Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অ্যাডভেঞ্চারের অন্য নাম ইয়েলোস্টোন

বিখ্যাত ফরাসি লেখক মার্সেল প্রুস্ত লিখেছিলেন, ‘দ্য রিয়েল ভয়েজ অব ডিসকভারি কনসিস্টস্ নট ইন সিকিং নিউ ল্যান্ডস্কেপস বাট ইন হ্যাভিং নিউ আইজ।’ তাঁর এই কথাটি ভীষণ তাত্পর্যপূর্ণ। এই যাত্রায় ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক না দেখলে হয়তো ‘এক্সপ্লোরিং দ্য ওয়ান্ডার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বাদটা অধরাই থেকে যেত! ইয়েলোস্টোনকে যদি শুধু বিস্ময় বলি, তা হলে অনেকটাই কম বলা হবে। আবার পৃথিবীর অনন্য বিস্ময়ের পীঠস্থান বললে, একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না!

ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে সূর্যাস্ত।

ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে সূর্যাস্ত।

অনিন্দিতা ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

বিখ্যাত ফরাসি লেখক মার্সেল প্রুস্ত লিখেছিলেন, ‘দ্য রিয়েল ভয়েজ অব ডিসকভারি কনসিস্টস্ নট ইন সিকিং নিউ ল্যান্ডস্কেপস বাট ইন হ্যাভিং নিউ আইজ।’ তাঁর এই কথাটি ভীষণ তাত্পর্যপূর্ণ। এই যাত্রায় ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক না দেখলে হয়তো ‘এক্সপ্লোরিং দ্য ওয়ান্ডার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বাদটা অধরাই থেকে যেত!

ইয়েলোস্টোনকে যদি শুধু বিস্ময় বলি, তা হলে অনেকটাই কম বলা হবে। আবার পৃথিবীর অনন্য বিস্ময়ের পীঠস্থান বললে, একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না!

ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ইয়েলোস্টোন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২-এ। বিচিত্র বাস্তুতন্ত্রওয়ালা এই পার্কটির নীচে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ‘সুপার ভলক্যানো’। ভূ-বিজ্ঞানীরা একে একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অসংখ্য উষ্ণপ্রস্রবণ, হৃদ, উপত্যকা, ঝরনা, ক্যানিয়ন, নদী, বন্যপ্রাণী— কী নেই এখানে! পার্কটির ব্যাপ্তি প্রায় নয় হাজার বর্গ কিলোমিটার।

এক শুক্রবার রাতে ডেনভার থেকে গাড়িতে আমরা ছয় জনের একটি দল ইয়েলোস্টোনের উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। পর দিন সকাল প্রায় ১১টা নাগাদ পৌঁছলাম গ্র্যান্ড টেটনের প্রবেশপথে। ইয়েলোস্টোনে প্রবেশ করার অনেকগুলি গেট রয়েছে। কিন্তু, আমরা যে দিক দিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে ঢোকার মুখেই পড়েছিল গ্র্যান্ড টেটন। সুতরাং এই পার্কের দু’-তিনটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান, যেমন জেনি লেক, জ্যাকসন লেক দেখে আমরা প্রবেশ করলাম আমাদের বহু প্রতিক্ষিত সেই জায়গায়।

ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের একটি উষ্ণপ্রস্রবণ।

সকালের ঝলমলে আলো গায়ে মেখে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ পথ দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ঢুকছে, সবার চোখমুখে তখন বিনিদ্র রাতের ক্লান্তির মেঘ কেটে বৃষ্টিশেষে প্রথম রোদ্দুরের মতন।

ঠিক হল, পুরনো ফেইথফুল উষ্ণপ্রস্রবণ দিয়েই দেখা শুরু করব। গাড়ি রেখে অল্প কিছুটা হেঁটেই চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ এক অনুর্বর জমি। সেখানে রয়েছে উঁচু ঢিপির মতো কিছু জায়গা, সেগুলোর মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বিস্তৃত এলাকায় গোল করে ঘিরে দুই সারি বেঞ্চ পাতা রয়েছে। এ যেন কোনও প্রদর্শনী চালু হওয়ার আগে কয়েক শ’ দর্শক অপেক্ষারত। শুধু যবনিকা পতনের অপেক্ষায়, হাততালির ঝড় তুলবে। উপস্থিত সবাই অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষারত সেই অবিস্মরনীয় মুহূর্তের।

একটি বোর্ডে লেখা রয়েছে, সম্ভাব্য কোন সময়ে এই পুরনো ফেইথফুল থেকে অগ্নুত্পাত হবে! কিন্তু, এ তো কোনও নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান নয় যে, ধরাবাঁধা নিয়মে চলবে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা, সুতরাং অপেক্ষার ফাঁকে লোকজন মশগুল তাদের আলাপচারিতায়। গরম থেকে একটু জিরোতে কারও মন আইসক্রিমে। কেউ বা সেই নৈসর্গিক মুহূর্তকে ফ্রেম-বন্দি করতে ক্যামেরায় চোখ রেখে অ্যাঙ্গেল ঠিক করতেই বেশি ব্যস্ত। হঠাত্ চার দিকের শোরগোল একবারে নিশ্চুপ। সময় হয়েছে। পাশ থেকে কে যেন ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘নাও।’ তার পরেই দেখলাম, সেই জাদুময় মুহূর্ত। সেই উঁচু ঢিপিগুলোর একটার মুখ থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়ার সঙ্গে গরম জল বেরিয়ে তৈরি করল একটা ফোয়ারা। ক্রমে বাড়তে লাগল তার উচ্চতা। প্রায় গগনচুম্বী। তত্ক্ষণাত নির্নিমেষ পতন। আশাহত সবার মুখ! ঠিক তখনই একটু দূরের আর একটি একই রকম ঢিপির মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। এবং আশপাশের আরও কয়েকটি ঢিপিতে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। কেউ যেন দমে যাওয়ার পাত্র নয়। প্রকৃতির নিজের খেয়ালে চলা অতুলনীয় নৈসর্গিকতার এ এক চূড়ান্ত উদাহরণ।

এই ঘটনার জন্য ইয়েলোস্টোনের নীচে সক্রিয় আগ্নেয়গিরিই দায়ী। ভূ-পৃষ্ঠের ফুটিফাটা দিয়ে যখন বৃষ্টি বা বরফগলা জল ওই আগ্নেয়গিরির সংস্পর্শে আসে তখন সেই ভৌম জল বাষ্পে পরিণত হয়। এর পরে প্রবল চাপে ওই ছিদ্রপথ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে নির্গত হয়। আর এর ফলেই এই ঘটনা ঘটে।

ম্যামথ উষ্ণপ্রস্রবণ।

আমাদের পরের গন্তব্য বিস্কিট বেসিন। এখানে রয়েছে কতগুলি ছোট ছোট লেক। এক একটির বিশেষ চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের এক এক রকম নাম। একটি জায়গায় মাটি, ম্যাগমা এবং লাভা মিলেমিশে অদ্ভুত এক রঙের সমন্নয়ে বিস্কিটের মতো আকার নিয়েছে। তাই হয়তো নাম বিস্কিট বেসিন। আর একটি ছোট থার্মাল ডোবার (আসলে ওগুলোর আকার এক একটা ডোবার মতোই) জলের রং নীলকান্ত মণির মতো নীল এবং স্বচ্ছ। তাই নাম স্যাফায়ার পুল। জল থেকে অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এ সব থার্মাল স্প্রিং বা পুল-এর কাছাকাছি দাঁড়ানো বা এর উপর তৈরী নির্দিষ্ট কাঠের পাটাতনের রাস্তা (যাকে এক কথায় বলে ট্রেইল) ধরে হেঁটে গেলেও এই জল ছোঁয়া কিন্তু নিষিদ্ধ। কারণ, এই জলের মধ্যে মিশে আছে অ্যাসিড। যার প্রভাবে পুড়ে যেতে পারে চামড়া। এমনকী, মৃত্যুর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সতর্কবাণী হিসেবে প্রতিটি সেতুতে ছবি এঁকে বলা হয়েছে, কেউ যেন ‘অফ দ্য ট্রেইল’ ধরে না হাঁটেন। এ ছাড়া স্প্রিঙের জলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বসবাস। তাদের জীবনযাত্রা যাতে কোনও ভাবে বিঘ্নিত না হয়, সে দিকেও রয়েছে সতর্ক নজর। পথে যেতে যেতে অনেক বন্যপ্রাণীর দেখা মিলল।

আর একটি দ্রষ্টব্য— গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিক স্প্রিং। চট করে দেখলে মনে হবে, কোনও শিল্পী ছবি আঁকতে আঁকতে তুলি ধুয়েছেন একটি পাত্রের জলে। রঙের সেকি বাহার! কী বৈচিত্র! বিশাল এক জলধারের কাচের মতো স্বচ্ছ জল থেকে বেরিয়ে আসছে বাষ্প। মাটির হলুদ রং, জলের তুঁতে নীল, সূর্যের আলোয় জলে ঝিকিমিকি— সব মিলেমিশে প্রকৃতি এখানে দরাজ ভাবে বিলোচ্ছে অফুরান সম্ভার। আর তার সাক্ষী আমরা।

গ্র্যান্ড টেটনের প্রবেশপথ।

পর দিন আমাদের গন্তব্য, নরিস গিজার বেসিন। ঠিক করলাম, এ বার আমরা পুরো ট্রেইল ধরে হাঁটব। হাঁটতে গিয়ে নজরে এল, সাধারণ পাথরের মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কোথাও বা কাদা টগবগ করে ফুটছে। সেই জায়গার নাম আবার ব্লু মাড স্টিম ভেন্ট। ট্রেইল ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় সাবধানবাণী নজরে এল, মাটি-পাথর থেকে ধোঁয়া ওঠা মানেই ওখানে নতুন গিজার জন্মাচ্ছে। তীব্র অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে নাক জ্বালা করছে। তা সত্ত্বেও চমকে উঠলাম। প্রকৃতির এই রূপ তো আগে দেখিনি! সে যে কী অস্থিরতা! তার সঙ্গে আমাদের বহু পরিচিত শান্ত, স্নিগ্ধ বসুন্ধরাকে যেন মেলাতে পারি না। পার্কের ভিজিটর সেন্টারে পড়া কিছু কথা মনে পড়ে গেল: ‘এখানে পৃথিবী ভীষন ভাবে জীবন্ত, যা কিনা এক কথায় অনবদ্য।’

ম্যামথ হট স্প্রিং-এ লাভা-ম্যাগমা মিলেমিশে সিঁড়ির ধাপ তৈরি করেছে। কোথাও বা হট স্প্রিং-এর জল সেই ধাপ বেয়ে নেমে আসছে। আবার কোথাও সেই ধাপগুলোতে আলো পড়ে তৈরি করেছে এক ভ্রম— ঠিক যেন জলের ধারা বয়ে চলেছে। ছোটবেলায় পড়া ভূগোল বইয়ের ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছি যেন। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, ঝরনা— এ সব চেনা ছকের বাইরে সেই অনুভূতি। আমরা হাঁটছি এমন এক জায়গার উপর দিয়ে, যার নীচে রয়েছে অতিসক্রিয় এক আগ্নেয়গিরি!

বিস্কিট বেসিন।

ক্যানিয়ন ভিলেজে দুপুরের খাওয়া সেরে আসার পথে ডারবান পাস হয়ে এলাম। নাতিউচ্চ এই জায়গা থেকে পার্কের মনমোহিনী দৃশ্য অসাধারণ। আপার-লোয়ার ফল্‌স এবং হেডেন উপত্যকায় যাওয়ার পথে সূর্যাস্ত, হোটেল ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে গাড়ির সামনে বাইসনের এসে পড়া— অ্যাডভেঞ্চার এবং রোমাঞ্চ মেশানো এক অসামান্য প্যাকেজের নাম ইয়েলোস্টোন সফর।

পর দিন সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে, শেষ দু’টি দ্রষ্টব্য স্থান ওয়েস্ট থাম্ব গিজার এবং ইয়েলোস্টোন লেকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। লেকটি সুবিশাল এবং প্রসারিত। অনায়াসেই একে সাগরের শান্ত এবং ছোট সংস্করণ বলা যায়। আর বেসিনে কিছুটা হেঁটে ফিরতেই হল একরাশ মন খারাপ নিয়ে।

টেক্সাসের হিউস্টনে স্বামীর কর্মসূত্রে থাকেন। রবীন্দ্রভারতী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা এবং ভ্রমণকাহিনি লেখা হবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE