Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Mukutmanipur

জলাধার, জঙ্গল আর শীতের দুপুর

দু’দিনের ছুটিতে গন্তব্য বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরপঞ্চাশের দশকে কংসাবতী ও কুমারী নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধের উপরে দাঁড়ালে দুটো দৃশ্য দেখা যায়।

অরণ্যমাঝে: এ ভাবেই চলে গিয়েছে পথ

অরণ্যমাঝে: এ ভাবেই চলে গিয়েছে পথ

ঊর্মি নাথ
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:১৮
Share: Save:

শহর থেকে দূরে নিরুপদ্রবে কাটাব দুটো দিন। ইচ্ছেপূরণ করতে সপ্তাহের মাঝেই গিয়েছিলাম বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরে। আগাম বুক করা ছিল বন দফতরের সোনাঝুরি প্রকৃতি ভ্রমণকেন্দ্র। কলকাতা থেকে টানা গাড়িতে সোজা মুকুটমণিপুর। গাড়ির রাস্তা ভাল। মন ভরে গেল সোনাঝুরিতে এসে। টিলার উপরে জঙ্গলের মাঝে ছোট ছোট কটেজ। বিভিন্ন গাছ, ফুল, পাখির কলতানে মনে হল, গভীর জঙ্গলে চলে এসেছি। দুপুরে খাওয়ার পরে সোনাঝুরির ভিতরে হিলটপ থেকে মুকুটমণিপুর বাঁধের প্যানোরোমিক ভিউ এতটাই মুগ্ধ করল যে, বিশ্রামে ইতি টেনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পঞ্চাশের দশকে কংসাবতী ও কুমারী নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধের উপরে দাঁড়ালে দুটো দৃশ্য দেখা যায়। এক দিকে জলাধারের নীল টলটলে জল, দূরে জঙ্গল। অন্য দিকে সবুজ খেত। সে সব ফ্রেমবন্দি করে, মিঠে রোদ গায়ে মেখে চললাম পরেশনাথ মন্দির দর্শনে। সোনাঝুরি থেকে বেরোনোর সময়ে এক কর্মী বলেছিলেন, টিলার উপরে পরেশনাথের মন্দির দেখে আসতে। টিলার মাথায় উঠে দেখলাম, খোলা আকাশের নীচে একটি শিবলিঙ্গ ও বেশ কিছু পাথরের প্রাচীন মূর্তি। কোনও মন্দির নেই। এগিয়ে এলেন পুরোহিত। বললেন, প্রাচীন মূর্তিগুলো কংসাবতীতে বাঁধ দেওয়ার সময়ে পাওয়া গিয়েছিল। যার ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। বর্ষায় ঝেঁপে বৃষ্টি নামলে পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁরাও বৃষ্টিস্নাত হন! ভিড় হয় মকর সংক্রান্তি ও শিবরাত্রিতে। চারপাশের ল্যান্ডস্কেপ ভারী সুন্দর। বিদায়কালে পুরোহিতমশাই বলে দিলেন, তিন-চার কিলোমিটার দূরে অম্বিকামাতার মন্দিরটা দেখতে যেন না ভুলি!

মন্দির দেখতে গেলাম অম্বিকা নগরে। এই প্রাচীন জনপদ এক সময়ে রাজা-প্রজা-হাতি-ঘোড়া নিয়ে জমজমাট ছিল। এখন রাসমঞ্চ, ঠাকুরদালান, সিংহদুয়ারের ভগ্নাবশেষ অতীত জানান দেয়। সন্ধ্যারতি শেষে মন্দির, নগরের গল্প বললেন পূজারি। জানালেন, মন্দিরের চেয়েও কালো পাথরের বিগ্রহমূর্তি ঢের পুরনো।

পরদিন মুকুটমণিপুর থেকে ৩৬-৩৭ কিলোমিটার দূরে ঝিলিমিলি ও আরও কিছুটা দূরে তালবেড়িয়া বাঁধে যাওয়ার কথা। ঝিলিমিলি যাওয়ার জন্য রানিবাঁধগামী পথ ধরলাম। চড়াই-উতরাই থাকলেও রাস্তা মসৃণ। দু’পাশে শাল, সেগুন, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ, শিরিষের ঘন সারি। কোথাও দু’ধারের গাছ নুইয়ে পড়ে আর্চের আকার নিয়েছে। এক জায়গায় চালক গাড়ি থামিয়ে দেখালেন নজরমিনার। সেটি বারো মাইল ভিউ পয়েন্ট। কাছেই বোর্ডে লেখা এলিফ্যান্ট করিডোর। এই নজরমিনারের উপর থেকে দেখা যায় চারদিকের গভীর জঙ্গল।

শাল গাছে ঘেরা শান্ত নির্জন জায়গা ঝিলিমিলি। পঞ্চায়েতের গেস্ট হাউস আছে এখানে। শালবনের ভিতরে ট্রি হাউস থেকে চোখ চলে যায় দূরে জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকা, মাঠ, গ্রাম, নদীর দিকে। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে পথ ধরলাম তালবেড়িয়ার দিকে। বিরাট জলাধার, নীল স্বচ্ছ জল আর তার দু’পার ধরে ঘন জঙ্গল। দু’-তিনজন মাছও ধরছেন। ছুটির দিনে অবশ্য পিকনিক আর মানুষের হইচইয়ে তালবেড়িয়ার শান্ত রূপ হারিয়ে যায়। মন ফিরতে চাইছিল না। কিন্তু উপায় নেই। বিকেলের আগেই ফিরে এলাম মুকুটমণিপুরে। ঠিক হল, সূর্যাস্ত দেখব বাঁধের জলাধারে নৌকাবিহার করতে করতে। অধিকাংশ পর্যটক নৌকা নিয়ে চলে যান বনপুকুরিয়ায়। ওখান থেকে হেঁটে বা টোটো করে পৌঁছনো যায় ডিয়ার পার্কে। আমরা সে পথে না গিয়ে জলের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখলাম। গোধূলির আলোয় তখন চারপাশ সোনালি। পাখিরা বাসায় ফিরছে। জঙ্গল ঢেকে আসছে কুয়াশায়। আকাশে অস্পষ্ট আধভাঙা চাঁদ। ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। বাঁধের আলো জ্বলে উঠল। মাঝি নৌকা ফেরাল পারে। আমরাও পা বাড়ালাম সোনাঝুরিতে চা-পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যাকালীন আড্ডা দিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mukutmanipur Travel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE