Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অমৃতিপাক গোলকধাঁধা স্বামীভুলানো বিএ পাশ

এই সবই সে কালের বাংলার বিচিত্র সব খোঁপার নাম। বাংলার মেয়েদের কেশসজ্জার বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে কৃৃত্তিবাসী রামায়ণ হয়ে মঙ্গলকাব্যেও। প্রিন্স আলবার্ট, সম্রাট নেপোলিয়নও প্রভাবিত করেছেন বঙ্গনারীর চুলের ফ্যাশনকে। বাংলার মেয়েদের কেশসজ্জার বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে কৃৃত্তিবাসী রামায়ণ হয়ে মঙ্গলকাব্যেও।

কবরী: যতীন্দ্রকুমার সেনের লেখা ও ছবিতে খোঁপার বাহার

কবরী: যতীন্দ্রকুমার সেনের লেখা ও ছবিতে খোঁপার বাহার

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

দুটো অচেনা শব্দ— ‘কূরীর’ ও ‘কুম্ব’। খোঁপার নাম। বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল এই দুটি খোঁপা। আজানুলম্বিত কৃষ্ণবর্ণ কেশরাশির সৌন্দর্যে বঙ্গললনারা যে এক চুল পিছিয়ে ছিল না তার প্রমাণ বিস্তর। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বঙ্গনারীর বিবরণে বলা হচ্ছে, “তাদের মাথায় কুঞ্চিত কেশ, বেণীর শেষাংশ শিখার মত মুক্ত।” ১০০০ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালেখ পাওয়া গেছে মালব এলাকায়। আনন্দবাজার পত্রিকার ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের বার্ষিক সংখ্যায় সুকুমার সেন গৌড়ীয় সুন্দরীর প্রশস্তিমূলক এই লিখনের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকটি পঙ্‌ক্তি এই রকম: “তেড়া-বাঁধা কেশ যা সুন্দর–/ খোঁপার উপরে খোপনা কেমন? রাহুর ত্রাসে রবি যেমন।”

মালবের ‘ধার’ অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রত্ন-শিলালেখে আছে মেয়ে-বিক্রির হাটের বিবরণ। দাক্ষিণাত্য, কর্ণাট, গুজরাট থেকে ব্যবসায়ীরা গেছে বিক্রয়যোগ্য মেয়ে নিয়ে, বঙ্গ-ব্যবসায়ীও তার ‘পণ্য’ নিয়ে উপস্থিত। অভিজাত সমাজের পুরুষরা তাদের কিনত ভোগ্যা ও পরিচারিকা হিসেবে। হাটে ব্যবসায়ীরা স্বদেশের সাজে-পোশাকে সজ্জিতা নিজের পণ্যের রূপ বর্ণনা করছে ক্রেতার কাছে। শিলালেখে আছে সাত বক্তার কথা, তারা এসেছে সাতটি দেশ থেকে, কথাও বলছে সাতটি অঞ্চলের ভাষায়— গোল্ল, কানোড়, টেল্ল, টক্কী, গৌড়ী, মালবী ও ব্রজভাখায়। বঙ্গদেশ থেকে আগত ‘গৌড়ী’ভাষী বিক্রেতা বর্ণনা করছে: ‘মেয়েটির চুড়ো-বাঁধা খোঁপা, তাতে ছোট ছোট তারার মত ফুল।’

‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থেও এক নাম-না-জানা কবি বাঙালি মেয়ের কেশসজ্জার রূপমুগ্ধ বিবরণ দিয়েছেন। সুকুমার সেনের অনুবাদে সেই মুগ্ধতার আভা: “সেই মেয়েটির মাথার উপরে গন্ধতৈল-সিক্ত, কেশজাল মসৃণ করে আঁচড়ানো এবং চূড়ার মতো খোঁপা বাঁধা, তাতে ফুলের মালা জড়ানো।’’

উদাহরণ ছড়িয়ে আছে মধ্যযুগের বঙ্গদেশেও। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার ‘ঘন কেশপাশ যেমন চামর’, আর মঙ্গলকাব্যের কবি লহনার কেশসজ্জার বিবরণে লিখছেন, ‘আঁচড়িল কেশপাশ নানা পরবন্ধে।/ তৈলযুত হয়ে পড়ে লহনার স্কন্ধে।।/ কবরী বান্ধিল রামা নাম গুয়ামুটি।/ দর্পণে নিহালি দেখে যেন গুয়াগুটি।।’ অষ্টাদশ শতকে কবি নওয়াজিস খানের বর্ণনায় বিয়ের অনুষ্ঠানে কনে সাজানোর দৃশ্যে অনিবার্য ভাবে আসে কেশসজ্জার কথা, তাতেও খোঁপারই জয়ধ্বনি, “প্রথমে কোড়াই কেশ দিয়া চর্তুসম।/ বান্ধিল পাটের জাদে খোপা মনোরম।।/ তাহাতে মুকুতা ছড়া করিল শোভন।/ চন্দ্রিমা উদিত যেন বিদরিয়া ঘন।।” অর্থাৎ, প্রথমে চুল আঁচড়ে পাটের জাল দিয়ে খোঁপা বাঁধা হল, তাতে পরানো হল মুক্তোর মালা। কালো মেঘের মধ্য থেকে যেন উঁকি মারছে চাঁদ। আর এক কবি শুকুর মামুদ লক্ষ করেছেন বারবণিতার অঙ্গসজ্জা, নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না মেয়েটির কেশসজ্জা: “গন্ধ পুষ্প তৈল বেশ্যা পরিল মাথাতে।/ সুবর্ণের জাদ বেশ্যা পরিল খোপাতে।” ভারতচন্দ্র রায় আবার বেণীর গুণমুগ্ধ: ‘বিননিয়া বিনোদিণী বেণীর শোভায়।/ সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়।।’

১৮৯১ সালে সাজাদপুরের ঘাটে নৌকায় বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। খেয়াল করেছেন অনেক মেয়ের ভিড়ের মধ্যে একটি ‘অন্যরকম’ মেয়েকে। ‘ছিন্নপত্র’-তে আছে তার কথা, “বোধহয় বয়স বারো-তেরো হবে।… বেশ কালো অথচ বেশ দেখতে। ছেলেদের মত চুল ছাঁটা, তাতে মুখটি বেশ দেখাচ্ছে।” তবে এই কিশোরীর ছাঁটা-চুল যে নিতান্তই ব্যতিক্রম তার প্রমাণ বঙ্কিম-ভবানীচরণ, এমনকি রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের নায়িকারাই। কপালকুণ্ডলার কথা ভেবে দেখুন, কিংবা ‘দুর্গেশনন্দিনী’র তিলোত্তমার কথা। তিলোত্তমার কেশবর্ণনায় বঙ্কিম লেখেন, “অতি নিবিড় বর্ণ কুঞ্চিতালক সকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংশে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে।” আবার, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাচীনা নবীনাকে বলছেন, “দেখ কলিকাতার রাড় মহলে হিন্দু বিবিরা মুছলমানীর চলন বলন সকল ধরিয়াছে, তাহারা আপন২ পছন্দ মত চুল কাটিয়া জুলপী বাহির করেন…।”

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে একটা ছড়ার চল হয়েছিল। নাতনির চুল বাঁধতে বাঁধতে ঠানদিদি ছড়া কাটতেন: “পদ্মফুলে ভোমরা ভোলে,/ ওলো, খোঁপায় ভোলে বর,/ নাতনি লো, তোর খোঁপা দেখে/ হবে, সতীন জরজর।” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, একাধিক সতিনের সংসারে স্বামীকে কাছে টানার প্রধান অস্ত্র খোঁপা, সরলার্থে কেশবিন্যাস। আরও একটা ছড়া এখনও শোনা যায়: “বড়লোকের বেটি লো/ তোর লম্বা লম্বা চুল,/ এমন খোঁপা বেঁধে দিব/ লক্ষ টাকা মূল।” উনিশ শতকের শেষার্ধেও জনপ্রিয় ছিল এই ছড়া: “হাতের শাখা ধবধবে বেশ,/ ঝুমকো ঢেঁড়ী দুল্ দুলে/ সিঁথেয় সিঁদুর, কাজল চোখে,/ খয়ের গোলা টিপ জ্বলে।”

কাজল চোখ আর ঝুমকো ‘ঢেঁড়ী-দোলানো’ ফ্যাশন জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করলে বাঙালি মেয়েরা প্রথমে ‘হাফ অ্যালবার্ট’, শেষে ‘ফুল অ্যালবার্ট’ ফ্যাশনে আবির্ভূতা হলেন। এই ফ্যাশনের উৎস তদানীন্তন প্রিন্স আলবার্ট। যুবরাজের টেরির নমুনা মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে ‘শিরোধার্য’ করেছিলেন। যতীন্দ্রকুমার সেন লিখছেন: ‘অ্যালবার্ট’ বহুদিন দোর্দণ্ডপ্রতাপে ইঁহাদের সীমন্তে রাজত্ব করিয়া যখন নামিলেন, তখন ‘নেপোলিয়ন’ আসিয়া তাহার স্থান অধিকার করিলেন। …কেন যে বিশ্ববিশ্রুত ফরাসী সম্রাটের নামে এই ফ্যাশনের নামকরণ হইল তাহা বলা কঠিন— রমণীরাই ইহা জানেন।’

ছিল ‘পাতা কাটা’ কেশবাহারও। ‘দশী’ হইতে ‘পঁচিশী’ এবং তদূর্ধ্ব বয়সের নারীর মাথায় ‘পাতা’ শোভা পেত— কপালটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যেত। কোথাও কোথাও এই ফ্যাশনকে বলা হত ‘আলতা পাতা’। কেউ কেউ বলেন, এক ধরনের আলুর পাতায় ঢেউ-খেলানো ধার দেখেই মেয়েরা চুলে এই ‘পাতা’র সৃষ্টি করেছেন। পাঁচ-থাক (ধাপ) পাতা কাটাতেই নাকি সবচেয়ে বেশি বাহাদুরি ছিল। এমনটাও পাওয়া যাচ্ছে: ‘কোনও কোনও ফ্যাশনেবল ভাবিনী আড়াপাতা কাটিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এ ফ্যাশনের সবই বাঁকা— কাপড় পরিবার ধরণটি পর্যন্ত।’

সব মেয়েরই যে এই ‘পাতা’ বা ‘নেপোলিয়ন’ পছন্দ ছিল, ভাবলে ভুল হবে। মার্জিতরুচি আধুনিকাদের “বাঁকা সীঁথি, সযত্নকৃত আলুথালু চুলে এলো খোঁপা, চোখে ফেয়ারি ‘পাঁসনে’ (Pince nez) চশমা এবং কদাচিৎ মুখে একটি আঙুল— এই হাল-ফ্যাশনের অঙ্গ,’ জানাচ্ছেন যতীন্দ্র সেন।

সাবেক বাংলায় খোঁপার নাম এ রকম— পান, টালি, স্বামীভুলানো, চ্যাটাই, চ্যাটাদর্মা, চ্যাটাপটি, গোলাপতোড়, অমৃতিপাক, লোটন, ল্যাজবিনুনি, খেজুরছড়ি, বিএ পাশ, হেঁটোভাঙ্গা, আতা, আঁটাসাঁটা, ডায়মন কাটা, ফুলঝাঁপা, এলোকেশী, বিনোদবেণী, ঝাপটা, ঝুঁট, বিছে, পৈঁচেফাঁস, জোড় কল্কা, বেহারী ফাঁসি, ধামা, মাতঙ্গিনী, কলকে ফুল, লাটিম, প্রজাপতি, সইয়ের বাগান, উকিলের কানে কলম, বাবুর বাগানের ফটক খোলা ইত্যাদি। সেকালে উলা, গুপ্তিপাড়া ও শান্তিপুর খোঁপার জন্য বিখ্যাত ছিল। কারও মতে বাঘনাপাড়ার মেয়েরাই খোঁপা বাঁধায় ছিল সেরা। এই দ্বন্দ্ব নিয়েও ছড়া আছে: ‘উলার মেয়ের কলকলানি,/ শান্তিপুরের চোপা,/ গুপ্তিপাড়ার হাতনাড়া, আর/ বাঘনাপাড়ার খোঁপা।’ অনেক সময় খোঁপা বাঁধা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত।

‘এইচ বোস এন্ড কোম্পানি’র ‘কুন্তলীন’ ও ‘ক্যাষ্টারিন’ কেশ-তৈলের অভিনব বিজ্ঞাপন বেরোত পত্রপত্রিকায়। ‘ক্যাষ্টারিন’ তেলের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত, ‘কেশের জন্য বিজ্ঞান-সম্মত বিশুদ্ধ সুগন্ধি ক্যাষ্টর-অয়েল।’ একটি বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘পতিব্রতা পত্নীর পত্র’। প্রবাসী স্বামীর প্রতি পত্নীর চিঠি— ২৮ পঙ্‌ক্তিতে, পয়ার ছন্দে লেখা। আশ্বিন মাস সমাগত, তাও পতিদেবতার বাড়ি ফেরার লক্ষণ নেই। অন্য স্বামীরা কত বউ-সোহাগী, কিন্তু তার কপালে জুটেছে ‘যমেও না-ভোলা’ এক উদাসীন, সংসারবিমুখ স্বামী। তাই পত্নীটি লিখছেন: “ওরে ড্যাকরা অলপ্পেয়ে বাড়ী আসবি কবে?/ মুড়ো ঝ্যাঁটা নিয়ে কিরে পথ চাইতে হবে?/…তেল অভাবে রুক্ষ চুল অর্দ্ধেক গেছে পেকে;/ ঔষধ বিনে ওরে ড্যাকরা ঘিরলো মাথা টাকে।/... কুন্তলীন তেলটা নাকি ভাল সবার চেয়ে,/ ভাল চাও তো তাই আনবে দো-মনা না হ’য়ে।’

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি ললনারা পুরনো ও নতুন যে খোঁপাগুলোতে অনন্যা হয়ে উঠেছিলেন, তাদের একটি সচিত্র তালিকা দিয়েছিলেন যতীন্দ্রকুমার সেন। ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার ১৩২৬ আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ‘কামিনী-কুন্তল’ রসরচনাটিতে পাওয়া যায় বিচিত্র খোঁপার ইতিবৃত্ত। যেমন— খোট্টা খোঁপা (হিন্দুস্তানি মেয়েদের অনুকরণে), বিঁড়ে খোঁপা (তবলার বিঁড়ের মতো), বেনে খোঁপা (বণিকবাড়ির মেয়েদের আদরের কেশসজ্জা), গোঁজ খোঁপা (দ্রুত চুল বাঁধতে হলে), ভৈরবী খোঁপা (যোগিনীদের মতো), ব্রহ্মচূড় ও বৈষ্ণবচূড় (মাথার মাঝখানে), খেয়াল খোঁপা (মাথার যত্রতত্র অবস্থান), ফিরিঙ্গি খোঁপা (বিদেশিনিদের অনুকরণে), বিবি গোঁজ (অভিমানিনী অবলার খোঁপা), গোলকধাঁধা খোঁপা (কোথায় শুরু, কোথায় শেষ বোঝা যাবে না), সোহাগী খোঁপা (সহজেই খসে পড়ে), কুশন খোঁপা (মৌচাকের মতো), দোলন খোঁপা (ঘণ্টার মতো দুলতে থাকে), টায়রা খোঁপা (এতে নাকি ঘড়ি লাগানো হত!), এরোপ্লেন খোঁপা (বহু কাল আগে প্রচলিত প্রজাপতি খোঁপার দীর্ঘতম সংস্করণ, দেখতে এরোপ্লেনের মতো ছিল)। ‘এরোপ্লেন’-এর নাম শুনে যদি অবাক হন, তবে ‘তোপ খোঁপা’ দেখলে তো ভিরমি খেতে হবে। তোপ মানে কামান, কেশবতী বঙ্গনারী মাথায় আস্ত একটি ‘কামান’ বহন করতেন যেন! এরই সাম্মানিক শিরোনাম ছিল ‘জ্যাক জনসন খোঁপা’।

খোঁপা-অভিজ্ঞতার দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন লীলা মজুমদার। ১৯২৭-২৮, তিনি কলেজপড়ুয়া। সেই সময়ের কথা লিখছেন ‘আর কোনোখানে’ বইতে: ‘কলেজে উঠে খোঁপা বাঁধলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, একটা কালো ফিতে দিয়ে আঁটো করে চুলের গোড়া বাঁধা হল। তারপর চুলগুলোকে তিন ভাগ করে নিয়ে ফুলিয়ে, পাকিয়ে, জড়িয়ে, গোটা পনেরো দিশী সেলুলয়েডের কাঁটা গুঁজে দিব্যি এক খোঁপা হল। তবে একটা মুশকিল ছিল যে মধ্যিখানের খানিকটা মাঝে মাঝে খুলে যেত। তখন ক্লাসের জনাকুড়ি সহানুভূতিশীলা বন্ধু আবার সেটাকে যথাস্থানে গুঁজে দিত। সবারি তখন ঐ এক দশা।’ এমএ পাশ করে, শান্তিনিকেতনে গিয়ে লীলা বড় খোঁপা ত্যাগ করলেন। ধীরে ধীরে মহিলা মহল থেকেই সেগুলোর চল উঠে গেল। লীলা মজুমদার লিখছেন, ‘পরে আমাদের মেয়েরা আমাদের তখনকার ফটো দেখে হাসাহাসি করত। পঁয়ত্রিশ বছর পরে দেখি নিজেরাও সেইরকম খোঁপা বাঁধছে।’

কলেজছাত্রীদের চুলের ফ্যাশনকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি সমসাময়িক লেখকেরা। ‘মনশা পণ্ডিতের পাঠশালায় পড়া পাত্তাড়ি বগলে মেয়েদের আজকাল আর দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহার পরিবর্তে দেখা যায়— মাথায় কিংবা চুলের বাঁ-দিকে ফিতে-বাঁধা, বেণী দোলান অথবা খোঁপা-বাঁধা, ‘বাসে’-চড়া মেয়েগুলিকে।’ ‘এডুকেশন্যাল ফ্যাশন’ নিয়ে চর্চায় বসতেন তির্যক দৃষ্টির কলমচিরা। যতীন সেনের মতে নতুন এই ফ্যাশনগুলির ‘এইরূপ নাম দেওয়া যাইতে পারে’— সেঞ্চুরি প্রাইমার (এ-বি-সি-ডি পড়বার সময় মাথায় ফিতার বেড়), বিজ্ঞান রিডার (পড়ার ক্লাসে আর একটু উঠলে বেড় বাদ দিয়ে চুলের বাঁদিকে একটা ‘বো’), ম্যাট্রিকুলেশন (হালকা চুলের ফাঁপা বেণীর ডগায় ফিতার ‘টাই’)। এ ভাবে পোস্ট গ্রাজুয়েট, বিএ ফেল, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ খোঁপার নাম প্রস্তাব করেছেন লেখক, যার থেকে বোঝা যায় ‘নারীশিক্ষা’ বিষয়ে কতটা অন্ধকার তখনও সমাজ-মানসে ছিল।

কেশসজ্জার এত বাহার, এমন শ্রী ঢেউ তুলত না হিন্দু বিধবার সাজ-পোশাকে। কেশপ্রসাধনের তো উপায়ই ছিল না তাদের। বয়স দশ হোক কিংবা চল্লিশ, বৈধব্যের অভিজ্ঞান সাদা থান আর মুণ্ডিত মস্তক। কেশবৃদ্ধির সুযোগ ছিল না, তার আগেই ছোট ছোট করে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে তার চেহারার মধ্যে আকর্ষণের লক্ষণাদি না থাকে। কিছুটা রেহাই পেয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিধবা মহিলারা। সাদা থান পরলেও চুলে হাত পড়ত না। কুন্তলীন-দেলখোসের আবিষ্কর্তা, এইচ বোস এন্ড কোম্পানির হেমেন্দ্রমোহন বসুর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছিলেন লীলা মজুমদারের ছোটপিসি— ভাইপো–ভাইঝিদের আদরের সোনাপিসিমা। বেশ কম বয়সে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। লীলা-কলমে ফুটে উঠেছে সেই অকাল-বিধবার বিবরণ: “সোনাপিসিমার বয়স তখন হয়তো বছর বেয়াল্লিশ ছিল, দেখাত আরো কম, মোমের ফুলের মতো হাত-পায়ের গড়ন।… তাঁর সুন্দর শরীরে একটিও অলঙ্কার থাকত না, সাদা থান পরা; তবু যখন ভিজে কালো চুল খুলে দাঁড়াতেন, মনে হত সেজেগুজে এসেছেন।”

কৃতজ্ঞতা: বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি লোধ, রাকেশ দেবনাথ, অশোকনগর শহিদ স্মৃতি পাঠাগার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE