E-Paper

বিজেপি বিধায়ক বলার পরেই বনগাঁয় ইডির তল্লাশি

রেশন দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বনগাঁর মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, রাধাকৃষ্ণ ফ্লাওয়ার মিল এবং রাধাকৃষ্ণ রাইস মিল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে।

সীমান্ত মৈত্র  

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৯
কালিদাস সাহাকে বনগাঁ কোড়ারবাগানের বাড়ি থেকে কালুপুরের রাধাকৃষ্ণ ফ্লাওয়ার মিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । নিজস্ব চিত্র

কালিদাস সাহাকে বনগাঁ কোড়ারবাগানের বাড়ি থেকে কালুপুরের রাধাকৃষ্ণ ফ্লাওয়ার মিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । নিজস্ব চিত্র

রেশন দুর্নীতির প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে গোপালনগরের নহাটা বাজার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছিল বিজেপি। সেখানে বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার দাবি করেছিলেন, ‘‘রেশন কেলেঙ্কারিতে বনগাঁরও কিছু লোক জড়িত। আগামী দিনে ওই মিল মালিকও ছাড়া পাবেন না। আটার মধ্যে ভুষি মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। উনি রাধাকৃষ্ণ মিলের মালিক। উনি সেটিং খুঁজছেন বাঁচার জন্য। সেটিংয়ে কোনও কাজ হবে না। জেলখানায় তাঁকে যেতেই হবে।’’

ঘটনাচক্রে, বিজেপি বিধায়কের এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, শনিবার সকালে বনগাঁয় রাধাকৃষ্ণ মিল এবং মালিকদের বাড়িতে ইডি কর্তারা হানা দিলেন। মিলটি বনগাঁ ব্লকের কালুপুর এলাকায়, যশোর রোডের পাশে। মালিকের বাড়ি বনগাঁ শহরের কোড়ালবাগান এলাকায়।
এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি বিজেপি বিধায়ক আগে থেকেই ইডির অভিযানের কথা জানতেন?

স্বপনের কথায়, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি করছি। অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কথা বলে থাকি, যা বাস্তবে খেটেও যায়। তা ছাড়া, রাধাকৃষ্ণ মিলের মালিকেরা যে রেশন দুর্নীতিতে জড়িত, তা সকলেই জানতেন।’’

বনগাঁর পুরপ্রধান তৃণমূলের গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘মিলে ইডির তল্লাশি নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। আইন আইনের পথে চলবে। মামলায় বিচারক রায় দেওয়ার পরে যা বলার বলব।’’
রেশন দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বনগাঁর মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, রাধাকৃষ্ণ ফ্লাওয়ার মিল এবং রাধাকৃষ্ণ রাইস মিল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে। জ্যোতিপ্রিয়ের সঙ্গে মিল কর্তৃপক্ষ কালিদাস সাহা এবং মন্টু সাহাদের সুসম্পর্কের কথা বনগাঁর মানুষের অজানা নয়। জ্যোতিপ্রিয়ের সঙ্গে কালিদাসদের ঘনিষ্ঠতা তৈরির পর থেকে তাঁরা আর্থিক ভাবে কেমন ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন, তা এলাকার লোকজনের নজর এড়ানোর কথাও নয়। তবে কালিদাসদের বাড়িতে জ্যোতিপ্রিয়কে কখনও কেউ আসতে দেখেননি বলেই জানালেন এলাকার মানুষ।

বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডলের দাবি, ‘‘বনগাঁ শহরের ৯০ শতাংশ সম্পত্তি এখন কালিদাসদের। পেট্রল পাম্প, একাধিক মল, একাধিক বাড়ি, জমি সহ বিপুল সম্পত্তির মালিক তাঁরা। আর এ সব সম্ভব হয়েছে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর বদান্যতায়।’’
কালিদাসদের কাছ থেকে চেনেন এমন মানুষেরা জানালেন, বহু বছর আগে বনগাঁ শহরে নিউ মার্কেট এলাকায় কালিদাসদের পারিবারিক মুদিখানা ছিল। পরে বাংলাদেশ থেকে নামী সংস্থার সাবান এনে ব্যবসা শুরু করেন তাঁরা। কেরোসিন তেলের ডিলারশিপ আছে। তবে তাঁদের ফুলেফেঁপে ওঠা শুরু হয় ২০১১ সালের পর থেকে।

কালুপুর এলাকায় যশোর রোডের পাশে বাম আমলে জমি কিনে প্রথমে তাঁরা রাধাকৃষ্ণ ফ্লাওয়ার মিল তৈরি করেন। ২০১৫ সালে তৈরি করেন রাধাকৃষ্ণ রাইস মিল। রাইস মিলের উদ্বোধনে এসেছিলেন বনগাঁর তৎকালীন সাংসদ তৃণমূলের মমতা ঠাকুর। সেই জমি কেনা কিনেও প্রবঞ্চনার অভিযোগ রয়েছে। ওই জমির কেনা হয়েছিল বাড়ি তৈরি করা হবে বলে। জমি যাঁর ছিল, তাঁর ছেলে দেবব্রত মণ্ডল শনিবার বলেন, ‘‘সাড়ে ৪ বিঘা জমি তিন ভাই বাড়ি করবে বলে নকশা দেখিয়ে কিনেছিলেন ২০০৭ সালে। কিছু দিন জমি ফেলে রাখা হয়। পরে পাঁচিল দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে ফ্লাওয়ার মিল তৈরি করা হয়।’’

কালুপুরে ফ্লাওয়ার মিল ও রাইস মিল নিয়ে সংলগ্ন এলাকার মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। শনিবার মিলের কাছে জড়ো হয়ে মহিলারা জানালেন, মিলের কারণে কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ে বাড়িঘর ভরে যায়। চোখমুখ জ্বালা করে। চিমনি যতটা উঁচু হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তা নাকি হয়নি। তা ছাড়া, মিল থেকে উড়ে আসা ভুষি সমস্যা সৃষ্টি করে। মহিলারা অতীতে এ সবের প্রতিবাদ করেছিলেন। অভিযোগ, তাতে কোনও কাজ হয়নি।

মিলের গেটে বড় বড় করে লেখা, ‘এখানে ময়দা, আটা, সুজি, চাল কোয়াললিটি প্রোডাকশন করা হয়।’ এলাকার মানুষের অভিযোগ, এই মিলের আটা, চাল রেশনে সরবরাহ করা হত। রেশন থেকে সেই আটা মানুষ কিনে দেখেছেন, সাড়ে সাতশো গ্রাম প্যাকেটে ২০০ গ্রাম ধান ও গমের ভুষি মেশানো থাকত। চাল এতটাই নিম্নমানের, মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না বলে অভিযোগ।
বাসিন্দারা অনেকে জানালেন, আটার সঙ্গে মেশানোর জন্য ধানের ভুষি আনা হত বর্ধমান থেকে। অভিযোগ, এ ভাবেই লাভবান হতেন কালিদাসেরা।

রাজনৈতিক ভাবেও তাঁরা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়ের ছত্রচ্ছায়ায়। স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও তাঁদের সমঝে চলতেন। গত পুরভোটের আগে বনগাঁয় তৃণমূলের যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, প্রথমে তাতে কালিদাস সাহার নাম ছিল ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে। পরে ওয়ার্ডের কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে অমিতাভ দাসকে সেখানে প্রার্থী করা হয়। ইডির তল্লাশি নিয়ে তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস বলেন, "ইডি-সিবিআই এখনও কোনও মামলার নিষ্পত্তি করতে পারেনি। কারা প্রকৃত দোষী, তা জানাতে পারেনি। ফলে ইডি-সিবিআইয়ের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। ইডি-সিবিআইকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangaon Enforcement Directorate BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy