E-Paper

ভয়ের পরিবেশ বদলাক, বলছেন ‘এনআরসি-ত্রাসে’ মৃতের পরিজন

গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া লোকসভা ভোটের মুখে ২০ মার্চ আত্মঘাতী হওয়া যুবকের নাম দেবাশিস সেনগুপ্ত। খোঁজ করে জানা গেল, তাঁর পরিবারের আর কেউই বেঁচে নেই।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:১০

—প্রতীকী চিত্র।

‘সুইসাইড নোট’-এ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) জেরে তৈরি হওয়া আতঙ্ককে দায়ী করে পানিহাটির প্রৌঢ়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘিরে এই মুহূর্তে তপ্ত বঙ্গ রাজনীতি। নানা মহলে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে দিনহাটাতেও এসআইআর-এর ভয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনাও সামনে এসেছে। তবে, এমন ঘটনা যে এ-ই প্রথম ঘটছে, তেমনটা নয়। গত বছরও লোকসভা ভোটের আগে এমনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল কলকাতায়। এনআরসি-র ভয়ে নেতাজিনগরের বাসিন্দা, বছর সাঁইত্রিশের এক যুবক আত্মঘাতী হয়েছেন বলে দাবি করেছিল তাঁর পরিবার। এই পরিস্থিতিতে পুরনো ওই ঘটনাও নতুন করে সামনে আনছেন রাজনীতির কারবারিরা। যদিও আত্মঘাতী হওয়া ওই যুবকের পরিবার এখন বলছে, ‘‘এই আতঙ্কের পরিবেশ বদলাক। মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি আর নিজের দেশে পরবাসী বানানোর এই খেলা বন্ধ হোক।’’

গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া লোকসভা ভোটের মুখে ২০ মার্চ আত্মঘাতী হওয়া ওই যুবকের নাম দেবাশিস সেনগুপ্ত। খোঁজ করে জানা গেল, তাঁর পরিবারের আর কেউই বেঁচে নেই। দেবাশিসের মাসি শোভা রায় বুধবার জানালেন, ২০১৪ সালে দেবাশিসের মা মারা যান। তার পরে মারা যান দেবাশিসের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ভাই। হোটেলে কাজ করা দেবাশিস তাঁর বাবা তপন সেনগুপ্তকে নিয়ে ভাড়ার ঘরে থাকতেন। শোভা বলেন, ‘‘ভোটের সময়ে এনআরসি আতঙ্ক চেপে ধরে দেবাশিসকে। সারা দিন মোবাইলে ভোট সংক্রান্ত অনুষ্ঠান দেখত আর বলত, আমাদেরও যদি তাড়িয়ে দেয়, কী হবে? পাড়ার লোকের কাছে মুখ দেখাব কী করে? আমার কাছে নিয়ে এসে রেখেছিলাম ওঁদের। বোঝাতাম, তোর বাবা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন বহু বছর আগে। তুই কলকাতায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জন্মেছিস। তোর ভয় কিসের?’’

কিন্তু কিছুতেই যেন আশ্বস্ত হতে পারেননি ওই যুবক। পরিস্থিতি এমন হয় যে, এনআরসি নিয়ে কথা বলতে বলতে ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হতে শুরু করে ওই যুবকের। এই কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এর পরে ভাল থাকবেন ভেবে দাদা ও ভাইপোকে হাওড়ায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যান দেবাশিসের কাকা।

কিন্তু এরই মধ্যে সোনারপুরে মামার বাড়িতে এক দিন থাকতে যান দেবাশিস। সেখানেও এনআরসি নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা বলতে থাকেন বলে তাঁর পরিবারের দাবি। এর পরে মামা কাজে বেরোলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন ওই যুবক। এর পরেই এই মৃত্যু নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। এক্স-হ্যান্ডলে বিষয়টি নিয়ে পোস্ট করে তৃণমূল। তাদের প্রতিনিধিদল মৃতের বাড়িতে যায়।

সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মোদী সরকারের ভয়ঙ্কর পদক্ষেপের এর চেয়ে খারাপ প্রভাব আর কী হতে পারে! এই মৃত্যুর দায় নিতে হবে কেন্দ্রের সরকারকেই।’’ এর পরে নানা জনসভায় তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের বলতে শোনা যায়, ‘‘মোদীর হাতে দেবাশিসদের রক্ত লেগে রয়েছে। ভোটে জিতলেও এই রক্তের দাগ যাবে না।’’ বিজেপি অবশ্য মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ তোলে।

দেবাশিসের মাসি, বর্তমানে ক্যানসার আক্রান্ত শোভা বললেন, ‘‘প্রতিনিধিদল এল, রাজনীতি হল। কিন্তু আমাদের কী লাভ হল? আসলে যার যায়, তার যায়।’’ এর পরে তিনি জানান, ছেলের মৃত্যুর পরে দেবাশিসের বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হয়েছিল। দেড় বছরের মধ্যেই গত অগস্ট মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। মহিলা বলেন, ‘‘অগস্টেই আমারও ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। কেউ আমাদের খোঁজ রাখেনি। রাজনীতির লোকেদের কাছে অনুরোধ, নিজের দেশে বিদেশি হওয়ার ভয়েই শেষ হচ্ছে প্রাণ। আর কাউকে যেন এমন চরম কোনও পথ বেছে নিতে না হয়।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Death Case SIR

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy