Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ভাসমান ভেনেজিয়া

প্রথম বার বিদেশ যাত্রা। গন্তব্য, ইতালির পূর্ব দিকে স্লোভানিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত পারের ছোট্ট শহর ত্রিয়েস্তে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতেই সেখানে যাওয়া। শহরের এক পাশে বিস্তীর্ণ ভূমধ্যসাগর, অন্য দিকে মিরামারে দুর্গ। প্রায় ১৫ দিনের জন্য এখানে আসা। হাতে একটাই মাত্র সপ্তাহান্ত। তাই ঠিক করলাম, ভেনিস যাব। ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। একটা শনিবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ভেনিসের উদ্দেশে।

আত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়
পুণে শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

প্রথম বার বিদেশ যাত্রা। গন্তব্য, ইতালির পূর্ব দিকে স্লোভানিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত পারের ছোট্ট শহর ত্রিয়েস্তে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতেই সেখানে যাওয়া। শহরের এক পাশে বিস্তীর্ণ ভূমধ্যসাগর, অন্য দিকে মিরামারে দুর্গ। প্রায় ১৫ দিনের জন্য এখানে আসা। হাতে একটাই মাত্র সপ্তাহান্ত। তাই ঠিক করলাম, ভেনিস যাব। ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। একটা শনিবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ভেনিসের উদ্দেশে।

সান্তা লুকা স্টেশন পৌঁছনোর কিছু ক্ষণ আগেই ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম, আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ভাসমান সেই শহরটাকে— ভেনিস। ইতালির ভাষায় ভেনেজিয়া। স্টেশন থেকে নেমেই বেশ ভাল লাগল। দিন সাতেক পর অনেক লোকজন দেখতে পেলাম। তার পরে সান মার্কো স্কোয়্যার যাওয়ার জন্য ভেনেজিয়ার ম্যাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ম্যাপ দেখে মনে হল, খুব একটা দূরে নয়। তাই ঠিক করলাম পায়ে হেঁটেই যাব।

সূর্যের আলোয় তখন ঝলমল করছে রঙিন ভেনেজিয়া। কোথাও আকাশচুম্বী অট্টালিকা নেই! খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচ তলা সব বাড়ি, চওড়া দেওয়াল, পাশে ক্যানেল বয়ে চলেছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কয়েকটা ব্রিজ পেরিয়ে সান মার্কো স্কোয়্যারের দিকে চলেছি। বোঝা যাচ্ছে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য পসরা নিয়ে সেজে উঠেছে ভেনেজিয়া। এ পাশে ও পাশে পিজেরিয়া— নানান ধরনের পিজ্জার দোকান। রাস্তায় বেশ কয়েকটা চার্চ, মিউজিয়াম দেখা যাচ্ছে। প্রায় সমস্ত গলি একই রকম দেখতে। বাড়িগুলোর দেওয়ালে তির চিহ্ন আঁকা— যেগুলো সান মার্কো স্কোয়্যারের দিক নির্দেশ করছে।

কিছুটা যাওয়ার পর সরু গলি আর বহু পুরনো ইট বেরিয়ে থাকা কিছু বাড়ি। এক ঝলকে উত্তর কলকাতার গলির কথা মনে পড়ে যায়। বহু পুরনো শহরের সব অংশ, কিন্তু সিনেমার পর্দায় দেখা ভেনিসের থাকা দৃশ্যের মতো রঙিন নয়। শ্যাওলা ধরা, ইট বের হয়ে থাকা দেওয়াল, ক্যানেলের সবুজ জলের গন্ধ— মনে করিয়ে দিচ্ছিল ইউরোপের বহু পুরনো ইতিহাসকে। মনে হল যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছি। তির চিহ্ন দেখে যে দিকেই যাই, সান মার্কো স্কোয়্যার আর দেখতে পাই না। অবশেষে এক বাংলাদেশি দোকানদারকে পেলাম। তার কথা শুনে মনে হল, স্কোয়্যারের আশেপাশেই আছি। কথায় আছে, ভেনিসে হারিয়ে যাওয়া মন্দ নয়। সত্যিই তাই!

কত গলি, ক্যানেল, মাছের বাজার, সব্জি বাজার, পুরনো গির্জা দেখতে পেলাম। স্টেশন থেকে ওয়াটার ট্যাক্সি বা বোটে করে সান মার্কো স্কোয়্যারে এলে সত্যিই সে সব অজানা থেকে যেত। অবশেষে গ্র্যান্ড ক্যানেল দেখতে পেলাম। ম্যাপ অনুযায়ী আমরা সান মার্কো স্কোয়্যারের খুব কাছেই আছি। আরও কয়েকটা সেতু পেরিয়ে গলি বেয়ে যেতেই দেখতে পেলাম বিস্তীর্ণ একটা জায়গা— প্রচুর লোক, চার পাশে মিউজিয়াম, অসম্ভব সুন্দর স্থাপত্য— পিয়াজা সান মার্কো। স্কোয়্যারের এক পাশে সান মার্কো গির্জা, অন্য পাশে ক্লক টাওয়ার। মাঝখানে ‘লায়ন অফ ভেনিসের’ স্তম্ভ। গ্র্যান্ড ক্যানেলের খুব কাছেই রিয়ালত সেতু।

তার পর সেখান থেকে ওয়াটার ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম মুরানো দ্বীপে। ভিড় বেশ কম সেখানে। চোখ ধাঁধানো মুরানো কাচের তৈরি ঝাড়বাতি থেকে কানের দুল— চোখ সার্থক করার মতো। গন্ডোলা ছাড়া ভেনেজিয়া ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। গন্ডোলা রাজকীয় নৌকা গোছের। তার ভাড়াও অনেক। ৮০-৯০ ইউরো দিতে হয় আধ ঘণ্টার জন্য। ভেনিসের গলি গলি থুড়ি ক্যানেল ঘোরা যায় গন্ডোলা চরে। লাল কার্পেট মোড়া কালো ও সোনালি রঙের গন্ডোলাগুলো দেখেই বেশ রাজকীয় ভাব আসছিল। যদিও আমাদের মতো মধ্যবিত্তের স্বপ্ন পূরণের জন্য ওয়াটার ট্যাক্সি বা স্টিমার ভ্রমণটাও মন্দ নয়। অসম্ভব ভাল জিলাতো আর টুনা মাছের পিজ্জা দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম স্টেশনের উদ্দেশে। ফিরতেও প্রায় দু’ঘণ্টা লেগে গেল। আবার রাস্তা হারালাম আমরা।

দু’টো বাড়ির পাশে রাস্তার পরিবর্তে ক্যানেল; সাইকেল, বাইক বা গাড়ির পরিবর্তে প্রত্যেক বাড়ির পাশে বেঁধে রাখা ওয়াটার বোট; কিম্বা বাস, ট্রেনের বদলে ওয়াটার ট্যাক্সি বা গন্ডোলা— ভারি আশ্চর্যের শহর ভেনেজিয়া। পুরনো গির্জা, মিউজিয়াম, ইতিহাসের গন্ধ আর ভূগোল বইয়ে পড়া ইতালির বন্দর ভেনিসকে বিদায় জানানোর পালা এ বার। ট্রেনে ফেরার সময় রঙিন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বার বার মনে হচ্ছিল একটাই কথা, সত্যিই ‘ইটস ওয়ার্থ টু গেট লস্ট ইন ভেনেজিয়া’।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা বোলপুরে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করে এখন পুণে ন্যাশনাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে গবেষণারত। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে ইতালি যাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE