প্রাপ্তি শুধুই কয়েন। বুধবার শ্যামনগর ডাকঘরে।-নিজস্ব চিত্র।
চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়াচ্ছিল রেণুবালা চক্রবর্তীর!
বয়স সত্তর পেরিয়েছে। সংসারে তিনি একাই। পাঁচ হাজার টাকা তোলার জন্য গত সপ্তাহে তিন দিন ডাকঘরে লাইন দিয়েও পাননি। চতুর্থ দিন পেলেন। প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরা ১০ টাকার কয়েনে পাঁচ হাজার টাকা! মোট ৫০০টি কয়েন।
কে বসে বসে এই কয়েন গুনবে? কী করে এই বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরবেন অশক্ত বৃদ্ধা? সঙ্গে এনেছিলেন ছোট্ট একটি ব্যাগ। শেষমেশ একটি দোকান থেকে থলে কিনে এনে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ির পথ ধরলেন বৃদ্ধা।
রেণুবালাদেবী একা নন। বৃদ্ধ বয়সে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে টাকা তুলতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন ব্যারারপুরের দু’টি মুখ্য ডাকঘরের গ্রাহকেরা। যাঁদের অনেকেই সত্তরের চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছেন অনেক দিন আগে। কেউবা দোরগোড়ায়। কারণ, এক সপ্তাহ ধরে ব্যারাকপুর এবং শ্যামনগর মুখ্য ডাকঘরে কার্যত টাকা নেই। কয়েনই ভরসা। আর সেই কয়েন নিয়েই জেরবার হচ্ছেন বৃদ্ধবৃদ্ধারা। মাসিক সঞ্চয় প্রকল্পে জমানো টাকা তুলতে যে এমন হ্যাপা, আন্দাজ করতে পারেননি তাঁরা।
ব্যারাকপুর মুখ্য ডাকঘরটি শহরের এক প্রান্তে। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা তুলে সংসার চালান ভট্টাচার্যপাড়ার বাসিন্দা রেণুবালাদেবী। বহু কাঠখড় পেরিয়ে গত সপ্তাহের শেষ দিকে পাঁচ হাজার টাকার কয়েন নিয়ে বাড়ি ফেরার পরে তিনি বলেন, ‘‘আমার একার সংসার। দু’টো অটো পাল্টে ডাকঘরে যেতে হয়। কয়েন দেওয়ার কথা ডাকঘর তো আগেই বলে দিতে পারত। এত কয়েন নিয়ে কী করব?’’
কিছুদিন আগেই জনস্বার্থ মামলায় নোট সঙ্কট দ্রুত কাটানোর জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে। কিন্তু তার পরেও দুই ডাকঘরে নোটের আকাল। অথচ, গত ৮ নভেম্বর কেন্দ্র ৫০০ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল করার পরেও পরিস্থিতি এতটা সঙ্গিন হয়নি বলে জানিয়েছেন গ্রাহকেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘তখন অন্তত দু’হাজারের নোট মিলছিল। এখন তা-ও মিলছে কম।’’ টাকা না পেয়ে মঙ্গলবারই শ্যামনগর মুখ্য ডাকঘরের কর্মীদের ঢুকতে দেননি গ্রাহকেরা।
শ্যামনগরে যখন ওই বিক্ষোভ চলছে, তখন ব্যারাকপুর মুখ্য ডাকঘরের সামনের দোকানগুলিতে ৮০০ টাকা খুচরোর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন এক বৃদ্ধ। ডাকঘর থেকে তাঁর ১২০০টাকা তোলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেখানকার কর্মীরা তাঁকে জানিয়ে দেন, দু’হাজারের নোট দেওয়া হবে। তিনি যেন ৮০০ টাকা নিয়ে আসেন। অগত্যা, বৃদ্ধ রাস্তায় নেমে সঙ্গে থাকা আর একটি দু’হাজারের নোট ভাঙানোর মরিয়া চেষ্টা চালালেন।
গুড়দহের অনিমেষ সামন্তের দু’চোখেই ছানি। দশ টাকার কয়েনে দু’হাজার টাকা পেয়ে গুনে দেওয়ার জন্য তিনি ডাকঘরের মধ্যেই একে-ওকে ধরছিলেন।
কেন এই অবস্থা? শ্যামনগর মুখ্য ডাকঘরের পোস্টমাস্টারের দাবি, ‘‘ডাকঘরের টাকা আসে স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে। পর্যাপ্ত নোট না আসায় কয়েন দিতে বাধ্য হচ্ছি।’’ ব্যারাকপুরে প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের সিনিয়র পোস্টমাস্টার বলেন, ‘‘ই-মেল করে কেউ সমস্যা জানালে গুরুত্ব খতিয়ে দেখে জবাব দেওয়া হবে।’’
কে করবেন ই-মেল? অনিমেষবাবু, রেণুবালাদেবীরা? বয়সের ভার যাঁদের শারীরিক সক্ষমতা অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে! ব্যারাকপুর মুখ্য ডাকঘরের এক যুবক গ্রাহকের খেদ, ‘‘ওঁরা তো বলেই খালাস।
কয়েন তো নয়, যেন মোহর দিচ্ছে, এমন হাবভাব! মানুষের কষ্ট আর বোঝে কে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy