E-Paper

গোলমাল আঁচ করে প্যানেল বাতিলের সুপারিশ করি: পুরপ্রধান 

বাদুড়িয়া পুরসভা সূত্রের খবর, সিবিআই অফিসারেরা প্রথমে কথা বলেন প্রধান করণিকের সঙ্গে। দেখতে চান, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে নিয়োগ হয়েছে, তার সমস্ত ফাইল।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩ ০৮:৪২
বাদুড়িয়া পুরসভা থেকে ফাইল নিয়ে বেরোচ্ছেন সিবিআই আধিকারিকেরা। নিজস্ব চিত্র

বাদুড়িয়া পুরসভা থেকে ফাইল নিয়ে বেরোচ্ছেন সিবিআই আধিকারিকেরা। নিজস্ব চিত্র Sourced by the ABP

কী গোপন তথ্য হাতে এল সিবিআইয়ের ম্যারাথন তল্লাশিতে?

এই প্রশ্নটাই এখন মুখে মুখে ফিরছে টাকি, বাদুড়িয়ায়। বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই দুই পুরসভায় এক যোগে তল্লাশি চালিয়ে সিবিআই। প্রচুর কাগজপত্র, ফাইল তারা বাজেয়াপ্ত করেছে। পুরসভায় নিয়োগ-দুর্নীতির শিকড় পর্যন্ত পৌঁছতে চাইছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। টাকি এবং বাদুড়িয়ায় নিয়োগের ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারি কিছু ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে নানা জল্পনা চলছে এলাকায়। ভোটের মুখে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে এলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে শাসক দলের উপরে, চলছে তারও হিসেব-নিকেশ।

দুই পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সব কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছেন সিবিআই আধিকারিকেরা, তার ফটোকপি দেওয়া হয়েছে পুরসভাকে। কোন কোন নথি নেওয়া হয়েছে, তার তালিকা তৈরি করে সেখানে সই করানো হয়েছে। টাকির পুরপ্রধান সই করেছেন। তবে বাদুড়িয়ায় পুরপ্রধান হাজির না থাকায় এক সিনিয়র অফিসার সই করেন।

বাদুড়িয়া পুরসভা সূত্রের খবর, সিবিআই অফিসারেরা প্রথমে কথা বলেন প্রধান করণিকের সঙ্গে। দেখতে চান, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে নিয়োগ হয়েছে, তার সমস্ত ফাইল। সূত্রের খবর, এই সময়ের মধ্যে স্থায়ী পদে প্রায় ৩৫ জনের নিয়োগ হয়েছিল গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি পদে। প্রত্যেকের নিয়োগ-সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছে সিবিআই। তাঁদের বেতন-সংক্রান্ত তথ্যও নিয়েছে। সিবিআই অফিসারেরা যখন বেরোন, তখন তাঁদের হাতে ৩০-৩৫টি ফাইল ছিল।

পুরসভার একটি সূত্রের দাবি, ওই ৩৫ জনের নিয়োগ হয়েছিল একটি সংস্থার মাধ্যমে। পুরপ্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কত জনের নিয়োগ হয়েছিল, কী ভাবে নিয়োগ হয়েছিল— তা বলতে পারব না। তখন যাঁরা পদাধিকারী ছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন। তবে যতটুকু জানি, কিছু নিয়োগ একটি সংস্থার মাধ্যমে হয়েছিল। কিছু নিয়োগ পুরসভা নিজে করেছে।’’ ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থার মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট করেননি দীপঙ্কর। পুরপ্রধানের কথায়, “নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সে সময়ে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দোষীরা যেন শাস্তি পান। তা তিনি অফিসের আধিকারিক হোন বা কোনও পদাধিকারী।”টাকির

পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ২০১০ সাল থেকে আছেন এই পদে। এই সময়ের মধ্যে ২০১৭ সালে ১৬ জন স্থায়ী কর্মী নিয়োগ হয়েছিল পুরসভায়। সেই নিয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে বিভিন্ন মহলে। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে সিবিআই ওই ১৬ জনের নিয়োগের নথি বাজেয়াপ্ত করেছেন বলে জানাচ্ছে পুরসভার একটি সূত্র। পুরসভায় দীর্ঘ দিন ধরে ৪০টি চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পদ শূন্য থাকায় সেখানে কর্মী নিয়োগের জন্য অয়ন শীলের সংস্থার মাধ্যমে ২০১৮ সালে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল। ৪০ জনের প্যানেল তৈরি হয়। সেই ৪০ জনের তথ্যও সংগ্রহ করেছে সিবিআই।

সোমনাথ জানান, ২০১৭ সালে যে ১৬ জনের নিয়োগ হয়েছিল, তা পুরসভা নিজেই করেছিল।এই পুর এলাকার পাশপাশি বিভিন্ন জায়গার মানুষ সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর দাবি, ‘‘ওই নিয়োগ নিয়ে কোনও দুর্নীতি আছে বলে মনে করি না। কিন্তু যে ৪০টি চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পদে নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অয়নের সংস্থার মাধ্যমে, সেখানে সন্দেহ ছিল বিভিন্ন কারণে।’’

সোমনাথ জানান, পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। এরপরে অয়ন শীলের সংস্থা পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার আগে এই সংস্থা সম্পর্কে কিছু জানতেন না বলে দাবি সোমনাথের। অয়নকে পরে একবার মাত্র দেখেছেন বলে তাঁর দাবি। সোমনাথের কথায়, ‘‘এই সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হলেও প্রথম থেকে আমার ভাল ঠেকছিল না। তবে আমিও চাপে ছিলাম। কয়েক মাস পরে পরীক্ষার রেজাল্ট দেয় সংস্থাটি। সেই রেজাল্টের ভিত্তিতে প্যানেল তৈরি হয়। তবে আমার সন্দেহ ছিল, ওই তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে। আমার মনেও প্রশ্ন ছিল। বিভিন্ন বিষয় কানে আসছিল। তবে আমার উপরে চাপ ছিল।’’ তাঁর দাবি, ‘চাপের মুখে’ তিনি কিছু করতে পারছিলেন না বলে ডিরেক্টর অফ লোকাল বডিজ়ে (ডিএলবি) গিয়ে প্যানেলের অনুমোদন দিতে বারণ করেছিলেন। ২০২২ সালে ২১ নভেম্বর ডিএলবি থেকে প্যানেল বাতিলও করা হয়। অয়নের সংস্থা পরীক্ষার্থী পিছু ১০০ টাকা করে, অর্থাৎ ২ লক্ষ টাকার বিল ধরিয়েছিল পুরসভাকে। সেই বিল মেটানো হয়নি বলেও দাবি সোমনাথের।

অন্য দিকে, এই প্যানেল বাতিল করা নিয়ে পুরসভার আর একটি সূত্র জানাচ্ছে, এই প্যানেলকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে যান টাকি পুরসভারই কিছু অস্থায়ী কর্মী। তার জেরেই প্যানেল বাতিল হয়েছিল। তবে এই দাবি মানেননি সোমনাথ।

প্যানেল যখন তৈরি হয়েছিল, সে সময়ে অভিযোগ ওঠে, তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে অনেকের থেকে মাথা-পিছু ৪ লক্ষ করে টাকা তুলেছিলেন। যাঁরা টাকা দিয়েও চাকরি পাননি বলে অভিযোগ, তাঁদের কেউ কেউ গত পুরসভা ভোটের আগে বিষয়টি নিয়ে সরব হন। প্রকাশ্যেই ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। ওই ব্যক্তি কিছু প্রার্থীকে টাকা ফেরত দিতে শুরু করেন বলেও স্থানীয় একটি সূত্রের দাবি। সূত্রটি আরও জানাচ্ছে, ওই ব্যক্তি এক সময়ে রাজনীতে যুক্ত থাকলেও এখন সরাসরি সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। খানিকটা ‘কোণঠাসা’ দলের অন্দরে। সোমনাথ এ দিন বলেন, “কোনও বেনিয়ম হয়ে থাকলে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দোষ প্রমাণ হলে সাজা পাক আমিও চাই। আমি কাউকে চাকরি করে দেব বলে টাকা নিইনি, দুর্নীতিও করিনি।”

সিবিআইয়ের একটি সূত্রের খবর, টাকি পুরসভায় বুধবার এক আধিকারিক ছিলেন না। তাঁর ঘরের একটি আলমারির চাবি পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে চাবি খুঁজেপেতে এনে সেই আলমারি খোলায় সিবিআই। পুরসভার এক বিশেষ আধিকারিককে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। ওই আধিকারিকের বিরুদ্ধে নিয়োগ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুরসভার অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়। বিজেপির বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক সুকল্যাণ বৈদ্য বলেন, “দু’টি পুরসভাতেই শুনেছি দলের লোকেদের থেকেও টাকা নিয়ে তবে চাকরি দিয়েছে তৃণমূল। সিবিআই তদন্তে এ বার সব সামনে আসবে। মানুষ খুশি তদন্ত হওয়ায়।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Recruitment Scam baduria CBI

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy