‘এক শাহেনশাহ নে বানওয়াকে হাসিন তাজমহল, সারি দুনিয়াকো মহাব্বত কী নিসানি দি হ্যায়...।’ মৃদু বাজছে গানটা। ভেসে যাচ্ছে হালকা হাওয়ায়। মশলা গলির গন্ধ, বাজারের হট্টগোল, পথচলা ফেরিওলার সুর, ব্যস্তসমস্ত ঘোড়ার গাড়ি একযোগে আঁকছে শহরের ছবি। সুপ্রাচীন ইতিহাসের ছোঁয়ায় ঐতিহ্যময় শহর, প্রেমের শহর আগ্রা। বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম শহরটাতে। চমক ভাঙল রিকশাচালকের কথায়। ইমতিয়াজ ওর নাম। বছর পঁচিশের ছেলেটার সঙ্গে আগ্রার অলিগলির সখ্য। ও-ই শহরটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে আমাকে। পায়ের কাছে রাখা ছোট সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে বলল, ‘গানা শুনা আপনে ম্যাডামজি? তাজমহল শান হ্যায় হামারা।’ সত্যি, যার জন্য এতদূর ছুটে আসা সেই তাজমহলই দেখা হয়নি এখনও। অনেক রাত হয়েছে আগ্রা পৌঁছতে। ভেবেছি, আজ একটু শহরটা দেখে কাল সকালে যাব তাজমহল দেখতে।
আগ্রা শহরটা বড় অন্যরকম। সে এক পা বাড়িয়ে আছে আধুনিকতার দিকে, তার আর এক পা আজও স্থির ঐতিহ্যে, পুরাতনে। ঘিঞ্জি গলি, তস্য গলি। কিনারি বাজার জমজমাট। বিদেশিদের ভিড়। রাস্তার পাশে বসে পড়ে দেখছে ছোট ছোট দেবদেবীর মূর্তির সম্ভার। এদের সকালে এক কাপড় পরানো হয়, দুপুরে স্নান করিয়ে ফের পালটানো হয় পোশাক। ভাঙা ইংরেজি আর হিন্দিতে যথাসম্ভব এই প্রথার ইতিহাস বোঝাচ্ছে ফেরিওয়ালা। উজ্জ্বল আলোয় রং বিলোচ্ছে মশলা গলি। ঔরঙ্গজেবের আগ্রা, শাহজাহান, নূরজাহানের আগ্রা। অপরিসর গলির ফাঁকে মাথা চাড়া দেওয়া বহুতল, ঘিঞ্জি মহল্লার পাশে ঝাঁ চকচকে শপিং মল যেখানে একসঙ্গে ইতিহাসের গল্প শোনে।
তাজমহল
পরের দিন ভোরে বেরোলাম তাজমহল দেখতে। দূষণের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে ছেড়ে দিতে হয় গাড়ি। তারপর ব্যাটারিচালিত গাড়ি অথবা ঘোড়ার গাড়ি করে পৌঁছতে হয় তাজমহলে। আকাশে সোনা রং ধরছে সবে। অপার্থিব আলোয় ভেসে যাচ্ছে শুভ্রমর্মর সৌধ। প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পর শোকাহত সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন তাজমহল। দেশ, কালের অতীত বিশ্ববন্দিত এই কীর্তির বিশালত্ব আর অসাধারণ সৌন্দর্যের সামনে স্তব্ধ হয় হৃদয়। পারসিক আর মুঘল স্থাপত্যের সংমিশ্রণে গড়া হয় তাজ। ২০ হাজার কর্মী ২২ (১৬৩২-১৬৫৪) বছরে শেষ করেন এর নির্মাণ। তাজমহলের এক দিকে গেস্ট প্যাভিলিয়ন আর অন্য দিকে লাল বেলেপাথরে তৈরি মসজিদ। বস্তুত, অধিকাংশ মুঘল স্থাপত্যই লাল বেলেপাথরে তৈরি। তাজমহল এক অনন্য ব্যতিক্রম। ৪০০ মিটার চৌকোনা চারবাগ বা মুঘল গার্ডেন দিয়ে ঘেরা ৬০ ফুট ব্যাসের ৮০ ফুট উঁচু মূল গম্বুজের চারপাশে চারটি ছোট গম্বুজে সাজানো তাজমহল। শুভ্র মার্বেলে সেমি প্রেসাস স্টোন, পেন্টি আর ক্যালাগ্রাফির অনুপম কারুকার্য। বলা হয় আমানত খান শিরাজি তাজমহলের গাত্রে অতি যত্নে উৎকীর্ণ করেছেন পবিত্র কোরান। শাহজাহান আর মুমতাজ মহলের সমাধির প্রতিকৃতি রয়েছে ওপরের এক কক্ষে। বেসমেন্টে রয়েছে আসল সমাধি। মুসলিম রীতি মেনে তুলনায় সাদাসিধে এই সমাধি দু’টি। সন্ধ্যা নামছে ধীরে। লাল বেলেপাথরের মসজিদের পিছনে অস্তগামী সূর্যের রাঙা আভা বিষণ্ণ আলো মাখিয়ে দিচ্ছে শ্বেতমর্মরে। অন্ধকার হয়ে আসছে বহমান যমুনা। তবু দীপ্ত বেদনার ইতিহাস, তবু দীপ্ত প্রেম। সত্যিই ‘এক বিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল। এ তাজমহল।’
আগ্রা ফোর্ট
পরের দিনের গন্তব্য আগ্রা ফোর্ট, ইতমদ-উদ-দৌল্লা আর সিকান্দ্রা। সকাল সকাল বেরোলাম হোটেল থেকে। ভাঙাচোরা রাস্তা ধুলোর গন্ধমাখা, ধোঁয়া উঠছে গরম চায়ের কাপ থেকে। রাস্তার মোড়ে গুলতানি। যতটা পারা যায় পাশের লোকের হাতে ধরা খবরের কাগজে ঝটিতি চোখ বুলিয়ে নেওয়া। চেনা ছবি সবটাই। থমকালাম পানের দোকানে অন্য রকম একটা জিনিস দেখে। ঝকঝকে তিনকোণা, আলোতে ঝিকিয়ে উঠছে রূপোর রং। বহুবর্ণের সুগন্ধী মশলার সাজ গায়ে। থরে থরে সাজান থালার ওপর। আপাদমস্তক রূপোলি তবকে মোড়া এই পান, পেঠার মতোই আগ্রার স্পেশালিটি। কুমড়োকে চিনির রসে জারিয়ে, হালকা কেশরের ছোঁয়ায় বিচিত্র রংবাহারে যে এত সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করা যায় আগ্রার পেঠা না খেলে সেটা বুঝতাম না।
পেঠা অঙ্গুরি
এসে পৌঁছলাম আগ্রা ফোর্টে। উঁচু প্রাচীর আর বিরাট পরিখার সমাহারে সুরক্ষিত দুর্গ তৈরি করেছিলেন আকবর। প্রথমেই জাহাঙ্গির মহল। দেখার মতো সুন্দর দেওয়ান-ই-আম রয়েছে তার পরেই। ৪০ পিলারের উঁচু দরবারে অতি সুন্দর সিংহাসনে শাহজাহান বসতেন প্রজাদের মাঝে। ব্যক্তিগত দেখাসাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট ছিল দেওয়ান-ই-খাস। বহুমূল্য ময়ূর সিংহাসন ছিল এখানেই। পরে যেটি লুঠ হয় নাদির শাহের হাতে। তেহখানায় যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে কাছেই। প্রবল গ্রীষ্মে মাটির তলার ঠাণ্ডা ঘরে আশ্রয় নিত রাজপরিবার। বেগমদের স্নানের জায়গা শিশমহল রয়েছে অঙ্গনে। অজস্র কাচ হাজার প্রতিবিম্বে ভেঙে যেত শিশমহলে। সম্রাটের বিশ্রামঘর খাসমহল, মচ্ছি ভবন, নাগিনা মসজিদ, মোতি মসজিদ— সবই রাজকীয় আভিজাত্য আর কারুকার্যে মোড়া। দেওয়ান-ই-খাস-এর পাশে মুমতাজের জন্য শাহজাহান তৈরি করেছিলেন মুসম্মন বুর্জ। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ আর তার সন্তান ঔরঙ্গজেব জীবনের শেষ আট বছর তাঁকে বন্দি করে রাখে এখানে। বলা হয়, এখানে থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়েই যন্ত্রণাময় শেষ দিনগুলি কাটান শাহজাহান।
ইদমত উদ দৌলা
জাহাঙ্গিরের প্রেমিকা এবং পরবর্তীকালে স্ত্রী, প্রবল প্রতিপত্তিশালিনী নূরজাহানের বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি করা সমাধি ইতমদ-উদ-দৌল্লা। জাহাঙ্গির তাঁর উজির গিয়াসুদ্দিন বেগের বিবাহিতা কন্যা অসাধারণ রূপসী মেহেরুন্নিসার প্রেমে পড়েন। বলা হয়, জাহাঙ্গির ষড়যন্ত্র করে মেহেরুন্নিসার
স্বামীকে হত্যা করে তাঁকে বিয়ে করেন। নাম দেন নূরজাহান অর্থাৎ জগতের আলো। কালক্রমে রাজসিংহাসনের প্রায় নির্ণায়ক হয়ে ওঠেন তিনি। নূরজাহানের বাবা গিয়াসুদ্দিন বেগ রাজ দরবার থেকে খেতাব পান ইতমদ-উদ-দৌল্লা। তাঁরই স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাজমহল নির্মাণের বেশ কিছু বছর আগে এই শুভ্র সমাধি তৈরি করেন নূরজাহান। পিয়েত্রদুরা শৈলীতে অনবদ্য কারুকার্য এই সমাধির। একে বেবি তাজ বা আইভরি জুয়েলও বলা হয়।
শাহজাহান ও মুমতাজের সমাধি
আগ্রা-দিল্লি সড়কপথে মুঘল বাদশাহ আকবরের সমাধি সিকান্দ্রা। প্রবেশপথে সুবিশাল বুলন্দ দরওয়াজা। সমাধির ওপর পাঁচতলা সৌধ ফতেপুর সিক্রির আদলে। প্রথম তিনটি তলা লাল বেলেপাথরের। চতুর্থ তলা শ্বেতমর্মরের। হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনবদ্য নিদর্শন সিকান্দ্রা। এ ছাড়াও চিনি কা রৌজা, দয়ালবাগ, জামি মসজিদ দেখা যেতে পারে আগ্রায়।
ভালবাসা বাঙ্ময় এই শহরে। শুধু তাজমহলই তো নয়, এ যে মির্জা গালিবেরও শহর। যিনি লিখে গিয়েছেন, ‘মহব্বত মে নেহি হ্যায় ফারক জিনে অর মরনে কা...!’ এই অনন্য অভিজ্ঞতার সামনে নতজানু হয় হৃদয়। বার বার ফিরে আসা যায় আগ্রায়। বার বার আবিষ্ট হওয়া যায় মুগ্ধতায়, প্রেমে।
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেন যাচ্ছে আগ্রা। উদ্যানআভা তুফান এক্সপ্রেস পটনা হয়ে আগ্রা পৌঁছচ্ছে। হাওড়া-যোধপুর বিকানির এক্সপ্রেস, অনন্যা এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে আগ্রা যাচ্ছে। এ ছাড়া দিল্লি হয়েও আগ্রা যাওয়া যায়। কোথায় থাকবেন: বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল আছে আগ্রায়৷ হোটেল তাজ প্লাজা৷ ভাড়া ১২০০-২০০০ টাকা৷ email-hoteltajplaza@yahoo.com৷ মেরিট হোটেল৷ ভাড়া: ২৮০০-৩২০০ টাকা৷ যোগাযোগ-৫৬২-২২৩ ১৫৫৫৷ email-reservation@merithotel.in
ছবি: লেখক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy