Advertisement
E-Paper

ব্যাঘ্রান্বেষণে তাড়োবার জঙ্গলে

পেছনে তাকিয়ে দেখি আমাদের হাত ছয়েক দূরে একটি বাঘিনি হেঁটে বেরোলো ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। মহারাষ্ট্রের বাঘ-বন ঘুরে কলম ধরলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য।

সব্যসাচী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৭ ১৬:১৪

সারা ভারতে ৪৪টি ব্যাঘ্র প্রকল্প আছে, যেগুলিতে ‘এনটিসিএ’ এবং ‘ডব্লিউআইআই’-এর (ন্যাশনাল টাইগার কনসারভেশন অথরিটি এবং ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া) তত্ত্বাবধানে চলছে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। প্রতিটি রাজ্যে, প্রত্যেকটি ব্যাঘ্র প্রকল্পের নিজস্ব একটা ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ আছে। তাদের কর্মকাণ্ড চলে ২৪ ঘণ্টা। তাদের কোনও ছুটি নেই। এই ৪৪টি প্রকল্পের অনেকগুলিতেই আমাদের ঘোরা হয়ে গেছে। অনেকগুলিতে হয়নি। না-ঘোরা প্রকল্পগুলির মধ্যে একটা ছিল মহারাষ্ট্রের ‘তাড়োবা’। তাই যখন আমাদের বন্ধু চন্দ্রমৌলি ঠাকুর প্রস্তাব দিল যে তাড়োবা যাওয়ার কথা ভাবছে, আমরা তখনই রাজি হয়ে গেলাম। আমরা বলতে, আমাদের বন্ধু চিত্রভানু বসু আর আমি। আমাদের সঙ্গে নাকি অনেকে যাবে। প্রায় ২৫ জনের একটা দল। চেনা-জানা বলতে ৪/৫ জন, বাকি সবাই অচেনা। তবে অচেনা সেই অর্থে বলা যায় না। যাঁরা জঙ্গলে বেড়াতে ভালবাসেন, তাঁদের সবাইকে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী প্রেমিক হিসেবে চিনি। আমি তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে না চিনলেও, তাঁরা অনেকেই আমাকে চেনেন প্রকৃতি পর্যটক ও ফটোগ্রাফার হিসাবে। দুটো কাজেই অবশ্য আমি ছাত্র।

আমাদের দলে অনেকে ছিলেন ডাক্তার। তাঁরা একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরাও মাঝে-মধ্যেই জঙ্গলে বেড়াতে যান। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ভাল ফটোগ্রাফারও বটে। চিকিৎসক তন্ময় দাস ও চন্দ্রাশিস চক্রবর্তী ছিলেন, যাঁরা পেশাদার ফটোগ্রাফারের মতো ছবি তোলেন। তথাগত দাস, প্রদীপ সিংহ ও অঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। এ ছাড়াও সর্বাণী মল্লিক, অতনু মল্লিক, পার্থসারথি দত্ত, মিত্রা দত্ত, রথীন্দ্রনাথ ঘোষ, মালা ঘোষ ছিলেন। আমাদের শিলিগুড়ির বন্ধু ও বেড়ানোর সঙ্গী দীপজ্যোতি চক্রবর্তী যেই শুনল তাড়োবার কথা সে-ও সামিল হয়ে গেল আমাদের দলে। মোট দাঁড়াল ২৪ জন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল স্বসরা রিসর্টে। ঠিক হল, আমরা ট্রেনে যাব নাগপুর, সেখান থেকে গাড়িতে তাড়োবা। ফেরাটা হবে আবার গাড়িতে নাগপুর, সেখান থেকে প্লেনে কলকাতা। জঙ্গলে যাওয়ার এবং ছবি তোলার সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে গরমকাল, যখন পশুপাখিরা জলের খোঁজে জঙ্গল থেকে বেরোয়। জলাশয়ের ধারেকাছে অপেক্ষা করলে, তাদের দেখা মিলবেই। তাই ঠিক হল, আমরা ১৭ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে যাব। কারণ, ১৮ ছিল গুড ফ্রাইডে, ১৯ শনি আর ২০ ছিল রবিবার। ১৭ এপ্রিল দুপুর ২টোয় হাওড়া ছেড়ে আমরা নাগপুর পৌঁছে যাব ১৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায়। সেখান থেকে ১০৫ কিলোমিটার গাড়িতে, আড়াই ঘণ্টায় আমাদের রিসর্টে পৌঁছে যাব। অর্থাৎ দুপুরের খাওয়ার আগেই। ১৮ই বিকেলে জঙ্গলে ঘোরা, ১৯ সকাল-বিকেল, ২০ সকাল-বিকেল, ২১ সকালটা ঘুরে বিকেলে নাগপুর থেকে ফ্লাইট। তাতে ছ’বার জঙ্গল ঘোরা হয়ে যাবে।

জঙ্গল ঘোরার জন্যে পাঁচ খানা জিপসি কলকাতা থেকেই বুক করা হয়ে গেল। প্রতিটি গাড়িতে ৫ জন করে। ‘নিকন কোম্পানি’র সঙ্গে কথা বলে আমার জন্যে একটা ডি৪ ক্যামেরা বডি আর একটা ২০০-৪০০ এফ৪ লেন্সের ব্যবস্থা হয়ে গেল। নিকন কোম্পানির সৌম্যজিৎ মৈত্র আমাকে ক্যামেরা আর লেন্সই শুধু দিলেন না, সঙ্গে ব্যাটারি, চার্জার, লেন্স বহন করার ব্যাগ আর একটা এক্স কিউ ডি কার্ড-ও দিলেন। আমি মহানন্দে বেরিয়ে পড়লাম। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে নাগপুর পৌঁছলাম। গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ২৪ জনে বেরিয়ে পড়লাম। মাঝপথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে প্লাস্টিক ঢাকা কাঠের খুপরি দোকানে চা খেলাম। দুপুর ১২টা নাগাদ স্বসরা রিসর্টে পৌঁছলাম। ৩টের মধ্যে তৈরি হয়ে জিপসি গাড়িগুলোতে চড়ে পড়লাম। রিসর্টটা ‘কোলারা’ গেটের কাছে, তাই সেখান দিয়েই ঢোকা হল। সকলকেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে গরমে অস্বস্তি এড়াতে টুপি আর গামছা যেন অবশ্যই সবাই নেয়। তাই দুপুর ৩টে-সওয়া ৩টের গরমে সকলেই মাথা আর মুখ ঢেকে রেখেছিলাম। ছোট ক্যামেরার জন্য টাকা দিতে হয় না, কিন্তু ২৫০ মিলিমিটার ও তার থেকে বড় লেন্সের ক্যামেরা থাকলে ১০০ টাকা প্রতি ক্যামেরা দিতে হয়। এই টাকাটা হচ্ছে গাড়ির প্রবেশমূল্য আর ট্যুরিস্ট প্রবেশ মূল্য বাদ দিয়ে। কোলারা গেটে কাগজপত্রের কাজ শেষ করে গাইডকে তুলে নিয়ে ঢুকে পড়লাম তাড়োবা ব্যাঘ্র প্রকল্পে। বলে রাখি, এখানে নিজের ছবি-সহ পরিচয়পত্র না দেখালে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

ঢুকে পড়তেই সেই রোমাঞ্চ অনুভব করতে আরম্ভ করলাম। ঘন জঙ্গল, তবে উত্তরবঙ্গের মতো নয়। গাইড তাড়োবার ইতিহাস বলতে আরম্ভ করলেন। ‘তাডু’ নামে এক মহাপুরুষ এই জঙ্গল ও পশুপাখিদের রক্ষা করার ব্রত নিয়েছিলেন। তাঁকে মানুষ শ্রদ্ধা করত, সম্মান করত। এমনকী, রাজা-উজিররাও। তাঁর প্রাণ যায় একটি বাঘের কবলে পড়ে। তাঁর স্মরণেই এই ব্যাঘ্রপ্রকল্পের নামকরণ। ব্যাঘ্র প্রকল্পটি ৬২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। এর ২০ শতাংশ এলাকায় পর্যটকেরা ঘুরতে পারেন, বাকিটা ‘কোর এরিয়া’ হিসেবে সংরক্ষিত। এই অঞ্চলটা এক সময় ‘গোন্ড’ রাজাদের অধীনে ছিল। তাঁরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলাফেরার জন্য ১০০-১৫০ মিটার অন্তর একটি করে মিনার তৈরি করেছিলেন পথ-নির্দেশিকা হিসেবে। না হলে রাস্তা হারিয়ে ফেলার ভয় থাকত। সেই মিনারগুলোর পাশ দিয়েই, কিছু গাছ কেটে এখনকার রাস্তাগুলো তৈরি হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই ভেতরের অনেক বসতি ও গ্রামকে বাইরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেই অঞ্চলগুলোকে প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। গ্রামের লোকজন এই পুনর্বাসন মেনে নিয়েছেন, কারণ, প্রথমত সরকারের তরফে তাঁদের যা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে সেটা যথেষ্ট, দ্বিতীয়ত, তাঁরা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে জড়িত। তাঁদের মাটির ঘরগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে আর পাকা বাড়িগুলোতে বনরক্ষীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। জলের জন্য যে সব কুয়ো খোঁড়া হয়েছিল, সেগুলোই জলের চাহিদা মেটাচ্ছে। এক-আধ জায়গায় ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের থাম ও তার এখনও আছে, সেগুলোকে শুনলাম সরিয়ে ফেলা হবে। এই জঙ্গলে ঢোকার আরও দুটো গেট আছে। মোহারলি গেট আর তপাসনী নাকা (নাওয়েগাঁও গেট)। প্রথম দিন বিকেলে আমরা খুব একটা দৌড়োদৌড়ি না করে পাণ্ডারপৌনি লেকে গেলাম, যেখানে নাকি পি২ নামক বাঘিনি থাকে। গিয়ে দেখলাম লেকের মাঝখানে একটা দ্বীপ আছে, সেই দ্বীপের মাঝখানে একটা বিশাল ঝোপ। শুনলাম, সেই ঝোপের নীচেই নাকি পি২ শুয়ে আছে। অনেক গাড়ি অপেক্ষা করছে তার দর্শনের। এত মাছি উড়ছিল আর হাতে, মুখে, চোখে, নাকে বসছিল যে ৭/৮ মিনিট পর আমরা পালিয়ে গেলাম, পরে আসব ঠিক করলাম। এই মাছিগুলো সাধারণ মাছি নয়, একটু বড় এবং লম্বাটে গোছের। আমার মনে হল যেখানে ঘাম পাচ্ছিল, সেখানেই বেশি বসছিল।

পান্ডারপৌনি লেকের পাশেই একটু দূরে একটা ডোবা আছে। অনেকগুলো গাছের মাঝে একটা সরু জলের ধারা এসে একটা ডোবা তৈরি হয়েছে। জায়গাটা এত ঠান্ডা যে মনে হচ্ছিল সেখানেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করি। যে গাছগুলো ছায়া তৈরি করেছিল, সেই গাছগুলোর উঁচু ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম অজস্র মৌচাক। প্রত্যেকটি মৌচাকে অসংখ্য মৌমাছি। বুঝলাম সেখানে বেশি ক্ষণ থাকাটা সমীচীন হবে না। কোনও কারণে তারা বিরক্ত বোধ করলে...! আরও খানিকটা এগিয়ে, রাস্তাটা এক বার বাঁ দিকে ঘুরল, এক বার ডান দিকে, তার পরেই আর একটা ছোট জলাশয়। গাইড বললেন, ‘পান্ডারপৌনি লেক-২’। এটি আগের লেকের তুলনায় ছোট, কিন্তু অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। প্রায় সব দিকই গাছপালায় ঘেরা। অর্থাৎ, যে কোনও দিক থেকেই জন্তু-জানোয়ার বেরোতে পারে। একটা সম্বর দেখলাম, সে কাদা মাখল। একটা বিরাট শিংওয়ালা চিতল হরিণ দেখলাম আর কিছু পাখি। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম তাড়োবা লেক। বিশাল লেক। এ পার ও পার প্রায় দেখাই যায় না। এই লেকটার শুধু একটা দিকেই ঘোরার অনুমতি আছে। বাকি তিন দিক পর্যটনের জন্য বর্জিত। তবুও জলাশয় তো। অনেক হরিণ, বুনো কুকুর, পাখি, হনুমান আর একটা কুমির দেখতে পাওয়া গেল। একটা বাজপাখিকে দেখলাম লেকের জলে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খাচ্ছে। ব্যস, সূর্য ডোবার পালা। আমরাও গেটমুখো হলাম।

একটা ছোট টিলার ওপর দিয়ে গাড়িটা যেতে যেতে হঠাৎ ‘ঘটাং’ করে আওয়াজ হল! আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। চালক আর গাইড নেমে গাড়ির নীচে ঢুকে কী যেন দেখল, তার পর বলল, ‘লিফ-স্প্রিং ভেঙে গেছে’। আমরা মুখে বললাম, ‘তা হলে?’ মনে মনে বললাম, ‘অসাধারণ। এই তো চাই!’ ওরা বলল, ‘একটা ফোন করি। অন্য গাড়ি পাঠাতে বলি।’ তারা তাদের সেলফোন নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিল। খানিক পর বলল, ‘নেটওয়ার্ক নেই। পাচ্ছি না।’ আমাদের কারও ফোনেই সার্ভিস ছিল না। শেষে চালক আর গাইড ঠিক করল, হেঁটে কিছু দূর গিয়ে অন্য বাহিরমুখো একটা গাড়িকে বলে আসবে। আমাদের বলল, আমরা যেন গাড়ি থেকে না নামি। এই বলে ওরা হাঁটা দিল। আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। খানিক বাদে সূর্য ডুবল। চারদিক থেকে কিছু ঘরে ফেরা পাখি আর বিভিন্ন পোকামাকড়ের ডাক শুরু হল। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা!

জঙ্গলে আমরা খোলা জিপসিতে বসে। কোথাও কেউ নেই। আমি আমার ক্যামেরার আইএসও-টা একটু বাড়িয়ে নিলাম। অর্থাৎ কম আলোতে ছবি উঠলেও উঠতে পারে, এমন করে নিলাম। যদি কোনও প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। সামনের রাস্তার ছবি তুললাম। গাইড আর চালক ফিরে আসা পর্যন্ত কোনও পশু-পাখি দেখতে পেলাম না। এমনকী, তার পরেও না। গাইড বলল, একটা ফিরতি গাড়িকে মেন গেটে খবর দিতে বলে দিয়েছে। হঠাৎ একটা আওয়াজ পাওয়া গেল ডান দিকের খাদের দিক থেকে। গাইড বলল, ‘ভালু’। কিন্তু অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরও কিছু দেখা গেল না। মেন গেট থেকে একটা গাড়ি পাঠানো হল। সেটা যত ক্ষণে এল, তত ক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। তার হেডলাইট জ্বালিয়ে আমাদের জিপসি গাড়িটার লিফ-স্প্রিং মেরামত করা হল, তার পর আমরা আবার রওনা হলাম। মেরামত মানে, ওই আর কি, জোড়াতালি দিয়ে চালানো। রিসর্টে পৌঁছতে রাত ৮টা বেজে গেল। তবে যে অভিজ্ঞতা হল তা ভোলার নয়। ফিরে এসে শুনলাম অনেকেই নাকি বাঘ দেখেছে। আমরা বললাম, ‘আমরা অন্ধকার হওয়া দেখেছি! যেটা কেউ দেখেনি’।

পর দিন ভোর ৬টায় আমরা গাড়িতে চড়ে কোলারা গেটে হাজির। ম্যানেজার সাহেব গেটে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে গেলেন রিসর্টে। আবার মেন গেট দিয়ে ঢুকে আমরা সেই জঙ্গল আর স্তম্ভগুলো দেখলাম। নতুন গাইড জেনে নিলেন, সেটা আমাদের প্রথম ঢোকা, নাকি আগেও ঢুকেছি। তাই তাড়োবার ইতিহাসের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বলতে লাগলেন। বাঘেদের সংখ্যা, কী কী পশুপাখি পাওয়া যায়, জাতীয় উদ্যানের আয়তন ইত্যাদি। এমনকী, আমাদের কথাও জানতে চাইলেন। নানা রকম আলোচনা করতে করতে আমরা রাস্তার ধারে বাইসন দেখলাম। গাছে গাছে নানা ধরনের পাখি দেখলাম। অনেক হনুমান ও তাদের বাচ্চাদের দেখলাম। আবার পৌঁছলাম পান্ডারপৌনি লেকের পাশে। বাঘিনির দেখা নেই, কিন্তু চিতল হরিণ, সম্বর ও হাটিটি পাখির দেখা পেলাম। এই প্রথম আমরা হাটিটি পাখির বাচ্চা দেখলাম। সেখানে ভিড় বাড়তে থাকায় আমরা অন্য জায়গায় চলে গেলাম। জঙ্গল ঘুরে নীলকণ্ঠ পাখি, বাজপাখি, মৌটুসি, মাছরাঙা, বুনো কুকুর আর নীলগাই দেখলাম। শেষে গাইড বলল, আমরা পান্ডারপৌনি লেকের কাছে ফিরে যাই। বাঘিনি পি-২ আজ বেরুতে পারে। আমরা তার কথায় সায় দিলাম। পান্ডারপৌনি লেকে ফিরে আসার ১০ মিনিটের মধ্যে বাঘিনি পি-২ বেরলো। আমাদের গাড়ি থেকে বিশ হাত দূর দিয়ে হেঁটে গিয়ে, সে মাঠ পেরোতে লাগল। আমরা চটপট গাড়ি ঘুরিয়ে মাঠের অন্য দিকে পৌঁছে গেলাম। বাঘিনি আমাদের থেকে প্রায় ১৫০ ফুট দূর দিয়ে হেঁটে গিয়ে আর একটা গাড়ির পাশ দিয়ে বাঁ দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। সেখানে নাকি একটা হরিণ মেরে অর্ধেক খেয়ে রাখা আছে। তাড়োবা লেক ঘুরে আরও কিছু ছবি তুলে আমরা ফেরা শুরু করলাম। আমাদের সে দিনের জঙ্গল ঘোরা সার্থক হয়ে গেল।

ফিরে রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেলাম লাঞ্চ করতে। সকলের অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল। বুঝলাম আমরাই সবচেয়ে কম ছবি পেয়েছি, বাকিদের অভিজ্ঞতা ও ছবি অনেক ভাল। রেস্তোরাঁর বাইরে একটা ডিসপ্লে বোর্ড আছে, যাতে লেখা হয় কে কী দেখল। তাতে দেখলাম, এক দল লোক ভালুকের দেখা পেয়েছে। আমার অল্প হিংসে হল। লাঞ্চ শেষে ঘরে ফিরে এলাম। আবার ব্যাগ গুছিয়ে ৩টে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। সেই গাড়ি, তবে অন্য গাইড। গেটের কাছে আমাদের দেখে বন দফতরের কর্মীরা হাত নাড়লেন। ভাবলাম, হঠাৎ কী হল? তার পর শুনলাম, তাঁরা দুপুরে নাকি ‘খাকি’ ছবিটা টিভি-তে দেখছিলেন, তাই অভিনন্দন জানালেন। আমিও হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। আবার পান্ডারপৌনি লেক ১ এবং ২। বুনো কুকুর, সম্বর, চিতল, নানা রকম পাখি ও হনুমান। সূর্য ডোবার সময় হলেই আবার ফেরা শুরু। ফিরে এলাম রিসর্টে। একটা চারদিক খোলা বসার জায়গায় সবে চা কফি এবং ঠান্ডা পানীয় খেতে শুরু করে দিল লোকজন, এমন সময় হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া শুরু হল। তার পরেই বিদ্যুৎ চমকানো এবং অঝোরে বৃষ্টি। কী অপূর্ব যে লাগছিল সেটা ভাষায় বোঝাতে পারব না। মাঝে মাঝে কাছে-পিঠে বজ্রপাত হওয়ায় একটু চমকেও উঠছিলাম। ঠান্ডা হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট দারুণ উপভোগ করছিলাম। ঘণ্টাখানেক চলে থামল। আমরাও ঘরে ফিরে গেলাম। সে রাত্রেও খাবারটা আমাদের ঘরেই পাঠিয়ে দিলেন ম্যানেজারবাবু।

আগের রাতে বৃষ্টি হওয়াতে, পর দিন ভোরটায় গরম কম ছিল। আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। আবার নতুন গাইড, আবার গেটে হাত নাড়া। সে দিন রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় জল জমে ছিল, তাই জায়গায় জায়গায় পাখিদের স্নান করা দেখতে পেয়ে গেলাম। বুনো শুয়োর, বেজি, হরিণ ইত্যাদির ছবি তুলে, আমরা আবার পান্ডারপৌনি লেকে পৌঁছে হাঁসের দল দেখতে পেলাম। এক জায়গায় বাকির্ং ডিয়ার পেলাম। নানা রকম পাখি আর পশুদের ছবি তুলে সময় কেটে গেল। হঠাৎ গাইড বলল, তেলিয়া লেক যাওয়া যাক।

তেলিয়া লেকের কথা আগেও শুনেছি। তন্ময় দাশ ও চন্দ্রাশিস চক্রবর্তী ওখানে নাকি বাঘের ছবি পেয়েছেন। জায়গাটা নাকি ভারী সুন্দর। অপূর্ব একটা সুন্দর রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে নাওয়েগাঁও গেটে পৌঁছলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রাতরাশ করে আবার ফিরে এসে তেলিয়া লেকে পৌঁছে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন একটা লেক, যেখানকার পাড়গুলোয় নানা রঙের ঘাস দেখলাম, যা জীবনে কখনও দেখিনি। আমরা লেকের পুব দিকে এগিয়ে গিয়ে, ঘুরে পশ্চিম দিকে পৌঁছলাম। বেশ কয়েকটা চিতল হরিণের ছবিও তুললাম। হঠাৎই তারা অশান্ত হয়ে উঠল। আমাদের চালক গাড়িটাকে পিছিয়ে নিলেন। ভাবছিলাম, কী করছেন তিনি? হঠাৎ তিনি পিছন দিকে হাত দেখিয়ে বলে উঠলেন ‘টাইগার’। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমাদের হাত ছয়েক দূরে একটি বাঘিনি হেঁটে বেরোলো ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে। অত কাছ থেকে বাঘিনি দেখে একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। গাইড গাড়িটা এগিয়ে নিতে চাইছিল। যাতে আমরা বাঘিনির সামনে থেকে ছবি পাই। আমি তাকে বারণ করলাম। বাঘের রাস্তা আটকালে কখনও কখনও তারা অন্য দিকে ঘুরে যায়। এটা ধারণা ছিল। তাই পেছন পেছন গেলাম, ছবিও পেলাম। তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। সেই বাঘিনি আমাদের সামনে সামনে প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে গেল, এক বার ঘুরে তাকালো, তার পর আরও কিছু দূরে এগিয়ে বাঁ দিকের মাঠে নেমে গেল সোজা তেলিয়া লেকের দিকে। সেখানে জলের মধ্যে বসে থাকল, জল খেল। আমরা অনেকগুলো ছবি পেলাম। তার পর বাঘিনিটি এক বার আমাদের দেখে নিয়ে লেক থেকে উঠে উল্টো দিকে, অর্থাৎ পুব দিকে চলে গেল। আমরাও বিজয়ীর মনোভাব নিয়ে ফিরতি পথে এগোলাম।

ফিরে রাতে এক বার আমাদের ঘরে একটা গ্রুপ ফটো আর দিনে রেস্তোরাঁর সামনে গ্রুপ ফটো তোলা হল। পর দিন সকালে জঙ্গলে একটা চক্কর মেরে বেশ কিছু ছবি তুলে প্লেন ধরার জন্য রওনা হয়ে গেলাম। নাগপুর থেকে প্লেন ধরে সোজা কলকাতা।

ধন্যবাদ মহারাষ্ট্র পর্যটন ও স্বসারা রিসর্টকে। বাঘ দেখার আরও অনেক জায়গা আছে। কিন্তু মনে হয়, তাড়োবা এখন বাঘ দেখার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান। তাড়োবা কিন্তু প্রতি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে যাবেন।

খুঁটিনাটি

স্বসারা রিসর্টের ঠিকানা: স্বসারা রিসর্ট। (কোলারা গেটের কাছে)। তাড়োবা-আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভ। চিমুর-৪৪২৯০৩, জেলা: চন্দ্রপুর, মহারাষ্ট্র। ওয়েবসাইট: svasararesorts.com

প্লেনে গেলে: নাগপুর (১০৫ কিলোমিটার)।

গাড়িতে: নাগপুর থেকে রাজ্য সড়ক ৯ ধরে উমরেদ, উমরেদ থেকে চিমুর, চিমুর থেকে রাজ্য সড়ক ২৩৩ ধরে রিসর্ট।

ট্রেনে: ওয়ারোরা (৫২ কিলোমিটার), চন্দ্রপুর (৯০ কিলোমিটার), নাগপুর (১০০ কিলোমিটার)।

সবচেয়ে ভাল সময়: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। ঠান্ডা থাকে (পাখি দেখার জন্য ভাল), মার্চ থেকে মে পর্যন্ত গরম থাকে (বাঘ দেখার জন্য ভাল)।

সঙ্গে রাখুন: গরমকালে টুপি, সানগ্লাস, মশা প্রতিরোধক, স্কার্ফ, হাল্কা জামাকাপড়। শীতকালে টুপি, সানগ্লাস, মশা প্রতিরোধক, মোটা জামা, জ্যাকেট বা সোয়েটার।

গাড়ি: জিপসি ভাড়া পাওয়া যায়। নিজের গাড়ি নিয়েও ঢোকা যায়। গাইড নেওয়া আবশ্যক। সচিত্র পরিচয়পত্র রাখতে হবে। প্রতি গাড়ির জন্য আলাদা ভাড়া।

ক্যামেরা: এর জন্য আলাদা চার্জ দিতে হবে।

Adventure Tours Travel Destinations Holiday Destinations Tourism Tourist Places Sabyasachi Chakraborty Tadoba Andhari Tiger Project সব্যসাচী চক্রবর্তী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy