শোকার্ত: কার্তিক ঘোষের পরিবার। ছবি: নির্মল বসু
ওঁরা বাবাকে বাঁচাতে পারেননি। কিন্তু ‘চাচা’কে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
গত বুধবারের বিকেল। বসিরহাট তখন জ্বলছে। দু’পক্ষের কিছু লোকের উন্মত্ত আস্ফালন সামলাতে পুলিশ নাজেহাল। সেই ‘আঁধারের’ মধ্যেও ‘আলো’ জ্বেলেছিলেন দুই ভাই— প্রভাশিস ও দেবাশিস। দাঙ্গায় রক্তাক্ত বাবা কার্তিক ঘোষের সঙ্গে একই অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে নিয়েছিলেন অচেনা ‘চাচা’ ফজলু সর্দারকে। কাঁদানে গ্যাসের শেলে ফজলুর মুখ ফেটে গিয়েছিল। দেবাশিস বাবার স্যালাইনের বোতল ধরেছিলেন। প্রভাশিস ‘চাচা’র। এই ভাবে সোজা আর জি কর হাসপাতাল। পরের দিন কার্তিকবাবু মারা যান। ফজলু বেঁচে গিয়েছেন।
ছন্দে ফেরা বসিরহাটে এই কাহিনি এখন অনেকের মুখেই ফিরছে। সে দিনের ওই যাত্রার সাক্ষী বসিরহাট জেলা হাসপাতালের সুপার শ্যামল হালদার এখনও বিস্মিত। এসডিপিও শ্যামল সামন্তের কথায়, ‘‘বেনজির দৃষ্টান্ত।’’ ফজলুর জামাই জিয়ারুল ইসলাম মণ্ডল বলছেন, ‘‘ওঁদের কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে গেলাম। হাসপাতালে থাকলেও শ্বশুরমশাই এখন সুস্থ। শুধু কার্তিকবাবু ফিরলেন না, এটাই আফসোস।’’
আর ‘চাচা’কে বাঁচিয়ে প্রভাশিস-দেবাশিসরা বলছেন, ‘‘এই শিক্ষা তো ছোট থেকে বাবার কাছেই পেয়েছি। কারও বিপদ হলেই বাবা ছুটে যেতেন। ফজলু চাচাকে বাঁচাবো না? গোলমাল করেছে তো কিছু দুষ্কৃতী। চাচার দোষ কোথায়?’’
বসিরহাটের ট্যাঁটরার শ্রীকৃষ্ণ পল্লিতে কার্তিকবাবুর বাড়ি। স্ত্রী, দুই ছেলে, বউমা, নাতি, নাতনি— সব মিলিয়ে ন’জনের পরিবার ছিল। বছর সত্তরের কার্তিকবাবু মুরগির ব্যবসা করতেন। মূলত তাঁর উপার্জনেই সংসার চলত। প্রভাশিস একটি বেসরকারি সংস্থায় সামান্য বেতনের চাকরি করেন। দেবাশিসের চায়ের দোকান রয়েছে ট্যাঁটরা বাজারে। গত বুধবার সকালে ব্যবসার কাজেই হাসনাবাদে যান কার্তিকবাবু। ফেরার সময়ে পাইকপাড়ায় গোলমালের মধ্যে পড়ে যান। দুষ্কৃতীরা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। খবর পেয়ে ছেলেরা গিয়ে তাঁকে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার্তিকবাবুকে কলকাতার হাসপাতালে ‘রেফার’ করেন। অনেক চেষ্টায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স মেলে।
ওই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন শ্বেতপুরের বাসিন্দা ফজলু। অবস্থার অবনতি হয় তাঁরও। তাঁকেও কলকাতার হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অশান্ত বসিরহাটে অ্যাম্বুল্যান্স মিলছিল না। বসিরহাট হাসপাতালের সুপার শ্যামলবাবু আতান্তরে পড়ে অনুরোধ করামাত্র প্রভাশিসরা তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সে বাবার পাশেই জায়গা করে দেন ‘চাচা’ ফজলুর। তার পরে সোজা কলকাতা। কিন্তু এতেই দায়িত্ব শেষ করেননি প্রভাশিসরা। যেতে যেতে কোনও মতে ফজলুর কাছ থেকে তাঁর জামাইয়ের ফোন নম্বর জেনে যোগাযোগ করেছেন। হাসপাতালে ফজলুর সিটি স্ক্যানের খরচও জুগিয়েছেন। শুধু পারেননি বাবাকে ফিরিয়ে আনতে।
‘‘চাচাকে তো বাঁচাতে পারলাম। বাবার কথা রাখতে পেরেছি। এখন মুখ্যমন্ত্রী যদি আমাদের পাশে থাকেন, তা হলে সংসারটা বাঁচে।’’—কেঁদে ফেলেন প্রভাশিস। জিয়ারুল বলেন, ‘‘আমরা সব সময় ওঁদের পাশে থাকব। আমরা দুই সম্প্রদায় তো চিরকাল একসঙ্গেই থেকেছি। কোথা থেকে কিছু দুষ্কৃতী এসে সব ওলটপালট করে দিল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy