Advertisement
০৮ মে ২০২৪
North Bengal

উত্তরবঙ্গের অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্র বুংকুলুং-তুরুক-সেলফু

আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন। তার পরইপুজোরবেড়ানোর তোড়জোড় শুরু। আপনার প্রিয় উত্তরবঙ্গের আনকোরা গন্তব্যে যাবেন? জেনে নিন সদ্য উত্তরবঙ্গ সফর সেরে ফেরা শান্তনু চক্রবর্তী-র কাছেআর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন। তার পরইপুজোরবেড়ানোর তোড়জোড় শুরু। আপনার প্রিয় উত্তরবঙ্গের আনকোরা গন্তব্যে যাবেন? জেনে নিন সদ্য উত্তরবঙ্গ সফর সেরে ফেরা শান্তনু চক্রবর্তী-র কাছে

বুংকুলুং। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী

বুংকুলুং। ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৯ ১১:৩২
Share: Save:

বুংকুলুং

এনজেপি থেকে মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারেন এক অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্রে। চার দিকে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, চা-বাগানের মাঝে অসাধারণ ঠিকানায়। দূরে পাহাড়ের গায়ে মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির হাতছানি। মিরিক যাওয়ার পথে ১০ নম্বর ফটক থেকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ১০ কিলোমিটার। গোর্খা আর নিম্বু উপজাতিদের গ্রাম। পথের মাঝেই এসে পড়বে ময়ূরের ঝাঁক অথবা কালেজ ফ্লেজান্ট। আর অরণ্যের ঠাসবুনোট। দূরে বালাসন নদী। পাহাড়ের ধাপে সবুজ ধানের বাহার। অল্পচেনা এই গ্রামের নাম বুংকুলুং। অতিথিপ্রিয় আদিবাসী। পাহাড়ের কোলে বসানো বুংকুলুং গ্রামের চারপাশটা পায়ে পায়েই বেড়িয়ে নেওয়া যায়।

অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীরা চলে আসতে পারেন নামসু। বুংকুংলুং থেকে কিছুটা উপরের দিকে চলে এলেই মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির কোলে ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা বুংকুলুং জঙ্গল ক্যাম্প। মাঝে মাঝে গহিন অরণ্য থেকে ভেসে আসে বনচরদের কর্কশ আওয়াজ। কিছু দূর এগোলেই মুরমা খোলার বহতা মুগ্ধ করবে। হরিণ, বন্য শুয়োর, চিতাবাঘের বিচরণক্ষেত্র, তাই সাবধানে দলবদ্ধ ভাবে চলাফেরা করবেন।

পর দিন ভোরে বেরিয়ে পরুন। চোখে পড়বে সুন্দর চা-বাগান। নিঝুম, নির্জন, অজানা, অল্পচেনা গ্রামের প্রতিটি বাঁকেই শুধুই বিস্ময়। গাছে গাছে পাখিদের কলতান। ময়ূর, গ্রে ট্রিপাই, ব্লু হুইস্লিং থ্রাস, স্কারলেট মিনিভেট, গ্রিন ব্যাক টিট, স্কিমিটার ব্যবলার, কালেজ ফ্লেজেন্টদের সদর্প সমাবেশ। দেখে নিন, লোহার ব্রিজের গা বেয়ে নেমে আসছেবুংকুলুং ঝোরা। ব্রিজ পেরিয়ে চলে আসুন গয়াবাড়ি। রণপা পরা সুদীর্ঘ গাছের নীচে গয়াবাড়ি চা-বাগান। সবুজ মখমলি চা-বাগানে গুনগুন গান গাইতে গাইতে টিপাই করছে গ্রামের মেয়ে-বউরা। চা-বাগান পেরোতেই বিশাল ব্রিজ। দু’পাশে গহিন অরণ্য আর নীচে কুল কুল করে বয়ে চলা বালাসন নদীকে দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যাবে তা টেরও পাবেন না।

কী ভাবে যাবেন:

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসুন মিরিকগামী রাস্তার ১০ নং ফাটক। সেখান থেকে বুংকুলুং-এর দূরত্ব ১০ কিমি। এনজেপি থেকে বুংকুলুং ৫০ কিমি। গাড়িভাড়া ১৮০০-২২০০ টাকা।

কোথায় থাকবেন:

এখানে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য রয়েছে সুন্দর টেন্ট। ছোট, মাঝারি, বড় টেন্টে থাকতে পারেন। ভাড়া ৪ জনের ২৫০০ টাকা, ২ জনের টেন্ট ৮০০ টাকা। খাওয়া জনপ্রতি৬৫০ টাকা।

বুংকুলুং গ্রামে রয়েছে বুংকুলুং জঙ্গল ক্যাম্প (৯০৬৪৮১৭৮১২ / ৯৮৩২০৩৬০৫৩) ভাড়া ১৭০০ টাকা জনপ্রতি। থাকাখাওয়া সমেত।

তুরুক

উত্তরবঙ্গের আরও এক অচিনপুর। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর প্রায় ৪৮০০ ফুট উচ্চতার এক ছবি আঁকা পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ের কোলে এক নির্জন প্রকৃতির আবাস। কার্শিয়াং সাবডিভিশনের অন্তর্গত মিডিল সিটং-এর অন্তর্গত।পাহাড়ের ধাপে ধাপে অর্গানিক চাষের বাহার। বাঁধাকপি, ফুলকপি, রাইশাক, মুলো, আলু আর মরসুমি কমলালেবুর বাহারে মন ভরিয়ে দেবে।ধুপির জঙ্গলের কোলে বসানো ছবির মতো সাজানো গোছানো গ্রাম তুরুক। নাম না জানা রঙিন পাহাড়ি ফুল থোকায় থোকায় ফুটে আছে। ইচ্ছে হলেই নীচের সিটং থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এখানকার এক্কেবারে আনকোরা ডেস্টিনেশন লেপচা ফলস, চার্চআর রিয়াং নদীকে দেখে নিতে পারেন।

সবুজের মাঝে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে অপার নির্জনতা ভেঙে দেয় পাখিদের কিচিরমিচির।লেপচাদের বাড়ির আদলে গড়ে উঠেছে সুন্দর এক হোমস্টে। দূরের মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির অরণ্যর সবুজ হাতছানি।ইচ্ছে হলেইছোট্ট ট্রেকে অথবা গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বাগোরা, চিমনি। তবে ট্রেকরুটে নিবিড় অরণ্য আর তার বৃক্ষবৈচিত্র মুগ্ধ করবে। এ পথে বাড়তি পাওনা হিসেবে কালেজ, জাঙ্গল ফাউল ছাড়াও হরিণ, হিমালয়ান স্লথ বিয়ারেরও দেখা মিলতে পারে। অবশ্যই গাইড সঙ্গে নেবেন।

পাইন, ফার, ওকের ছায়ামাখা ৭,১০০ ফুট উচ্চতায় বাগোরার আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে। তুরুক থেকে বাগোরার দূরত্ব ১০ কিমি।

বাগোরার থেকে চিমনির দূরত্ব ৩ কিমি। ৭,২০০ ফুট উচ্চতায় আরও এক ফুলের জলসাঘর। প্রতিটি বাড়ির উঠোনে শোভা পায় পপি, এজিলিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা। একসময় প্রচুর বরফ পড়ত, তাইব্রিটিশরা তাঁদের সৈনিকদের জন্য জল গরম করতেএই বিশাল চিমনি তৈরি করেছিলেন। আর তার থেকেই গ্রামের নাম হয়চিমনি। কাছেই রয়েছে সুন্দর ভিউপয়েন্ট। এখান থেকে দূরের কার্শিয়াং আর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে অসাধারণ লাগে।

কী ভাবে যাবেন:

শিলিগুড়ি থেকে মংপু হয়ে সিটং ছাড়িয়ে তুরুকের দূরত্ব ৬৮ কিমি। গাড়িতে চলে আসতে পারেন।

কোথায় থাকবেন:

তুরুকে থাকার জন্য রয়েছেরাশিকা হোমস্টে। ফোন:৯৮৩০০১১৭১৫। থাকার জন্য দু’টি লেপচা কটেজ আর দু’টি লেপচা মাড হাউস। রিয়াং হোমস্টে। ০৭৯৮০৪৫৩২১৮। ৬টি রুম। ভাড়া ১২৫০ টাকা জনপ্রতি। লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট সমেত।

সেলফু

এনজেপি থেকে কালিঝোরা হয়ে লোহাপুলের আগেই বিরিকদাঁড়া। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে অন্তত ১২ কিমি। এ পথেই বারে বারে প্রকৃতির চিত্রপটের বদল। ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছে যান দার্জিলিং জেলার কার্শিয়ং সাবডিভিশনের এক নতুন ডেস্টিনেশনে। সেলফু। এনজেপি থেকে প্রায় ৪৮ কিমি। পাহাড়ের ঢালে বাক্সবাড়ির আর প্রতিটি বাড়ির কার্নিশ, বারান্দায় অর্কিডের বাহার। ছোট্ট চাষের জমিতে রাসায়নিক সারমুক্ত ফসলের বাহার। এলাচ, কমলালেবুর আধিক্য চোখে পড়বে। নিঝুম, নিশ্চুপ গ্রামের নীরবতা ভঙ্গ করে হিমেল বাতাস স্বাগত জানাবে। নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের সারি আর তাদের মাথার উপরেই চিরতুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসিমুখ। তবে আকাশ পরিষ্কার থাকলেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলবে। তার নীচে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা রিয়াং নদীর সর্পিল যাত্রাপথ, লেপচা চার্চ, যোগীঘাট সমেত গোটা সিটং-কে পাখির চোখে দেখতে পাবেন।পায়ে পায়ে ঘুরে নির্জন সেলফু-কে দেখতেঅসাধারণ লাগে।

কাকভোরে শীতবস্ত্রে মুড়ে চলে আসতে পারেনআহালদাড়া। পাইনের বন পেরিয়ে খাদের ধারের ভিউপয়েন্ট থেকে ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক ফ্রেমে ছবি আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার সাজানো গোছানো সংসারকে দেখে নিতে পারেন। আহালদাড়ার ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য বড়ই মনোরম। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেই কালিম্পং, আলগাড়া, বাগোরা,তিনচুলে আর সিকিমের গ্যাংটকের দেখা মিলতে পারে।

আহালদাড়া থেকে মাত্র ২০০ মিটারের মধ্যে নামথিংপোখরি। ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় এক পবিত্র পোখরি। পাইনের বৃক্ষরাজদের ঘিরে থাকা পোখরি ঘিরে নানান মিথ। আর এখানেই দেখা মেলে ডাইনোসর যুগের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ‘হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডার’। এদের বিরক্ত না করাই ভাল। প্রচুর পাখির দেখাও মেলে।

আরও পড়ুন: অ্যাপেই ভরসা

সেলফু থেকেই ঘুরে নিতে পারেনমহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির সবুজ চাদরে মোড়া ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম,লাটপাঞ্চার। সিঙ্কোনার প্ল্যান্ট ছাড়াও পাইন,শাল,সেগুনের বৃক্ষরাজদের দখলে থাকা গ্রামে নানান পাখির আনাগোনা। লাটপাঞ্চার বিখ্যাত হয়েছে ধনেশ পাখিদের জন্য।রুফাস নেকড হর্নবিলদের ন্যাচারাল ব্রিডিং সেন্টার।দেশের নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন চিত্রগ্রাহকেরা।

সানবার্ড। ছবি: সোমনাথ মিত্র

কী ভাবে যাবেন:

শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে এনজেপি থেকে বিরিকদাড়া হয়ে সেলফু চলে আসা যায়। দূরত্ব প্রায় ৪৮ কিমি।

কোথায় থাকবেন:

সেলফুতে থাকার জন্য রয়েছে আহাল হোমস্টে। ফোন: ৯৪৩৪০৭২৫৫২। ভাড়ালাঞ্চ,ব্রেকফাস্ট, ডিনার সমেতজনপ্রতি ১২৫০ টাকা।

ছবি: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North Bengal travel selphu bungkulung turuk
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE