Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

চোখের সামনে ঘরের চাল ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়ল ধানের গোলায়

এক নজরে চোখে পড়বে, রাস্তার ধারে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। বড় বড় গাছ কোমর ভেঙে মাটিতে শুয়ে। শ’য়ে শ’য়ে বাড়ির চাল নেই। কোনও কোনওটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মাটিতে মিশে গিয়েছে পলকা নির্মাণের ছোট বাড়িগুলি। খেতের ফসল সব লন্ডভন্ড।

ভাঙা ঘরেই নিজের বই শুকোতে ব্যস্ত মেয়েটি।

ভাঙা ঘরেই নিজের বই শুকোতে ব্যস্ত মেয়েটি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাগদা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৩
Share: Save:

এক নজরে চোখে পড়বে, রাস্তার ধারে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। বড় বড় গাছ কোমর ভেঙে মাটিতে শুয়ে। শ’য়ে শ’য়ে বাড়ির চাল নেই। কোনও কোনওটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মাটিতে মিশে গিয়েছে পলকা নির্মাণের ছোট বাড়িগুলি। খেতের ফসল সব লন্ডভন্ড।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিনিট তিরিশের ঝড়-বৃষ্টিতে ধ্বংসের ভয়ঙ্কর চিত্র বাগদার বিস্তীর্ণ এলাকায়। বহু চাষি সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেকে মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে চলেছেন। বুধবার বেশির ভাগ বাড়িতেই হাঁড়ি চড়েনি। খোলা আকাশের নীচে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বসে আছেন কত মানুষ। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছুই দিশার নেই। হঠাৎ নেমে আসা বিপর্যয়ে ভেঙে পড়েছেন একেবারে।

ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাগদা ও বয়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬টি মৌজা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌজাগুলি হল, বাকসা, মামাভাগিনা, নওদা পাড়া, সলক, পদ্মপুকুর ও মেহেরানি। বাগদার বিডিও মালবিকা খাঁটুয়া বলেন, ‘‘ওই দুর্যোগে ব্লকের প্রায় আড়াই হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে চারশোটি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছে। প্রায় ১৮০০ বিঘে জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ৬০০টি ত্রিপল বিলি করা হয়েছে। আরও সাড়ে তিন হাজার ত্রিপলের জন্য মহকুমাশাসকের কাছে আবেদন করেছি।’’ ক্ষতি হওয়া ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, পটল, কলা, পেঁপে। বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শম্পা অধিকারী এ দিন এলাকার পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন।

বুধবার দুপুরে নওদা পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, বিদ্যুতের কয়েকটি খুঁটি ভেঙে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বাড়িগুলির অবস্থাও খারাপ। যে দিকে চোখ যাচ্ছে শুধুই ধ্বংসের ছবি। কোথাও বড় বড় গাছ ভেঙে আছে। কোথাও বাড়িঘর। বাসিন্দারা জানালেন, এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ অন্ধকার হয়ে আসে। শুরু হয় হালকা বৃষ্টি। তারপরই বাংলাদেশের যশোর জেলার চৌগাছা থানা এলাকা থেকে প্রবল বেগে ঝড় আছড়ে পড়ে গ্রামে। ঝড়ের প্রকোপ ছিল খুব জোর আধ ঘণ্টা। ঝড় থামলে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। এখানে বেশিরভাগ মানুষ চাষের সঙ্গে যুক্ত। অনেকেরই নিজস্ব জমি আছে। এখানে কেউ কেউ আবার খেত মজুরির কাজও করেন। ফসলের যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে খেত মজুরির কাজ আর পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা আনসার মণ্ডল বলেন, ‘‘দু’বিঘে জমিতে আম গাছ ছিল। ঝড়ে প্রায় সব গাছই ভেঙে গিয়েছে।’’ পেশায় চাষি মনোহর মিত্র সম্প্রতি টিন দিয়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেছিলেন। ঝড়ের সময় তিনি ঘরে ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ঝড় শুরু হতেই ঘরে ঢুকে যাই। মিনিট পাঁচেক পর দেখি ঘর ভীষণ ভাবে দুলছে। ভয়ে পাশেই ছেলে সঞ্জয়ের ঘরে দৌড়ে চলে যাই। ছেলের ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমার ঘরের চাল ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে দূরে একটি ধানের গোলায় নিয়ে গিয়ে ফেলল।’’ ঘরে থাকলে কী হত, তা ভেবে আতঙ্কিত তিনি। ঝড়ের সময়ে কেউ কেউ খাটের তলায় আত্মরক্ষার জন্য ঢুকে পড়েছিলেন।

ইউসুফ আলি মণ্ডলের বসত বাড়ির রান্নাঘর ও গোয়ালঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোয়ালঘর ভেঙে তাঁর দু’টি গরু ও একটি বাছুর আহত হয়েছে। বড় মেয়ে মারুফা মণ্ডল নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে নাজিফা মণ্ডল পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। বৃষ্টিতে তাদের বই খাতা সব ভিজে গিয়েছে। বুধবার দুপুরে দেখা গেল উঠোনের রোদ্দুরে বই খাতা শুকোতে দিয়েছে তারা। আপাতত লেখাপড়া বন্ধ। বই বাঁচাতেই তারা এখন ব্যস্ত। এখানকার বেশির ভাগ বাড়িতে বুধবার রান্না হয়নি। একটি বাড়িতে দেখা গেল ভাঙা বাড়ির উঠোনে খিচুরি রান্না হচ্ছে। জাকির হোসেন মণ্ডল ও কুরবান দফাদারের পোলট্রি ফার্মের ক্ষতি হয়েছে বহু মুরগি মারা গিয়েছে।

দৌলতপুর ইন্ডিয়া পাড়ার মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গ্রামটি কাঁটাতারের বাইরে। বিএসএফ জওয়ানদের পরিচয় দেখিয়ে গ্রামে ঢোকার অনুমতি মিলল। গ্রামটিতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেখা গেল, সোলেমন দফাদার নামে এক গ্রামবাসী ভাঙা ঘর কোনওমতে মেরামত করছেন। স্ত্রী সোফিয়া বললেন, ‘‘কাপড়-জামা সব ভিজে গিয়েছে। দুপুর পর্যন্ত আমরা সরকারি ভাবে কোনও খাবার পাইনি।’’ ইন্ডিয়াপাড়ার বাসিন্দা রামপ্রসাদ মিত্র জানালেন, তাঁরা এখানে থাকতে চান না। ভারতের মূল ভূখণ্ডে চলে আসতে চান। কারণ গ্রামে কোনও উন্নয়ন হয়নি। এমনকী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলেও প্রশাসনের কর্তাদের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ গ্রামের বাসিন্দদের।

বুধবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

storm bagda electricity BSF food
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE