Advertisement
E-Paper

থমকে স্রোত, মন খারাপের ডাক দিয়ে যায় মজে যাওয়া পাঁচ নদী

কোথায় গেল নদীর সেই উচ্ছ্বল বিভঙ্গ...। কোথায় গেল তার চপল জলরাশি...। সন্ধে নামলেই শোনা যেত দূরগত মাঝির গলায় ভাটিয়ালির সুর। নৌকো টেনে, মাছ ধরে কত লোকের জীবিকার সংস্থান করে দিয়েছিল নদী।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০০:১২
হতশ্রী কোদালিয়া।

হতশ্রী কোদালিয়া।

কোথায় গেল নদীর সেই উচ্ছ্বল বিভঙ্গ...। কোথায় গেল তার চপল জলরাশি...। সন্ধে নামলেই শোনা যেত দূরগত মাঝির গলায় ভাটিয়ালির সুর। নৌকো টেনে, মাছ ধরে কত লোকের জীবিকার সংস্থান করে দিয়েছিল নদী।

কিন্তু অধুনা সে সবই ইতিহাস। আগাছায় ঢাকা হৃতযৌবনা নদীর বুকে আর জোয়ার-ভাটা খেলে না। জলের স্রোত আটকে দিয়েছে আগাছার দাপাদাপি। কোথাও আবার গবাদি পশু চরে বেরায় শুকনো নদীখাতে। কোথাও নদী তার সব রূপ হারিয়ে সরু নালার চেহারা নিয়ে মুখ লুকিয়েছে গ্রামের আনাচে-কানাচে।

বাগদার কোদালিয়া বা কোদলা নদীর এখন এমনই দশা। বর্ষায় জল সামান্য বাড়ছে। তবে বছরের বেশির ভাগ সময়ে নদীর একাংশ শুকিয়ে শুকিয়েই থাকে। আষাঢ়ু বাজারের কাছে সেতুর উপরে দাঁড়ালে দেখা যাবে নদীর বুক দখল করে নিয়েছে কচুরিপানা। স্থানীয় কাদারডাঙা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, নদীর চরে ঝোপ-জঙ্গল। গরু চরছে। নদীর মধ্যে আড়াআড়ি বান্দাল পেতে রাখা হয়েছে। ফলে জলের স্বাভাবিক গতি বাধা পাচ্ছে।

কোদালিয়াই শুধু নয়, বাগদার আরও যে চারটি নদী, তাদেরও অবস্থা করুণ। ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাগদা ব্লকে নদীর সংখ্যা পাঁচটি। ইছামতী, কোদালিয়া, বেত্রাবতী বা বেতনা, কপোতাক্ষ এবং গড়াইল। সব মিলিয়ে নদী হিসাবে ব্লকে জলপথ রয়েছে ৬১.০৫ কিলোমিটার।

নদী তার নাব্যতা হারানোয় নিকাশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। আবার জল ধারণের ক্ষমতা না থাকায় বর্ষার মরসুমে নদীর কোল ছাপিয়ে জল ঢুকে পড়ে লোকালয়ে বা কৃষিজমিতে। বহু এলাকা প্লাবিত হয় ফি বছর। ওই জল সরতে মাস তিনেক সময় লাগে। সে সময়ে কৃষিকাজ বন্ধ থাকে বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে। চাষিরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বছর তিরিশ আগেও ছিল অন্য চিত্র। অতীতে বাগদার মানুষের পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম ছিল জলপথ। সে সব বহু কাল বন্ধ। নদী মজে যাওয়ায় অনেক কর্মহীন হয়েছেন। অনেকে জীবিকা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে ভিন রাজ্যে চলে গিয়েছেন। মৎস্যজীবী থেকে অনেকেই খেতমজুর বা দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। অনেকেই নৌকা বিক্রি করে দিয়েছেন। মাছ ধরার জাল বাড়িতে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়েছে। কথা হচ্ছিল বাবলু দাসের সঙ্গে। বললেন, ‘‘অনেক কষ্টে বাপ-ঠাকুর্দার পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। আগে মাছ ধরতাম। এলাকার বাজারগুলোতে বিক্রি করে বেশ দিন চলে যাচ্ছিল। এখন লোকের জমিতে কাজ করতে হয়। চোখ ফেটে জল আসে। কিন্তু কী করব, বেঁচে তো থাকতে হবে।’’ ভুবন বিশ্বাস বললেন, ‘‘এক সময়ে কোদলা নদী থেকে মাছ ধরে বাগদার বাজারে বিক্রি করতাম। ২০০০ সালের বন্যার পর থেকেই নদীর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। গত দশ বছর ধরে তো বর্ষার সময় ছাড়া নদীতে জল তেমন থাকেই না। এখন মাছও পাওয়া যায় না। তাই বিভিন্ন বাজার থেকে মাছ পাইকারি কিনে হাটে-বাজারে বিক্রি করি।’’

অতীতে কোদলা নদী থেকে রিভার পাম্পের মাধ্যমে জল নিয়ে জমিতে চাষ করতেন অনেকে। এখন সেচের কাজেও নদীর কোনও উপযোগিতা নেই। কয়েক দিন আগেও অনাবৃষ্টিতে সেচের অভাবে পাটচাষ মার খাচ্ছিল এলাকায়। স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা হলধর দাস জানালেন, একটা সময় ছিল। যখন নদীর জল বইত তরতরিয়ে। সেই জলেই সেচ হতো এলাকায়। শ্যালো চালিয়ে জল কেনার ক্ষমতা আর ক’জনের আছে। সকলের কাছে নদীই ছিল ভরসা। কিন্তু সে দিন গিয়েছে! হতাশ শোনায় হলধরের গলা।

বলাই মণ্ডল নামে চ্যাঙাচাঁদপুর এলাকার এক প্রবীণ চাষি বলেন, ‘‘চাষের জন্য এখন আমাদের আকাশের জলের উপরেই নির্ভর করে থাকতে নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে রিভার পাম্পের ব্যবস্থা হলে আমরা উপকৃত হবো।’’

ইছামতী নদীর কথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার বার বার এসেছে। বাগদা-বনগাঁর উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে এই নদী। কিন্তু বাগদায় ইছামতীর সেই অতীত গরিমা আজ প্রায় কিছুই নেই। স্রোত হারিয়ে তার চেহারা এখন বদ্ধ জলাশয়ের মতোই। কচুরিপানায় মুখ ঢেকেছে নদীপথ। বাগদায় ইছামতী থেকে কচুরিপানা সরানো বা পলি তোলার কাজ কখনওই হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, নদিয়ার পাবাখালিতে নদীর উৎসমুখ সংস্কার করা না হলে নদী অতীত চেহারায় ফিরবে না।

কপোতাক্ষ নদীর নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখার অনুষঙ্গ। বাংলাদেশ থেকে জন্ম নিয়ে সেই নদী উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার প্রায় ৬ কিলোমিটার অংশ ছুঁয়ে গিয়েছে। সেই নদীটিরও মৃতপ্রায় দশা। বেত্রাবতী বা বেতনা নদী কিংবা গরাইল নদীরও একই হাল। স্থানীয় সাগরপুরে গিয়ে দেখা গেল, নদীর মধ্যে মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদী কেটে ছোট ছোট জলাশয় তৈরি করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বাসিন্দারা জানালেন, কিছু মানুষ নদীকে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ব্যবহার করেছেন। গতিপথকে বার বার বাধা দিয়েছেন। সে জন্যই নদী ক্রমে তার নাব্যতা হারিয়েছে।

রাজ্য সরকারও নদী সংস্কারের ব্যাপারে কখনওই উদ্যোগী হয়নি। তা নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ আছে এলাকার মানুষের। বিডিও মালবিকা খাটুয়া বলেন, ‘‘ব্লকের পাঁচটি নদী সংস্কারের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ব্লক প্রশাসনের নদী সংস্কার করার মতো তহবিল নেই।’’ তবে মাছ ধরার জন্য বেআইনি ভাবে নদীতে থাকা ভেচাল-পাটা-কোমর-বান্দাল সরানোর বিষয়ে প্রশাসন পদক্ষেপ করবে বলে বিডিও জানিয়েছেন। অতীতে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে নদী থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করে বা নদীর মাটি কাটার কাজ করার ব্যবস্থা ছিল। এখন ওই প্রকল্পে সেই কাজ করারও সুযোগ নেই। ফলে নদীর হাল ফেরার কোনও আশা আপাতত দেখছেন না স্থানীয় মানুষ।

(চলবে)

Five river Critical situation bagda water simanta maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy