Advertisement
E-Paper

প্রকৃতির স্পর্শ পেতে

এক টুকরো প্রকৃতি। সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসা প্রাণীরাও। ৩৫ বিঘেতে জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। দেখতে চাইলে যেতে পারেন কেতুগ্রামের বেলুনে। লিখছেন সুচন্দ্রা দেপ্রায় ত্রিশ বিঘা জমির উপরে তৈরি হয়েছে জঙ্গল। এর পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তন্ময় ঘোষের। তন্ময়বাবু মূলত চিত্রগ্রাহক। তন্ময়বাবু জানান, পৃথিবীতে সংরক্ষিত অরণ্যে বাস করে প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি প্রাণী। সেখানে প্রাণীরা নিশ্চিন্তে বসবাস করে।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৫০
জলবাড়ি। নিজস্ব চিত্র

জলবাড়ি। নিজস্ব চিত্র

ছবি তুলতে ভালোবাসেন? না, নিজস্বী নয়, বলছি নানা রঙের ফুলের উপরে বসে থাকা বাহারি প্রজাপতির, নদীর পাড়ে বসে থাকা পরিযায়ী পাখির, রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বলে চোখে ধেয়ে আসা মেছোবিড়াল বা এমন কোনও কীট-পতঙ্গ যার নামই হয়তো শোনেননি, কিংবা হরেক প্রজাতির সুন্দর মাছের। কংক্রিটের মধ্যে দশটা-পাঁচটার জীবন ছেড়ে প্রকৃতি ও প্রাণীদের সঙ্গে খানিক সময় কাটাতে চাইলে চলে আসতেই পারেন কেতুগ্রামের বেলুনে। এমনিতে আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে এর কোনও পার্থক্য নেই। তবে এই গ্রামের ‘জলবাড়ি’তে ঢুকলে মনে হবে হয়তো অন্য প্রকৃতির কোলে এসে পড়েছেন। যে প্রকৃতি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু ফটোগ্রাফি-প্রেমীরাই নন, জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণারত’রাও ঘুরে যেতে পারেন বেলুন গ্রামের এই জলবাড়িতে। বিশেষ করে শীত আর বর্ষার সময়ে আসা ভাল। কারণ, এই দুই সময়ে সময়ে সরীসৃপ, পাখি এবং মাছের দেখা মেলে বেশি।

পরিবেশ বিপন্ন। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও প্রকৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়লে আগে গ্রামে শিয়ালের ডাক শোনা যেতে। সহজেই গিরগিটি, প্রজাপতি, বনবিড়ালের মতো প্রাণীর দেখা মিলত। কিন্তু ক্রমেই সে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। কারণ, এ সব প্রাণীদের থাকার মতো পরিবেশ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই সব প্রাণীদের থাকার মতো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এই সব প্রাণীদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সম্ভব পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাও। ঠিক এই চেষ্টাই করা হয়েছে শিবাই নদীর তীরে বেলুন গ্রামে।

প্রায় ত্রিশ বিঘা জমির উপরে তৈরি হয়েছে জঙ্গল। এর পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তন্ময় ঘোষের। তন্ময়বাবু মূলত চিত্রগ্রাহক। তন্ময়বাবু জানান, পৃথিবীতে সংরক্ষিত অরণ্যে বাস করে প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি প্রাণী। সেখানে প্রাণীরা নিশ্চিন্তে বসবাস করে। কেউ শিকার করে না। এই বেলুনে সে রকমই সংরক্ষিত অরণ্য তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে অরণ্যের মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বাস ছিল, এমন অরণ্য তৈরি করা সম্ভব হলে তা বন্যপ্রাণীদের নিশ্চিত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। বছর দশেক আগে এই কাজ শুরু হয়। লাগানো হয় খুদিজাম, কদম, জিলাপি ফল, শিমুল, বকুলের মতো গাছ। কেন এই সব গাছ বেছে নেওয়া হল? কারণ, এই অঞ্চলে প্রায় ৪৭টি প্রজাতির পাখির আনাগোনা রয়েছে। আর তাদের বসবাস থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্য এই গাছগুলি উপযুক্ত। কিন্তু শুধু অরণ্য গড়েই কাজ শেষ হয়নি। একই সঙ্গে সাড়ে সাত বিঘা জায়গার উপরে তৈরি হয় রিসর্ট। পোশাকি নাম ‘বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড কনজার্ভেশন অর্গানাইজেশন’। স্থানীয়দের কাছে যা ‘জলবাড়ি’ নামেই পরিচিত। চারটি ঘরের রিসর্ট অন্যরকম। প্রকৃতির সঙ্গে পর্যটকদের নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করাই মূল উদ্দেশ্য। শৌচাগারটিও বেশ অন্যরকম। এর মাথা অর্ধেক ফাঁকা। বৃষ্টি নামলে সেই জলে স্নান করার সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা। এখানে ব্যায়াম কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা আছে বলে জানান তন্ময়বাবু।

এই দশ বছরে জলবাড়ির অরণ্য ও আশপাশ নানা প্রাণীতে ভরে উঠেছে। এখানে প্রায় ১৮০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা মেলে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। জলবাড়ির লেকেই রয়েছে ৩৪টি প্রজাতির দেশি মাছ। তবে এই অঞ্চলের মূল আকর্ষণ পাখি। ২৫০টি প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত সাদা ফিতে লেজের দুধরাজ, পাঁচ রঙের ইন্ডিয়ান পিট্টা, পাঁচ রকমের প্যাঁচা, শুকনো পাতার রঙের নাইটজার, নীল লেজের বাঁশপাতির দেখা মেলে। আবার জুলাই থেকে অক্টোবরে বেলুনের পাশেই অট্টহাসে আসে ফ্রুট ব্যাট, শামুকখোল। আর নভেম্বরের শেষ থেকেই মধ্য এশিয়া, সাইবেরিয়া, তিব্বত, লাদাখ থেকে চখাচখি, গ্রেল্যাস গুস, গ্যারোয়াল, বার হেডেড গুস, কুট, সোভলারের মতো পরিযায়ী পাখিরা আসতে শুরু করে। বাসা বাঁধা, ডিম পাড়া, বাচ্চা ফোটার পরে মার্চের দিকে পাখির দল ফিরে যায়।

এখানে এলে শুধু জলবাড়িতে সময় কাটাতে হবে এমন নয়। চলে যেতে পারেন বেলুন থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শাঁখাই-এ। যেতে পারেন নতুনগ্রামে গঙ্গার ডলফিন, ঘড়িয়াল, গাঙ্গেয় হাঙর, মিষ্টি জলের শংকর মাছ দেখতে। এখান থেকেই নানা জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। রাতে দেখতে পাওয়া যায় বনবিড়াল, ভোঁদড়দের। এ সবের পাশাপাশি মুসুম্বি, কামরাঙা, লিচু, আনারসের মতো ৪০ রকমের ফলের গাছ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এলাকায় পাঁচ বছরে আরও অনেক ফলের গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তন্ময়বাবু। তাঁর কথায়, “এই প্রকল্পে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। যেমন, একটি পাতিলেবু গাছে বছরে কয়েক হাজার লেবু মেলে। এতে গ্রামবাসীদের চাহিদা মিটবে। প্রতি আট মাসে ইঁদুর কয়েক হাজার টাকার ফসল নষ্ট করে। বনবিড়াল দিনে পাঁচটা করে ইঁদুর খায়। জমির পোকা খেয়ে ফসল বাঁচায় পাখিরা। এ ভাবেই এখানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে।”

প্রকৃতি দর্শনের পাশাপাশি এলাহি পেটপুজোর আয়োজনও রয়েছে এখানে। সবটাই ‘অর্গানিক ফুড’। রামতুলসীর পাতার রস দিয়ে এখানে সকাল শুরু হয় পর্যটকদের। বিনা কীটনাশকে চাষ করা বাঁশকাঠি চালের ভাত, শুক্তোর সঙ্গে কচি পাঁঠার ঝোলের মতো নানা সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে শীতে দেওয়া হয় উদ্ধানপুরের নলেন গুড়ের পায়েস এবং সন্দেশ। গুড় খাওয়াই নয়, গুড় তৈরিও দেখানো হয় পর্যটকদের।

চলতি বছরে রাজ্য সরকারের পর্যটন মেলায় ‘বেস্ট ইনোভেটিভ প্রজেক্ট অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার পেয়েছে এই জলবাড়ি। তবে বনভোজনের জন্য এ জায়গা নয়। তন্ময়বাবুর কথায়, প্রাণীরা বিরক্ত হবে এমন কাজ এখানে করা যাবে না। এমনকী সাপ, পিঁপড়েও মারাও বারণ। স্থানীয় বাসিন্দারাও এ সব মেনে চলেন। নিঃশব্দে প্রকৃতিকে পরতে পরতে ছুঁতে ঘুরে আসতেই পারেন বেলুনের ‘জলবাড়ি’তে।

Belun Belun Eco Village travel Burdwan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy