Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নেই জলও, দেরি ১১ ঘণ্টা, এই নাকি সুবিধা!

হ-য-ব-র-ল-র বেড়ালটা বলেছিল, ‘‘এ আর এমন কী ? এ তো হামেশাই হচ্ছে।’’ যখন সবাইকে বললাম, যে ট্রেনে দিল্লি থেকে হাওড়া এসেছি সেটা ১১ ঘণ্টা লেট ছিল— তা শুনে কেউই বিশেষ অবাক হলেন না।

মোহনা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ০৯:৩৮
Share: Save:

হ-য-ব-র-ল-র বেড়ালটা বলেছিল, ‘‘এ আর এমন কী ? এ তো হামেশাই হচ্ছে।’’

যখন সবাইকে বললাম, যে ট্রেনে দিল্লি থেকে হাওড়া এসেছি সেটা ১১ ঘণ্টা লেট ছিল— তা শুনে কেউই বিশেষ অবাক হলেন না। যখন বললাম, ট্রেনে জল ছিল না, টিকিট চেকারের দেখা মেলেনি, কামরায় পুলিশি প্রহরা ছিল না— তাতে কেউ কেউ বললেন, এ আর এমন কী। এ তো হামেশাই হচ্ছে। কিন্তু তার পরে আরও কিছু অভিজ্ঞতার কথা যখন শোনালাম, তখন দু’চার জন নড়েচ়ড়ে বসলেন। শুনে বললেন, ‘‘তাই না কি!’’

দিল্লির কাছে একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা থেকে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন বাবা। গত ১২ জুন আনন্দবিহার স্টেশন থেকে ০২২৬৬ আনন্দবিহার-হাওড়া সুবিধা এক্সপ্রেসে ফিরতি যাত্রার টিকিট কাটা ছিল। ১৮ মে স্লিপার ক্লাসে টিকিট কেটেছিলাম। দু’জনের ভাড়া লেগেছিল ১৫৭৩ টাকা। রেলের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছিল, ট্রেনটি হাওড়া পৌঁছতে সময় নেবে ২১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। দাঁড়াবে মাত্র ৫টি স্টেশনে। কানপুর, ইলাহাবাদ, মোগলসরাই, গয়া এবং ধানবাদ। তার মানে, ট্রেনটি সুপারফাস্ট।

১২ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনটি ছাড়ার কথা ছিল। ৬টা নাগাদ আনন্দবিহার স্টেশনে গিয়ে লাল রঙের ঝকঝকে ট্রেনে উঠে দেখি, কামরা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে জলের বোতল, ডিমের খোলা। নিজের বার্থে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা হল, ট্রেন ৬টা ৪৫-এর পরিবর্তে রাত ৯টায় ছাড়বে।

এ দিকে কামরায় আলো নেই, পাখা চলছে না। দিল্লির ভয়ানক গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। বাইরে নবনির্মিত আনন্দবিহার স্টেশনে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে কোনও পাখা নেই। চার-পাঁচটি পাখা ঘুরছে প্ল্যাটফর্মের পাশে সাবওয়ের সিঁড়ির উপরে। ট্রেনে বিদ্যুত্সংযোগ এল রাত ৮টার পর। ট্রেন ছাড়ল রাত ৯টায়।

টুন্ডলা স্টেশনে ট্রেন ঠায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। কানপুর পৌঁছনোর কথা রাত ১টায়। পৌঁছলো সকাল ৮টায়। সেখানে কিছু কিছু বগির বাথরুমে জল দিতে না দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। এক সহযাত্রী তাঁর মোবাইল থেকে ট্রেনের বড়কর্তাদের অভিযোগ জানালেন। আমার বাবা এক জন তত্ত্বাবধায়কের খাতায় লিখিত অভিযোগ করলেন। ইলাহাবাদে আমাদের বগি-সহ কয়েকটিতে জল দেওয়া হল, টয়লেট পরিষ্কার করা হল। কিন্তু কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

গোটা যাত্রাপথে টিকিট পরীক্ষক ও নিরাপত্তারক্ষীর দেখা মেলেনি। আমার পাশেই এক মহিলার ব্যাগ নিয়ে চম্পট দিচ্ছিল এক যুবক। অন্য এক সহযাত্রী তা ধরে ফেলায় ব্যাগটি রক্ষা পেল বটে, কিন্তু ওই যুবক পালিয়ে যায়।

জানলাম, আমাদেরই সহযাত্রী স্বামী-স্ত্রীর টিকিট বাবদ লেগেছে ৩৬০০ টাকা। কেন? দিঘার বাসিন্দা অন্য এক সহযাত্রী নিজের টিকিট কেটেছেন ১৫১৮ টাকা দিয়ে। কেন? এ নাকি ‘ডায়নামিক ফেয়ার’। অর্থাৎ, যত দেরিতে টিকিট কাটবেন, ভাড়া তত বেশি লাগবে। আর সুবিধা এক্সপ্রেসে এসি কামরায় টিকিট কেটেছেন ৬ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে। যা দিল্লি-কলকাতার বিমানের ভাড়ার থেকেও বেশি!

বাড়ি ফিরে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেখলাম রেল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, সুবিধা এক্সপ্রেসের যাত্রীদের মোট টিকিটের প্রথম ২০ শতাংশ বিক্রি হবে বেস ফেয়ার ও তত্কালীন চার্জের ভিত্তিতে। পরের ২০ শতাংশ টিকিট কিনতে হবে বেস ফেয়ার এবং তত্কালের দেড়গুণ দাম দিয়ে। তৃতীয় ২০ শতাংশ টিকিটের দাম হবে বেস ফেয়ার এবং তত্কালীন চার্জের দ্বিগুণ দাম দিয়ে। শেষ ৪০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হবে বেস ফেয়ার ও তত্কালীন চার্জের আড়াইগুণ দাম দিয়ে। গত ১৮ জুন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চেন্নাই রেল ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে এন মোহনরাম জানাচ্ছেন, সুবিধা এক্সপ্রেসের শেষ ৪০ শতাংশের ভাড়া সাধারণ এক্সপ্রেসের থেকে ৩-৪ গুণ পর্যন্ত বেশি।

ট্রেনে কোনও প্যান্ট্রি কার ছিল না। এক হকারের কাছ থেকে আন্ডা কারি এবং ভাত কিনলাম ২০০ টাকা দিয়ে। খুলে দেখি আন্ডা কারি নয়, কাঁচা চালের বিরিয়ানি। অগত্যা ডিমটুকু তুলে খেয়ে বাকিটা ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। বিকেলবেলা মুঘলসরাই স্টেশনে কিছু কালোজাম কিনে তা খেয়েই থাকতে হল।

ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, ট্রেনে কেলনার বা সোরাবজির কেটারিং সার্ভিসের জিভে জল আনা খাবারের বর্ণনা। বাবা শোনাচ্ছিলেন, ৪০ বছর আগে মিথিলা এক্সপ্রেসের মতো সাধারণ ট্রেনে মাটনকারি-রাইস খাওয়ার জন্য নাকি মুখিয়ে
থাকতেন তাঁরা।

শেষমেশ হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম রাত তখন ৩টে। ১১ ঘণ্টা লেট।

হাওড়ার ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজারের কাছে বাবা লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেন। সাক্ষী হিসেবে সই করলাম আমি। ম্যানেজার মশাই স্পষ্টতই বিব্রত। বললেন, ‘‘আমি কী করব বলুন, অভিযোগ নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব। কর্তৃপক্ষের হয়ে দুঃখপ্রকাশ করছি আমি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Train journey water scarcity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE