Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বরফে কীসের ছাপ

ঘরের পুব দিকের দেওয়াল জোড়া জানলার বাইরে থেকে আওয়াজটা আসছে। অনেকটা জানলার বাইরে কাঠের ফ্রেমে বা কার্নিশে আঁচড় কাটার আওয়াজ। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে ফেরার সময় যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে দেখছিলাম, এটা তার আওয়াজ নয়তো? বিনসর ঘুরে এসে লিখছেন বিতান সিকদার।ঘরের পুব দিকের দেওয়াল জোড়া জানলার বাইরে থেকে আওয়াজটা আসছে। অনেকটা জানলার বাইরে কাঠের ফ্রেমে বা কার্নিশে আঁচড় কাটার আওয়াজ। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে ফেরার সময় যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে দেখছিলাম, এটা তার আওয়াজ নয়তো? বিনসর ঘুরে এসে লিখছেন বিতান সিকদার।

রেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে মেঘে ঢাকা নন্দাদেবী।

রেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে মেঘে ঢাকা নন্দাদেবী।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ১৬:৩৫
Share: Save:

স্থান: কাঠগোদাম থেকে প্রায় একশো কুড়ি কিলোমিটার দূরে বিনসর অভয়ারণ্যের মধ্যে একমাত্র থাকার জায়গা কেএমভিএন-এর টুরিস্ট রেস্ট হাউসের ২০৬ নম্বর সুপার ডিলাক্স ডবল বেডরুম।

কাল: মধ্য জানুয়ারি, রাত বারোটা তেতাল্লিশ।

পাত্র ও পাত্রী: আমি, গিন্নি এবং বাকি কে বা কী জানা যাচ্ছে না!

তাপমাত্রা: সঠিক বলতে পারব না। তবে আমাদের দু’জনের প্রত্যেকের গায়ে দুটো করে লেপ ও কম্বল চাপানো।

টুরিস্ট রেস্ট হাউসের ক্যান্টিনে রাত আটটা নাগাদ টোম্যাটো স্যুপ দিয়ে শুরু করে শেষ পাতে ‘ক্ষীর’ (পায়েসের স্থানীয় নাম) নিয়ে নৈশাহার সেরে ঘরে এসে যখন লেপ-কম্বলের তলায় সেঁধিয়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম জম্পেশ একটা ঘুম হবে। বুঝিনি মধুসূদনের অন্য মতিগতি ছিল।

আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল। একটা আওয়াজ আসছে— ঘরের পুব দিকের দেওয়াল জোড়া জানলা, তার বাইরে থেকে। অনেকটা জানলার বাইরে কাঠের ফ্রেমে বা কার্নিশে আঁচড় কাটার আওয়াজ। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে ফেরার সময় যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে দেখছিলাম, এটা তার আওয়াজ নয়তো?

কর্তব্য যদিও উঠে দেখা ব্যাপারটা কী, কিন্তু এই ঠান্ডা আর অন্ধকারে ধরাচুড়ো চাপিয়ে বেরোনোর কোনও মানে হয় না। বিশেষ করে যদি তেমন তেমন কিছু ঘটেও— ঢাল, তলোয়ার ছাড়া এ নিধিরাম সর্দার কতটা কী পারবে, সেটাও একটা ব্যাপার।

কিন্তু আওয়াজটি ক্রমবর্ধমান!

‘যাক গে, মরুক গে’ বলে পাশ ফিরে ঘুমালেই হয়তো ল্যাঠা চুকত। কিন্তু এখানে এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। কারণ প্রথমত, জায়গাটি সম্পূর্ণ অচেনা। দ্বিতীয়ত, প্রায় ৪৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের উপর পাইন, ওক আর রডোডেন্‌ড্রনের এই ঘন জঙ্গলে একটি মাত্র গেস্ট হাউসে আমরা দু’টি মাত্র বোর্ডার। না আশেপাশে কোনও গ্রাম, না কোনও বসতি, না মানুষজন֫— শুধুমাত্র গেস্ট হাউসের জনাকয়েক কর্মচারী ছাড়া (রীতিমত বুঝতে পারছিলাম কী ভাবে ‘জনগণ না থাকিলে নির্জনতার স্বাদ মরিয়া যায়’)। এখানে চেঁচিয়ে ডাকলেও সাড়া দেওয়ার কেউ নেই। ঘুমিয়ে পড়লাম, তার পর চোর জানলা ভেঙে ঢুকে নিঃশব্দে জিনিসপত্র হাতিয়ে হাওয়া হয়ে গেল, করার কিছু নেই। তার উপর বেশি ট্যাঁ ফো করতে গিয়ে যদি পাহাড়ি চাকুর ঘায়ে খুনও হয়ে যাই, দেখার কেউ নেই।

মাঝরাতে ঘরে কোনও অসুবিধা হলে লোকে সাধারণত আগে লাইট জ্বালায়। কিন্তু বিনসরে বিজলিবাতি নেই। ঘরে একটি টুনি বাল্ব আছে বটে, তবে সেটি সোলার পাওয়ারে চলে এবং রাত ন’টার পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ক্যান্ডল স্ট্যান্ড লাগানো। আর টেবিলের উপর রাখা এক গুচ্ছ মোমবাতি সারা সন্ধে জ্বলার ফলে শেষ।

পরবর্তী পদক্ষেপ করা উচিত তৎক্ষণাৎ বেয়ারাকে ইন্টারকম-এ ডেকে পাঠানো। কিন্তু বিনসর টুরিস্ট রেস্ট হাউসে ইন্টারকমও নেই।

বিজলিবাতি নেই, বাথরুমে গিজার নেই, ঘরে ফোন নেই— এ হেন ‘নেই রাজ্যে’ এসে বিকেলবেলা ‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’ বলে নাচছিলাম। এখন অ্যাডভেঞ্চারের ঠেলা বুঝছি!


বিনসর জঙ্গলে একমাত্র থাকার জায়গা। কেএমভিএন ট্যুরিজম রেস্ট হাউস।

এ বার কাঠের জানলার বাইরেও ঠক-ঠক করে আওয়াজ হচ্ছে। এত ক্ষণ কেউ বা কিছুতে আঁচড় কাটছিল, এখন ঠোকাঠুকিও শুরু হয়েছে। পাহাড়-প্রমাণ লেপ-কম্বল ঠেলে উঠলাম। গিন্নি বললেন, “সাবধান!”

অন্ধকারেরও একটা আলো আছে। সেই আলোতেই জানলার দিকে এগোচ্ছি। দেওয়াল জুড়ে তিনটে জানলা। তার সামনে তিনটি ভারী পর্দা টাঙানো। বোর্ডাররা যাতে শুধুমাত্র পর্দা সরিয়েই বিছানায় শুয়ে নন্দাদেবীর শোভা দেখতে পান, তাই এই ব্যবস্থা।

হ্যাঁচকা টানে বাঁ দিকের পর্দাটা সরিয়ে দিয়েই দু’পা পিছিয়ে এলাম। বলা যায় না, যদি কিছু অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে!

বাইরে সেই রাত্রিবেলার আলো ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে অদূরের জঙ্গল। আকাশে একটিও তারা নেই।

এবং জানলার ছিটকিনিটি খোলা। এখানকার জানলার দু’টি ভাগ। বাইরেটায় কাঠের ফ্রেমে জাল লাগানো, আর ভেতরেরটায় আর একটি ফ্রেমে কাচ। সেই কাচের জানলার ছিটকিনি খোলা। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কোনও মতে সেটি লাগালাম।

কাজটি করতে যেটুকু খুট-খাট শব্দ হল, তা থামার পর শুনি বাইরের আওয়াজটাও থেমে গিয়েছে!

তার মানে অবশ্যই বাইরে কেউ আছে। ঘরের ভেতরের আওয়াজ শুনে সে হয়তো সতর্ক হয়ে থেমে গেল!

পর পর অন্য দু’টি পর্দা সরিয়েও দেখি একই অবস্থা। সব ক’টা ফের আটকালাম। এ অন্ধকারেও বুঝতে পারছিলাম বাইরের আবহাওয়া বেশ খারাপ।

তিনটে জানলা লাগিয়ে বিছানায় এসে লেপ-কম্বলের তলায় ঢুকে বুঝলাম ঘুম মোটামুটি উবে গেছে। ভয় আর ঠান্ডা মেশানো অদ্ভুত একটা অনুভূতি। হাজার একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরছে। জন্তু জানোয়ার নয় তো? নাকি চোর ডাকাত? এ দিকে ঘরটাও কাঠের। দেওয়ালগুলো কতটা পোক্ত কে জানে! এ হেন সাত-পাঁচ ভাবতেই ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, বিকেলে বেয়ারা ভদ্রলোক যখন জগে করে গরম জল এনে দিয়েছিলেন, তখন তার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে নিয়েছিলাম তো! যদি কখনও কিছু প্রয়োজন হয়— সেই মনে করে।

মনে পড়ে গেছে, তাঁর নাম গোপাল। বছর তিরিশের যুবক। পরিচয় থেকেই তাকে তুমি সম্বোধনে নাম ধরেই ডেকেছি। তো গোপাল ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, “হ্যালো!”

তার পর সব শুনে বললেন, “কেয়া বোল রহে হ্যায় সাব? খিড়কি কে বাহার আওয়াজ?”

জানালাম বাইরে একটা কিছু যে ঘটছে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

—স্যর আপ চিন্তা মত কিজিয়ে। কোই জংলি বিল্লি ইয়া বান্দর হোগা শায়দ। খিড়কি যব বনধ হ্যায় তো চিন্তা কী কোই বাত নহি।

বাঁদরে আর বাঁদরামো করার সময় পেলে না? এই ঠান্ডায় রাত পৌনে একটার সময় জানলার বাইরে মস্করা হচ্ছে?

কিন্তু ছিটকিনিগুলো খুলল কে? বাইরে থেকে কোনও ভাবে খোলা যায় না তো? নাকি যায়? তবে তো ঘুমিয়ে পড়লে আবার কিছু ঘটতে পারে! আর বাঁদরে সারা রেস্ট হাউসের বাকি ঘরগুলো বাদ দিয়ে এই আমাদের ঘরের জানলাই পেল!

যদি বাঁদর না হয়ে অন্য কিছু হয়? যদি কোনও মানুষ থাকে বাইরে? তা হলে?

নাহ্‌! গোপালের আশ্বাসবাণীতে এ চিন্তা কাটার নয়। ওকে বুঝিয়ে বলা গেল, বাইরে ‘দুষ্টু’ লোক থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে একা এই রেস্ট হাউসে আমি বিপন্ন। তোমার উচিত এখুনি ব্যাপারটা ম্যানেজারকে জানানো। এই বাক্য শুনেই গোপালের গলার স্বর গেল পাল্টে, “না না স্যর! এ কী বলছেন স্যর ! আপনি গভর্নমেন্টের রেস্ট হাউসে আছেন স্যর। আপনি পুরোপুরি সেফ স্যর। এখানে আজ অবধি এমন ধরনের কিছু হয়নি স্যর। আপনি আমাদের গেস্ট স্যর। আপনি একদম টেনশন করবেন না স্যর। আমি এখুনি আপনার ঘরের চারপাশ দেখে আপনাকে ফোন করে জানাচ্ছি। শুধু একটা রিকোয়েস্ট, আপনি ঘর থেকে একদম বাইরে বেরোবেন না স্যর।”

পর পর এতগুলো ‘স্যর’ শুনে এত ক্ষণ পর একটু আশ্বাস পেলাম মনে হল। গিন্নি লেপের তলা থেকে বললেন, “আমাদের সময় নির্বাচনটা ঠিক হয়নি। একটা লোক নেই। অফ-সিজন তো নয়, একেবারে অফ-সিজনের অফ-সিজন, তস্য অফ-সিজন! মে-জুন মাস হত, ফুরফুরে ওয়েদারে বিপদের মোকাবিলা করতে নড়াচড়াও করা যেত, হাঁকডাক পেড়ে লোকজনও ডাকা যেত। তা না, জানুয়ারিতে বিনসর! ঠান্ডার চোটে হাত-পা নাড়ানো যাচ্ছে না।”

দুশ্চিন্তার একটা স্বাভাবিক ধর্ম এই যে এটা পিঠে করে নিজের আত্মীয়স্বজনকেও নিয়ে আসে। এখন এই মুহূর্তে এই ঘরের দেওয়াল কতটা পোক্ত, সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। দেওয়ালগুলো কাঠের (কারণ, কাঠের ঘরে সিমেন্টের ঘরের চেয়ে ঠান্ডা কম লাগে)। যদি ফুটোফাটা থাকে? সেখান দিয়ে কিছু ঢুকে যদি এই লখিন্দরকে ছোবল মারে? আমার বেহুলা-রুপী সহধর্মিণী যে ভেলায় চড়ে ভাসতে ভাসতে সোজা বাগবাজার ঘাটে উঠে ধাঁ করে আরজিকর-এ ভর্তি করে দেবে— এখানে সে সম্ভাবনাও নেই। গঙ্গা গাড়বাল দিয়ে বয়, কুমায়ুন দিয়ে নয়।

তার উপর শুনেছি এ জঙ্গলে ভাল্লুকও আছে। এক ধাক্কায় যদি দেওয়াল ধসিয়ে দেয়? এ হেন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাইরে পায়ের আওয়াজ কানে এল। এটা দরজার দিক থেকে। দু’এক বার গলার হাঁকডাকও যেন শুনলাম অস্পষ্ট।

ফোনটা এলো সওয়া একটা নাগাদ, “অন্ধকারে বাইরে ভাল করে কিছু দেখা যাচ্ছে না স্যর। তবু আমি লোক নিয়ে করিডোর ধরে আপনার ঘরের পাশে গিয়েছিলাম। দেখে এসেছি। বাহার কুছ নহি হ্যাঁয় সাব্‌। আর আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যর। আমাদের এখানে আজ অবধি কোনও টুরিস্টের উপর কোনও ধরনের হামলা হয়নি। আপ হামারে মেহমান হ্যায় স্যর!”

আরও বললেন, “বাইরে ঝড়ে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ভাল করে। কেউ জানলার বাইরে থাকলে এই ঠান্ডাতেই মর্‌ যায়গা স্যার। তবু আমার ফোন খোলা রইল। কোনও রকম অসুবিধা হলেই কল করবেন।”

এত ক্ষণ পর একটু নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, তা হলে চিন্তার সবিশেষ কিছু নেই।

ঘটনার ঘনঘটা ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ধন্যি পাহাড়, ধন্যি পাহাড়ের চরিত্র!

সকালে নিয়মমাফিক ঘুম ভাঙল না। হয়তো রাত্তিরের ধকলের জন্যই হবে। জাগলাম গিন্নির ডাকাডাকিতে, “ওঠো ওঠো! বাইরে কী অবস্থা দেখো!”

দেখি গিন্নি সেই বাঁ দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে কেমন একটা “অ-ইন্সপায়ারিং লুক” নিয়ে তাকিয়ে আছে। মোবাইল বলছে সাড়ে আট। পর্দার এ-পার থেকে বেশ বুঝতে পারছি বাইরে আলো আছে, তবে রোদ্দুর নেই।

উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে আমার চক্ষুস্থির! বরফে এলাকা ঢেকে গিয়েছে। রেস্ট হাউসের সামনের লন, ও-দিকের টেরেস (যেখান থেকে নন্দাদেবী রেঞ্জটা দেখা যায়), অদূরের পাইন গাছের সারি— সব সাদা। বরফ তখনও পড়ছে। ক্যামেরা নিয়ে রেডি হচ্ছি, দরজায় আওয়াজ। খুলে দেখি হাসিমুখে হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে গোপাল দাঁড়িয়ে, “গুড মর্নিং স্যর! রাত কো অউর কোই পরেশানি তো নহি হুয়া না স্যর?”

—এ যে বরফ পড়ছে হে!

—জি সাব! ক্যায়া নজারা হ্যায়!

আজ ফেরার পালা। তাই স্নান সেরে একেবারে রেডি হয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ব। তাই গরম জলের অর্ডার দিয়ে দিলাম।

গায়ে ধরাচুড়ো চাপিয়ে তখন ঘরের মধ্যে থেকেই ক্যামেরা হাতে লড়ে যাচ্ছি। অভূতপূর্ব সৌন্দর্য। বাইরে ভর্তি কুয়াশা। দূরের নন্দাদেবী দূরের কথা, কাছের খাদই দেখা যাচ্ছে না। তুলোর মতো নাগাড়ে বরফ পড়ছে। আমেজ করে সিগারেট সহযোগে চা খেয়ে বাথরুমে ঢুকব, ম্যানেজারবাবু এলেন, “স্যর, আজকের প্ল্যান কী?”

—নেমে যাব।

—আপনার গাড়ি কোথায় স্যর?

আমার ড্রাইভার সঞ্জয় কাল বিকেলে এখানে ছেড়ে নেমে গিয়েছিল। বলল নীচে ওর কোনও বন্ধুর বাড়ি থাকবে। কাল সকালে ন’টার মধ্যে হাজির হয়ে যাবে। শুনে ম্যানেজার বললেন, “সবই বুঝলাম স্যর। কিন্তু আসবে কী করে? বরফ পড়ে রাস্তা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে!”

—অ্যাঁ! তা হলে? নামব কী করে?

ওহ্‌! আবার অশান্তি! জায়গাটা যেন আমায় ফাঁদে ফেলার জন্য কাল রাত থেকে উঠেপড়ে লেগেছে! ম্যানেজার বললেন, “আপনি রেডি হয়ে নিন। দেখছি কী করা যায়।”

স্নান সেরে, মালপত্র গুছিয়ে, জামাকাপড় চাপিয়ে ও ব্রেকফাস্ট সেরে যখন ঘড়ি দেখলাম, প্রায় দশটা।

এ বার সঞ্জয়কে ফোন, “কী অবস্থা?”

—স্যর, ম্যায় তো ফাস গ্যায়া!

—সে তো আগেই বুঝেছি। তা এই মুহূর্তে আছ কোথায়?”

—চেকপোস্ট পার হয়ে আমি চার-পাঁচ কিলোমিটার আসতে পেরেছি। এর পর থেকে বরফ পড়ে আছে। এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে ওঠা রিস্কি হয়ে যাবে স্যর। আপনি কোনও ভাবে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে নামার চেষ্টা করুন। আমি রাস্তায় আপনাকে পিক-আপ করছি। এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই!”

ম্যানেজার বললেন, “এখান থেকে গাড়ি রাস্তায় চেকপোস্ট প্রায় বারো কিলোমিটার। যাক গে, যেটা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে। ও এখানে থাকলে বিপত্তি আরও বাড়ত বেশি। তখন কেউই নামতে পারতেন না। আর আমার কাছেও এই মুহূর্তে বড় চাকার কোনও গাড়ি নেই যে আপনাকে নীচ অবধি ছেড়ে আসব।”

ধূমায়িত চায়ের পেয়ালার দিকে তাকিয়ে বসে আছি। এমন সময় গোপাল এল, “স্যর, একবার আসবেন আমার সঙ্গে?”

—কোথায়?

—আসুনই না!


আমাদের গাইড গোপাল। কাঁধে আমাদেরই ব্যাগ।

সমস্ত করিডোর জুড়ে বরফ পড়ে আছে। পা টিপে টিপে দেওয়াল ধরে গোপালের সঙ্গে আমার ঘর অবধি এলাম। আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে ছোট্ট আর একটা করিডোর। গোপাল তাতে ঢুকে বলল, “এ বার ওই বরফের উপর দেখুন স্যর।”

কীসের যেন ছাপ দেখতে পাচ্ছি। গোপাল বলল, “আপনি কাল রাতে এ দিক থেকেই আওয়াজ পাচ্ছিলেন স্যর। আপনার ঘরের বাইরে চিতা আয়া থা স্যর। ওই দেখুন চিতার পায়ের ছাপ!”

চিতা? মানে বাঘ? অ্যাঁ! মানে চিতা বাঘ? আমার ঘরের বাইরে? কাল রাত্তিরে চিতা বাঘ জানলার ছিটকিনি খুলে দিয়েছিল? মানে এই যে আমি সারা রাত্তির ঘুমোলাম, আমার ঘরের বাইরে চিতায় এসে পায়চারি করে গেল?

কী বলব বুঝতে পারছি না। বিচ্ছিরি ভাবে একটা কাঁপুনিটা আসছে। এমন কথা গপ্পে পড়েছি, কিন্তু বাস্তবে!

কোনওরকমে ঘরে ঢুকে গিন্নিকে জানালাম ব্যাপারটা। বললেন, “বাহ্‌, তা ঘরে ঢুকল না কেন? তা হলেই তো ষোলোকলা পূরণ হত। এখন এখান থেকে দয়া করে তাড়াতাড়ি বেরোও!”

তত ক্ষণে গোপালের কাছে খবর পেয়ে ম্যানেজারও চলে এসেছেন, “ওরা রাতের দিকে আসে। এখন ভয়ের কিছু নেই। আসলে কী জানেন, জঙ্গল তো!”

বললাম, “শীগগির বলুন আমি নামব কী করে!”

—এ ভাবে আপনাকে ছাড়তে আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। আর একদিন যে থেকে যেতে বলব, সেটাও উচিত হবে না। যদি স্নো-ফল না থামে সে ক্ষেত্রে বরফ রাস্তায় জমে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। তখন হেঁটে নামাও রিস্কি হবে।

—না না, আর থাকার কোনও প্রশ্নই নেই! থেকে যাই, তার পর আবার রাত্তিরে... আপনি যে ভাবে হোক একটা কিছু বন্দোবস্ত করুন।

—এনিওয়ে, কোনও চিন্তা নেই। আমি আমার রুম-বয়দের সঙ্গে দিচ্ছি। ওরা আপনার মালপত্র বইবে এবং গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে। আপনি শুধু ম্যাডামকে নিয়ে সাবধানে পা ফেলে নামবেন। ওকে?

তখন আমার কাছে সবই ‘ওকে’! বেরোবার আগে শুধু ড্রাইভারকে একটা ফোন করে নিলাম। “আমি বিনসর মহাদেবের মন্দিরের সামনে চলে এসেছি স্যর।” জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা এখান থেকে কত দূর?”

গোপাল সহযাত্রী। বলল, “গাড়ি রাস্তায় গেলে মোটামুটি ছ’ কিলোমিটার মতো। তবে আমরা শর্টকাট দিয়ে নামব। আরও কম পড়বে। চলুন স্যর, বেরিয়ে পড়ি।”

গিন্নির কোট বরফ পড়ে ভিজে যাবে বলে ম্যানেজারবাবু নিজের একটি উইন্ড-শিটার দিলেন, “এটা পরে যান ম্যাডাম। পৌঁছে গোপালের হাতে দিয়ে দিলেই হবে। কোনও চিন্তা নেই। আমরা এ ভাবে সত্তর বছরের বুড়ো-বুড়িকেও পার করেছি। আপনি তো স্যর নাচতে নাচতে নেমে যাবেন!”

আর নাচ! কাল রাত থেকে নাচছি। এবং সকালে উঠে জানলাম চিতায় এসে আমার নাচের তালে তালে খঞ্জনি বাজিয়ে গিয়েছে!

তিনটে পোর্টার আমাদের মাল বইছে। রেস্ট হাউসের বাইরে পা ফেলে দেখলাম গোড়ালি ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু অবধি বরফে ঢুকে গেল। ভিজিবিলিটির কথা আর নাই বা বললাম! পেছন থেকে ম্যানেজারবাবুর আওয়াজ কানে আসছে, “ঘাবড়াইয়ে মত স্যর! কোই দিক্কত হোনে সে ওয়াপস আ যানা। পুরা হোটেল আপকে খিদ্‌মত মে মিলেগা। হ্যাপি জার্নি!”

একটা বাঁক ঘুরতেই রেস্ট হাউস হাওয়া। কিছু দূর এগিয়ে গাড়ি রাস্তা থেকে আমরা পায়ে হাঁটার রাস্তায় সরে এলাম। কোথাও গাছ পড়ে আছে, কোথাও পাথর। সামনে গোপাল গাইড, “আমি যেখানে পা ফেলছি সেখানেই ফেলবেন স্যর। ইধার উধার মত কর না।”

এদের কাছে দেখলাম এই সম্পূর্ণ ঘটনাটার মধ্যে আহামরির কোনও ব্যাপার নেই। গোপাল দিব্যি নামতে নামতে গপ্পো করছিল, “স্নো-ফল হয়ে গেল বলে, না হলে এখান থেকে আমি আপনাকে জিরো-পয়েন্টে নিয়ে যেতাম স্যর। সেখান থেকে ওয়েদার ক্লিয়ার হোনে পর আপকো কেদারনাথ, শিবলিঙ্গ পিক দিখাই দেতা।”

ওয়েদার-ই তো মাটি করলে। সাধে কী আর এরা মে-জুন মাসটাকে সিজন বলে! এ অরণ্য চাঁদ বংশীয় রাজাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। সেই রাজারা যারা এগারোশো থেকে আঠেরোশো শতাব্দী ধরে কুমায়ুনে রাজত্ব করেন। বেশির ভাগ লোকে গরমকালেই এখানে ফুল, পাখি আর অদূরের শৃঙ্গরাজি দেখতে আসে।

উনিশশো অষ্টাশি সালে সরকার এটিকে ‘স্যাঙ্কচুয়ারি’ বলে ঘোষণা করেন। হিসেব অনুযায়ী এখানে দুশোরও বেশি প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। অবিশ্যি এখন বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটাও দেখতে পেলাম না।

পুরো রাস্তাটা নিঝুম হয়ে আছে। গোপাল নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে থেকে থেকে, “অবিশ্যি আপনারা লাকি স্যর! একটা ফ্যামিলি চার দিন থেকে বরফের দেখা না পেয়ে চলে গেল। আপনি যে দিন এলেন তার আগের দিনই। অ্যায়সা বর্‌ফ মে চলনেকা ভি এক অলগ্‌ হি অনুভব্‌ হ্যায়! ঠিক কি না স্যর?”

আর এক পোর্টার (যে মাথায় আমার ট্রলি নিয়ে এক হাতে তার মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে পেছন পেছন আসছিল) পাদপূরণ করছে, “সহি বাত্‌।”

আরও কিছু দূর এগিয়ে দেখি দূরে রাস্তার উপর কিছু পড়ে আছে। গোপাল বলল, “সাবধানে। ঘাবড়াইয়ে মত্‌।”

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম হরিণ, ইংরাজিতে যাকে বলে মাস্ক-ডিয়ার, তাই। শুধু মাথা আর সামনের পা দু’টি আছে। বাকিটা নেই। দেখে সবাই ঘনীভূত হয়ে এলাম। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “টাটকা রক্ত। এখানেই খাচ্ছিল বোধহয়! কেউ ছাড়াছাড়া থাকবেন না। আশেপাশে থাকতে পারে।”

বীভৎস সে দৃশ্য! তার উপর আবার বলছে, “আশেপাশে থাকতে পারে!”

আমার চিন্তা আন্দাজ করেই বোধহয় গোপাল আবার বলে উঠল, “তবে আমরা অনেকে আছি। চিন্তার কিছু নেই। এক চিতা আমাদের কী করবে? ঘাবড়াইয়ে মত্‌ স্যর! আইয়ে, সাইড দিয়ে চলে আসুন।”

সে দিন আর কোনও বিপত্তি ঘটেনি। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস যদিও গাড়িতে উঠেই পড়েছিল। সঞ্জয়ও ঠিক জায়গাতেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গিন্নি পোর্টারদের উইন্ড-শিটারটি ফেরত দিলেন, আমি দিলাম বকশিস।

নীচে নামার ফলে বরফের আধিক্যও আস্তে আস্তে কমে এসেছিল। সঞ্জয় বলল, “এসে ভালই করেছেন স্যর। রাস্তা পুরো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চেকপোস্টে বলল, সব বুকিং ক্যান্সেল। আজ যদি থেকে যেতেন, কবে বেরোতে পারতেন কে জানে।”

চেকপোস্ট পেরিয়ে আসার সময়, একটা কাঠের বোর্ডের উপর চোখ পড়ল। তাতে একটা প্রাণীর ছবি আটকানো। তার হলুদ গায়ে কালো ছোপ। চোখ দু’টি ভাটার মতো জ্বলছে। তলায় লেখা ‘প্যান্থেরা পার্ডাস।’

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE