Advertisement
E-Paper

পরিত্যক্ত সামরিক বিমানঘাঁটিতেই গড়ে ওঠে শহর

শহরটিকে অধুনা বাংলাদেশের ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই একদিন ঘর বাড়ি-সম্পত্তি ফেলে রেখে কার্যত নিঃস্ব অবস্থায় ও পার বাংলা থেকে এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের গায়ে ‘উদ্বাস্তু’ তকমা আজও লেগে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই ছিন্নমূল ওই সব মানুষের হৃদয়ে ও পার বাংলার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে শিকড়ের টান। বয়স্ক মানুষের কথায় বার বার উঠে আসে দেশভাগের ভয়াবহ স্মৃতি, আর ভিটে-মাটির কথা।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৩
উদ্বাস্তু মহিলাদের জন্য এক সময়ে চালু হয়েছিল হস্তশিল্প শেখানোর এই কেন্দ্র।

উদ্বাস্তু মহিলাদের জন্য এক সময়ে চালু হয়েছিল হস্তশিল্প শেখানোর এই কেন্দ্র।

শহরটিকে অধুনা বাংলাদেশের ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না।

অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই একদিন ঘর বাড়ি-সম্পত্তি ফেলে রেখে কার্যত নিঃস্ব অবস্থায় ও পার বাংলা থেকে এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের গায়ে ‘উদ্বাস্তু’ তকমা আজও লেগে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই ছিন্নমূল ওই সব মানুষের হৃদয়ে ও পার বাংলার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে শিকড়ের টান। বয়স্ক মানুষের কথায় বার বার উঠে আসে দেশভাগের ভয়াবহ স্মৃতি, আর ভিটে-মাটির কথা। তবে তরুণ প্রজন্মের সে সব মনে রাখার দায় আর কতটুকু! মিলেনিয়াম পার্ক, সংহতি পার্ককে কেন্দ্র করে বহু মানুষের নিত্য যাতায়াত এখন এই শহরে। ত্রিফলা আলোয় ঝাঁ চকচকে চেহারা নিয়েছে গোটা এলাকা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা এ সব দেখেই অভ্যস্থ একালের নাগরিক। তিন তিনটি কলেজ আছে অশোকনগরে। নানা সময়ে রাজনৈতিক কারণে টালমাটাল হলেও উচ্চশিক্ষা লাভের সমস্যা অনেকটাই কেটেছে কলকাতা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের এই শহরে। রেল ও সড়ক পথে (যশোহর রোড) যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে অশোকনগরের বহু মানুষই এখন কলকাতামুখী। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসত। সেখানেও বহু মানুষ নানা কাজে প্রতিদিন যাতায়াত করেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ও ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনা অশোকনগর-কল্যাণগড় এলাকায় অস্থায়ী সামরিক বিমান ঘাঁটি তৈরি করেছিল। তৈরি হয়েছিল সেনা ছাউনি। যুদ্ধবিমান ওঠা-নামার জন্য বানানো হয়েছিল রানওয়ে। আজও সে সবের চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এখানকার জনপদে। গোলবাজার থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত গেলেই দেখা যাবে রানওয়ের অংশবিশেষ। স্থানীয় হরিপুর ভৈরবতলা ও নিবেদিতা পল্লি এলাকায় রয়েছে ‘হ্যাঙ্গার’ বা যে ছাউনির নীচে যুদ্ধবিমান দাঁড়াত, তার ধ্বংসস্তূপ।

১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে সৈন্যেরা ফিরে যায়। সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যুদ্ধবিমানও। পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ভরে ওঠে বন-জঙ্গলে। শিয়াল, বুনো শুয়োর, বিষাক্ত সাপেরা আস্তানা গাড়ে সে সব জায়গায়। ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ও পার বাংলা থেকে আসতে শুরু করেছেন উদ্বাস্তু মানুষ। হাবরা ও সংলগ্ন এলাকায় তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে বিমান ঘাঁটি ও সেনা ছাউনিতে উদ্বাস্তুদের জন্য ক্যাম্প খোলা হয়। ঠিক হয়, পরিত্যক্ত ওই সব বিমানঘাঁটিতে তৈরি হবে উপনগরী। হাবরা আরবান কলোনি ও হাবরা রুরাল কলোনি এই দু’টি অংশে ভাগ করে উন্নয়নের পরিকল্পনা হয়। কলোনির বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের আদি বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার উত্তর সাহারাজপুর এলাকায়। তাঁদের বসবাসের জন্য নিয়ে আসা হয় রুরাল কলোনিতে। রুরাল কলোনির ওই এলাকার নামকরণ হয় ‘কল্যাণগড়’। সাহারাজপুরের মানুষ ছিলেন দেবী মনসার ভক্ত। এখনও সেই ঐতিহ্য মেনে কল্যাণগড়ের বাড়ি বাড়ি পুজো পান মনসা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশদের তৈরি করা যুদ্ধবিমানের ছাউনি। ছবি দু’টি তুলেছেন শান্তনু হালদার।

ছোট ছোট প্লটে তৈরি হয় ঘরবাড়ি। ১৯৪৯ সালে বিমানঘাঁটির জমিতে গড়া হয় এলাকায় প্রথম স্কুল ‘কল্যাণগড় বিদ্যামন্দির’। কয়েকটি দোকান নিয়ে তৈরি হয় কল্যাণগড় বাজার। ধীরে ধীরে অন্য জায়গার উদ্বাস্তু শিবির থেকেও এখানে অনেক পরিবারকে আনা হয়। ঠিক হয়, উদ্বাস্তুরা নিজেদের জমি নিজেরাই বেছে নেবেন। জমি কিনতে সরকার ৭৫ টাকা দেবে। ক্ষুদ্র ব্যবসা ও বাড়ি তৈরির জন্য দেবে আরও ৫০০ টাকা। অনেক পরিবার জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। এ ভাবেই ক্রমে গড়ে ওঠে ‘বনবনিয়া দেবীনগর কয়াডাঙা এলাকা’।

অন্য দিকে, হাবরা আরবান কলোনির প্রথমে নামকরণ হয়েছিল ‘নয়ানগর’ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক প্রয়োজনে ওই নাম পরিবর্তনের দরকার হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা একটি সভায় মিলিত হন নামকরণের জন্য। আলোচনায় তিনটি নাম উঠে আসে। ‘অশোকনগর’, ‘নয়াগড়’ ও প্রতাপগড়। শেষে ‘অশোকনগর’ নামটিই গৃহীত হয়। শুরু হয় নতুন এক জনপদের পথচলা। এক একটা বাড়ির জমি ছিল চার-ছয় কাঠা। সরকারি উদ্যোগে তৈরি বাড়িগুলিতে বহু পরিবার এসে বসবাস শুরু করেন। সামরিক বাহিনী কিছু বড় মাপের ভ্যান ফেলে রেখে গিয়েছিল। পরিত্যক্ত ওই সব ভ্যানেও কিছু পরিবার বসবাস করতে থাকেন।

১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৈরি হয় অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা। রাজ্যপাল ১৪ জন সদস্যকে মনোনীত করেন। চেয়ারম্যান হন দ্বিজেন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত। ১৯৮১ সালে প্রথম পুরভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সিপিএমের বিকাশ রায়চৌধুরী। সীমানা পুর্নবিন্যাস নিয়ে কিছু সমস্যার কারণে দ্বিতীয়বার পুরসভার নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার আয়তন ২০.৪৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের শেষ আদম সুমারি অনুসারে, জনসংখ্যা ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৯০৬ জন।

(চলবে)

kalyangarh ashoknagar simanta maitra amar shohor southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy