Advertisement
E-Paper

ছোট্ট ছুটির আশনাই, সিকিমের আরিতার

আজ আমাদের গন্তব্য পূর্ব সিকিমের আরিতার। আমরা অবশ্য রেশম পথ থেকে ফেরার পথে জুলুকে রাত্রিবাস করে, পর দিন সাত-সকালে আরিতারের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ১৬:১৯
মখমলি সবুজে ছাওয়া পাহাড়ি শহর আরিতার।

মখমলি সবুজে ছাওয়া পাহাড়ি শহর আরিতার।

‘There are a big difference between simple being a tourist and a traveler.’

কোথায় যেন এই কথাগুলো পড়েছিলাম। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, প্রকৃতিপ্রেমিক বেড়ানো পাগল মনে কখনও কখনও বাড়ির চৌহদ্দিটুকুও যেন নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়। মনের ভেতরেও যে বাউন্ডুলে মনটা আছে, সেখানে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে, ক’দিন কোথাও বেরিয়ে পড়ার নানান সুলুকসন্ধান। ব্যস! অমনি মনভাসির টানে শুরু হয়ে যায় কোথাও বেরিয়ে পড়ার নানান ফিকির।

আজ আমাদের গন্তব্য পূর্ব সিকিমের আরিতার। আমরা অবশ্য রেশম পথ থেকে ফেরার পথে জুলুকে রাত্রিবাস করে, পর দিন সাত-সকালে আরিতারের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম। জুলুক-নাথান ভ্যালি থেকে পদমচেরি পেরিয়ে রেনক-রংলি হাইওয়ে ধরে কখনও চূড়ান্ত বাঁক নেওয়া পথ ধরে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ৪২ কিলোমিটার পথ সাঁতরে আরিতার পৌঁছে গিয়েছি। হোটেল ঠিক করা ছিল না। তবে, এখানে অনেকগুলি রিসর্ট, হোটেল আছে, জানতাম ঘর পেতে অসুবিধা হবে না। আর আমাদের বোলেরো গাড়ির চালক চুমলুং দোরজি আশ্বস্ত করেছিলেন, ওঁর চেনা এক মালকিনের হোটেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রাজি হয়ে যাই। এখনও কিন্তু কুয়াশামোড়া আরিতারের ঘুম ভাঙেনি। সকাল পৌনে ন’টার মধ্যেই হোটেল চিটি’জ-এর দোরগোড়ায় গাড়ি থামল। তিন তলা হোটেল আবাস। তবে, রিসেপশনে কেউ নেই। নীচে খাবারঘর, রান্নাঘর সব ফাঁকা। চুমলুং কিন্তু থেমে নেই। মালকিনের মোবাইলে সমানে রিং করে যাচ্ছে। খানিক অপেক্ষা করছি। কাছাকাছি নিজের বাড়ি থেকে চলে এলেন হোটেল মালকিন সুমিত্রা প্রধান। প্রচুর হেসে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চাইলেন আমাদের অপেক্ষা করানোর জন্য। দোতলার ঘরে নিজে এসে চাবি খুলে দিলেন। বেতের সোফা এবং সেন্টার টেবিল, পরিপাটি বিছানা, পর্দা, আসবাব ও অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত স্নানাগার। মন বেশ খুশ হয়ে গেল।

মঠ, গান্তি-সো হ্রদ শৈত্য বাতাবরণ ও গ্রামীণ ছন্দে বয়ে চলা সাবেক ঢঙের সবুজ আরিতার।

পূর্ব সিকিমের র‌ংলি ডিভিশনের ৪,৯১৫ ফুট উঁচুতে আরিতার। একটি মখমলি সবুজে ছাওয়া পাহাড়ি শহর। কয়েকটি মঠ, গান্তি-সো হ্রদ, তার নীল-সবুজাভ জল, শৈত্য বাতাবরণ ও গ্রামীণ ছন্দে বয়ে চলা সাবেক ঢঙের সবুজ আরিতার। এক-দুই রাতের জন্য বিনোদনী ঠেক। পুবের জানলার পর্দা সরাতেই সুন্দর দৃশ্য। জানলা খুলতেই হালকা ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে সকালের মিষ্টি রোদ। গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। একজোড়া পাহাড়ি পাখি ঠোঁট-গা ঘষাঘষি করে সোহাগি আলাপ সারছে। ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে গরম কফির কেটলি, সঙ্গে এক প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। সুদৃশ্য কাপে কফি ঢেলে, আয়েসি চুমুক দিতে দিতে জানলার ও-পারে পরখ করে যাই পাখিদের খুনসুটি। দূরে সবুজ পাহাড়ের আবছায়ায় থোকা থোকা মেঘ ভাসছে কুয়াশার মতো। আরিতারের রোদ্দুর একটু একটু মেঘ সরিয়ে পাহাড়গুলোর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। মন ভোলানো সকাল দেখছি। অদ্ভুত স্নিগ্ধতার পরশ। হুঁশ ফিরল হোটেলের কিশোর কর্মীর বেলের আওয়াজে। প্রাতরাশের অর্ডার নিতে এসেছে।

আরিতার লেককে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ঘাতি সো’। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এই রম্য হ্রদটি। প্রায় ৩৫০ মিটার লম্বা ও ৭৫ মিটার চওড়া হ্রদটি একেবারে মানুষের পায়ের পাতার আদলে দেখতে। বহু প্রাচীন এই প্রাকৃতিক হ্রদটি এখন অবশ্য বাইরে থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে অনেক আকর্ষক করা হয়েছে পর্যটক টানার জন্য। প্যাডেল পুশার নৌবিহারের ব্যবস্থা আছে। নাগালে কাপল হাউজ একটি আস্তানা ও আপাতত খদ্দেরহীন একটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। আরিতার লেকের আসল নাম হচ্ছে লোমপোখরি। ছবি তুলছি, এমন সময়ে পায়ের পাশ গলে চই চই চই...করতে করতে একগুচ্ছ সাদা রাজহাঁস মিছিল করে জলের পানে চলে গেল। লোমপোখরির জলের খোলস ভাসতে ভাসতে তাদের ডুব-আমেজ ও অজস্র সাঁতার। হাঁসের সাদা পালকগুচ্ছ থেকে পিছলে যায় জলকণা। গলা তুলে, ডানা ঝাপটিয়ে লোমপোখরি মাতিয়ে তাদের আনন্দ সাম্পান।

প্রাচীন একটি গুম্ফা আছে, আরিতার গুম্ফা। খুবই পবিত্র প্রার্থনাস্থান এটি, স্থানীয়দের কাছে। তিব্বতীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মা কাগ্যা পা শাসিত এই গুম্ফায় রয়েছে কিছু প্রাচীন পুঁথি, ঐতিহ্যবাহী তোরণ ও ভাস্কর্য, দেওয়ালে বৌদ্ধ ম্যুরাল। অপূর্ব দেখতে আরিতার গুম্ফার পরিবেশটিও ভারী মনোরম। মঠ দেখে এ বার পৌঁছলাম পর্বতেশ্বর শিবালয় মন্দিরে। শ্রাবণ মাসে কাছাকাছি পাহাড়ি গ্রামগুলি থেকে হাজারে হাজারে ভক্ত আসেন এই মন্দিরে পুজো দিতে। এবং শিবলিঙ্গে জল ঢালতে। এ অঞ্চলের একটা জনপ্রিয় পিকনিক স্পট হল লাভ দাড়া। নির্মল ধামটি হল রেনক বাজার পেরিয়ে আরও পাঁচ কিলোমিটার দূর পথে। নির্মলবাবা, যিনি ‘কোপচে বাবা’ বলেই সমধিক পরিচিত, তাঁর আশ্রমে। রেনক বাজারের কাছেই রয়েছে এভারগ্রিন নার্সারি অ্যান্ড র গ্রেইন সংগ্রহালয়। এখানে নানা প্রজাতির অর্কিড ফুল, শস্যদানা ও ঔষধিযুক্ত গাছের বিপুল সংগ্রহ।

পাহাড় আর সবুজে ঘেরা আরিতার গ্রাম।

আরিতারের আরও এক অবশ্য দ্রষ্টব্য স্যর জেমস ক্লাউড হোয়াইট নামে এক ব্রিটিশ আধিকারিকের বিশ্রামাবাস। ১৮৯৫ সালে আরিতার গ্রামের খানিক নীচে তিনি এই চমৎকার আবাসটি বানিয়েছিলেন। স্থানীয়েরা এটিকে ‘অরি বাংলা’ বলেই ডাকে। এখন এটি সিকিম স্টেট পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের ব্যবস্থাপনায় পর্যটক বাংলো হিসেবে চলছে। পরিষ্কার আকাশে প্রাচীন এই ব্রিটিশ বাংলো চত্বর থেকে দূরের কালিম্পং শহর ও শহরতলির খোলা অংশ দিব্যি দেখা যায়। ছোট একটা ট্রেক করেই পৌঁছে যাওয়া যায় ৬,৫০০ ফুট উঁচু মন‌্‌খিম্‌ দারা। মন্‌খিম্‌ দারা পাহাড়চূড়া থেকে বাকি সমস্ত চরাচর সাবেক পসরা সাজিয়ে প্রকৃতির নিরন্তর চমক। যেন এক পিকচার পোস্টকার্ড। ক্যামেরা ফোকাস করতেই মেঘেরা নেমে আসে সহসা। পলকে হারিয়ে যাচ্ছে সামনের ওই চরাচর। ঢেকে যাচ্ছে সবুজ। ঢেকে যাচ্ছে নীল। পর্যটন সুবাস ছাড়িয়ে ছায়া-রোদের প্রস্তাবে ডুব দিচ্ছে মন্‌খিম্‌।

মন্‌খিম্‌ ভিউ পয়েন্ট থেকে সামান্য দূরেই নেপালি রাই সম্প্রদায় নির্মিত ছোট একটা হিন্দু মন্দির রয়েছে। এই জায়গাটার নাম মাইতি ভিলেজ। এখানে খোললাখা নামের প্রকৃতিবীক্ষণ থেকেই প্রতি দিন অর্কদেব আকাশের বুকে কমলা-লাল-হলুদ প্রলেপ ছড়িয়ে পাহাড়ের ফাঁক গলে হারিয়ে যান। সূর্যাস্তের সেই রমণীয় দৃশ্য মন্‌খিম্‌ দারা-কে সেরা করে রেখেছে। মুগ্ধতার চূড়ান্ত অধিকারটুকু অচিরেই কেড়ে নেবে আরিতারে হৃদয় উদ্যত লোমপোখরি বা মন্‌খিম্‌ দারা। বেবাক আমি, সফরনামা খুলে শুধু দুই হাত পেতে বসে থাকি। বেশ টের পাই, বুঝি, ঋণী হয়ে পড়ছি রূপসী আরিতারের কাছে।

কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আরিতার ১০৯ কিমি, চার ঘণ্টার পথ। গ্যাংটক থেকে আরিতার ১৩৫ কিমি, দার্জিলিং থেকে ১১১ কিমি। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে পুরো গাড়ি ভাড়া করে চলে যাওয়া যায় আরিতার। আবার গ্যাংটকগামী শেয়ার জিপে রানিপুল পৌঁছে অন্য শেয়ার জিপে আরিতার। সাশ্রয় হবে। উড়ানপথে যেতে হলে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট, তার পর সড়কপথে আরিতার।

কোথায় থাকবেন: আরিতারে রয়েছে প্রচুর হোমস্টে। এদের আতিথেয়তা মনে রাখার মতো। থাকা-খাওয়া নিয়ে মাথাপিছু ৯০০-১৩০০। সিল্ক রুট ঘুরে এসেও পর্যটকরা অনেকেই আরিতারে রাত্রিবাস করেন। এখানে বিভিন্ন মানের প্রচুর হোটেলও রয়েছে। তবে পিক সিজনের সময় অনলাইন বুকিং করে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

কখন যাবেন: সারা বছরই যাওয়া যেতে পারে। এই সময় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালীন (১২°-২৩° সেন্টিগ্রেড), শীতকালে (৬°-১৫°/১৯° সেন্টিগ্রেড)। ভারী ও উপযুক্ত শীতবস্ত্র জরুরি। উপযুক্ত পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, সব সঙ্গে রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়।

Aritar Holiday Destination Holiday Trip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy