থার্টিস ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা। তাঁদের টার্গেট গ্রে হর্ণবিল বা ধূসর ধনেশ পাখি। ঘন জঙ্গলে সেই ধনেশ পাখির দিকে অব্যর্থ লক্ষ্যে তাঁরা এয়ারগান চালাচ্ছেন। শুধু বনের মধ্যেই নয়, ক্যাম্পের পাশে গাছে বসা পাখিও জওয়ানদের গুলিতে মারা পড়ছে।

আরও পড়ুন: ফেসবুক লাইভ করে আত্মঘাতী ছাত্রী, সোনারপুরে

রাতের অন্ধকারে বিপন্ন প্রজাতির পাখি শিকার নাগা পুলিশের — নিজস্ব চিত্র।

পরিবেশ প্রেমী সংগঠনটির সদস্য অনির্বাণ পাত্র বলেন, “ওই ভিডিয়ো আমরা ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার রামপ্রসাদ বাদানার কাছে দেখাই। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে নাগা বাহিনীর এই শিকার তিনি বন্ধ করবেন। কিন্তু বাস্তবে সেই শিকার আদৌ বন্ধ হয়নি।”

শুধু বন দফতর নয়, এপ্রিলে এই ভিডিয়ো দেখানো হয় পুরুলিয়া জেলার তত্কালীন পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাসকেও। অনির্বাণের দাবি, “পুলিশ সুপার নিজে বলেছিলেন যে তিনি নাগা বাহিনীর এই শিকার বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয়নি।”

বাঘমুণ্ডির জঙ্গলে এয়ারগান হাতে শিকারের খোঁজে নাগা জওয়ান — নিজস্ব চিত্র।

নাগারা যে শিকার চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ মেলে গত শনিবারও। পুরুলিয়া শহরেই থাকেন রাধা বিশ্বাস। নিজের ট্রাভেলসের ছোটখাট ব্যবসা। শনিবার সকালে ফেসবুক খুলতেই তাজ্জব হয়ে যান তিনি। দেখেন, তাঁরই এক ফেসবুক ফ্রেন্ড জেমস মুর্মু ফেসবুকে বেশ কিছু ছবি আপলোড করেছে। রাধা বলেন, “জেমসের আপলোড করা ছবিতে দেখি নাগা জওয়ানদের হাতে অনেকগুলো মৃত লেসার অ্যাডজুটান্ট স্টর্ক। বাংলায় এর নাম মদনটাক। এই পাখি বিপন্ন প্রজাতির। এর শিকার করা অপরাধ। সেই পাখিই নির্বিচারে শিকার করে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পে ফিরছে নাগা জওয়ানরা।”

ঘটনার গুরুত্ব বুঝে, সঙ্গে সঙ্গে জেমসের পোস্টের স্ক্রিন শট নিয়ে রাখেন তিনি। রাজ্য বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বোর্ডের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য জয়দীপ কুণ্ডু স্বীকার করেন ঘটনার সত্যতা। তিনি বলেন, “এটা পুরুলিয়াতে একটা সমস্যা। আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি এই সমস্যা সমাধান করার।” জয়দীপ বলেন, “ধনেশ হোক বা মদনটাক, এগুলি শিকার করা মারাত্মক অপরাধ।”

আরও পড়ুন: বিবাদের মূলে ‘মক্ষিরানি’, মত্ত বন্ধুকে জলে ফেলে খুন

দেখুন ভিডিয়ো

পরে জানা যায়, অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে শিরকাবাদ ক্যাম্পের নাগা জওয়ানদের কীর্তি এটা। জেমস প্রায়ই এদের সঙ্গে শিকারে যান। অয়ন মণ্ডল, অন্য এক পরিবেশ প্রেমী, জানিয়েছেন, “এই বিষয়টিও প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।” বন দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিকের দাবি, “রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা হস্তক্ষেপ না করলে এদের শিকার বন্ধ করা অসম্ভব।” ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার রামপ্রসাদ বাদানা বলেন, ‘‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। আমরা জেলার পুলিশ সুপারকেও জানিয়েছি। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নাগা বাহিনীর দাবি এই ছবিগুলি গত বছরের। ছবিতে যাঁদের দেখা যাচ্ছে,তাঁদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশাবাদী এই শিকার বন্ধ করার ব্যপারে।’’

বন দফতর রিপোর্ট পেলে তারপর আমরা খতিয়ে দেখব। তারপর আমরা ব্যবস্থা নেব। জানিয়েছেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার, আকাশ মাঘারিয়া।

মাওবাদী উপদ্রব বন্ধ হওয়ার পর পর্যটকের ঢল নেমেছে অযোধ্যা পাহাড়ের বুকে। আর স্থানীয়দের আক্ষেপ, “পর্যটনের স্বার্থে আদিবাসীরাও শিকার উৎসব বন্ধ করে দিয়েছে এখানে। কিন্তু নাগারা পাখি থেকে শুরু করে সুযোগ পেলে হরিণ-ভালুকও মেরে দেয়। পর্যটকরা এর পর এসে ময়ূরও দেখতে পাবেন না অযোধ্যার জঙ্গলে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE