Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
California

বরফে মোড়া মাউন্ট শ্যাস্টা

প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি নয় ক্যালিফর্নিয়ার এই পর্বত লাগোয়া লেক। এর জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে চমকপ্রদ তথ্য। লিখছেন মণিদীপা দাস ভট্টাচার্য

অপার্থিব: লেক সিসকিউয়ের ধারে

অপার্থিব: লেক সিসকিউয়ের ধারে

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:০২
Share: Save:

ঠিক এক বছর পরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বিগত প্রায় দশ মাস কার্যত গৃহবন্দি। আমি ও আমার স্বামী দু’জনেই ঘুরতে ভালবাসি। আমেরিকায় করোনার বাড়াবাড়ির জন্য বেড়াতে যাওয়ায় বিরতি দিতে হয়েছিল। কিন্তু ভয়-দ্বিধাকে সঙ্গী করেই এ বার ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। নভেম্বরের শেষে এক সপ্তাহব্যাপী থ্যাঙ্কসগিভিং হলিডে থাকে আমেরিকায়। করোনার কথা ভেবেই এমন জায়গা বেছে নিলাম, যেখানে অতিমারির দাপট কম। টিমে আমি, বর, পাঁচ বছরের ছেলে ও আমার দুই বোন। গন্তব্য ক্যালিফর্নিয়ার উত্তরে মাউন্ট শ্যাস্টা।

ফ্রিমন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৩০০ মাইল, রাস্তায় দু’বার কফি ব্রেক নিয়ে পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় ৫ ঘণ্টা। থাকার জন্য এয়ার বিএনবির হোমস্টে বুক করা ছিল ডান্সমিয়ার নামে ছোট্ট শহরে। যাওয়ার পথে রেডিং শহরে সান ডায়াল ব্রিজ দেখে যখন আস্তানায় পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে সন্ধে সাতটা। শীতের সময় বলে তাড়াতাড়ি অন্ধকার। তাই শেষের দিকের যাত্রাপথের কোনও দৃশ্যই দেখার সুযোগ পেলাম না। বাইরের তাপমাত্রা তখন প্রায় ৫ ডিগ্রি। ডান্সমিয়ার শহরে আমাদের থাকার জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে দেখতে পেলাম, সব বাড়ি ক্রিসমাসের আলোয় সাজানো। আমার ছেলে বেশ মজা পেল। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই দরজার হাতল থেকে ঘরের বেশ কিছু জায়গা স্যানিটাইজ় করলাম। তার পর রাতের রান্নার আয়োজন। গরম গরম মাংস-ভাত খেয়ে সে দিন রাতে বাড়িতেই বিশ্রাম।

পর দিন ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে প্রথম চমক, পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে সুপ্রভাত বলছে সাদা বরফের চাদরে মোড়া মাউন্ট শ্যাস্টা। করোনাভীতি যেন নিমেষে উধাও। এখানে বলে রাখি, মাউন্ট শ্যাস্টা একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। উচ্চতা ১৪১৮০ ফুট, ক্যালিফর্নিয়ার পঞ্চম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয় ১৭৮৬ সালে।

আগ্নেয়: মাউন্ট শ্যাস্টার পথে

আগ্নেয়: মাউন্ট শ্যাস্টার পথে

প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শ্যাস্টা ক্যাভার্নসের উদ্দেশে। ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করে যথাস্থানে টিকিট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ম্যাকক্লাউড পর্বতের ভিতরে অবস্থিত এই গুহা ‘চক কেভ’ বা ‘বার্ড কেভ’ নামে পরিচিত। গুহার বয়স প্রায় ২০ কোটি বছর। সেই গুহার অভ্যন্তরে আমরা ঢুকব! ভেবেই বেশ শিহরন অনুভব করলাম! পাহাড়ের ধার বেয়ে একটা ছোট্ট বাস আমাদের এবং আরও জনা পাঁচেক মানুষ নিয়ে এগিয়ে চলল।

বাস যেখানে থামল, সেই জায়গা দেখে ভুলে গেলাম গৃহবন্দি দিনযাপনের যন্ত্রণা। সামনে নীল জলের শ্যাস্টা লেক যেন কোলজুড়ে রয়েছে ম্যাকক্লাউডের। এই লেকটি প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়নি। স্যাক্রামেন্টো নদীর উপরে অবস্থিত শ্যাস্টা ড্যাম নির্মাণ করতে প্রায় সাত বছর সময় লাগে। আর এই বাঁধের জল জমেই তৈরি হয় লেক শ্যাস্টা। অবাক করা তথ্য হল, এই হ্রদের জলে ডুবে যায় কেনেট নামের আস্ত একটি শহর (১৯৪৪)! সেই শহরের মানুষদের আগেই নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাস থেকে নেমে কেভ অবধি পৌঁছলাম একটি স্টিমারে চড়ে। এই স্টিমারে যাত্রার বর্ণনা হয়তো ভাষায় বোঝাতে পারব না! প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্য ঢেলে সাজিয়েছে লেক আর পাহাড় জুড়ে। যে দিকে তাকাই, সে দিকেই পাহাড়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ। আমার মনের ভিতর তখন উত্তেজনার ঠান্ডা স্রোত। একটি কমবয়সি মেয়ে আমাদের গাইড হয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তার সঙ্গেই আমরা ঢুকলাম ক্যাভার্নসের ভিতরে। গুহার ভিতরে ঢুকতেই ছোটবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুপ্তধন’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। চার দিকে অন্ধকার, তার মধ্য দিয়ে রাস্তা করা পর্যটকের জন্য। ৮০০ সিঁড়ি ভেঙে ভিতরের সৌন্দর্য দেখলাম। পায়ে হেঁটে ৯০০ ফুট অতিক্রম করে গুহার অপর প্রান্তে পৌঁছলাম। বদ্ধ গুহার ভিতরে মাস্ক পরে অত সিঁড়ি ভাঙতে একটু কষ্ট হয়েছিল বইকি!

ভয়ঙ্কর সুন্দর: শ্যাস্টা ক্যাভার্নস

ভয়ঙ্কর সুন্দর: শ্যাস্টা ক্যাভার্নস

পরের গন্তব্য লেক সিসকিউ। পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় ২ ঘণ্টা। দিনের আলো ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। পাহাড়ের গা বেয়ে সন্ধে নামার আগে সেখানে পৌঁছলাম। বাইরের তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি। খানিকটা জঙ্গলের পথ পেরিয়ে যখন লেকের ধারে পৌঁছলাম, তখন আর এক চমক। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। তার আলোয় চিকচিক করছে লেকের জল, আর দূরে বরফে ঢাকা মাউন্ট শ্যাস্টা...

সেই মায়াবী চাঁদের আলো দেখে আমি আর আমার বোন গান ধরলাম, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে... ’ আশপাশে জনমানব নেই। মনে হল, এই তো আমার দিকশূন্যপুর, যা খুঁজে চলেছি বহু দিন ধরে। সেই চাঁদের হাসি, লেকের জল আর বরফ ঢাকা পাহাড় মনের ভিতরে গেঁথে ফিরে এলাম আবার ইট-কাঠ-পাথরে মোড়া জনজীবনের মধ্যে। তবে কথা দিয়ে এলাম, আবার যাব...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

usa tourism California
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE