Advertisement
E-Paper

Panihati: হঠাৎ একটা চাপ এল, আর সামলাতে পারলাম না, আমাদের মাড়িয়ে দিয়েই কয়েকশো মানুষ চলে গেল

জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলাম আমি নিজে শুয়ে রয়েছি। কিন্তু দাদা-বৌদিকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। পরে শুনলাম দাদা-বৌদি, দিদি কেউ বেঁচে নেই।

চন্দনা দাস 

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২২ ০৬:৪২
(বাঁ দিকে) মন্দিরের পাশের একটি স্কুলে অস্থায়ী শিবিরে চলছে অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসা। (ডান দিকে) ভিড়ে অসুস্থ হয়ে পড়া এক মহিলার চিকিৎসা চলছে রাস্তার পাশেই। রবিবার, পানিহাটিতে।

(বাঁ দিকে) মন্দিরের পাশের একটি স্কুলে অস্থায়ী শিবিরে চলছে অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসা। (ডান দিকে) ভিড়ে অসুস্থ হয়ে পড়া এক মহিলার চিকিৎসা চলছে রাস্তার পাশেই। রবিবার, পানিহাটিতে। নিজস্ব চিত্র।

একে সঙ্কীর্ণ গলিপথ। সেই পথেই হাজার হাজার মানুষের ভিড়। কত দূর থেকে যে লোকজন এসেছেন, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। ভিড়ের চাপে কিছুতেই পথ এগোচ্ছিল না। সেই ভিড় ঠেলেই আমরা সকলে মন্দিরের সামনে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল, পিছন থেকে কেউ যেন একটা ধাক্কা দিল। সেই চাপ আর সামলাতে পারিনি। হুড়মুড়িয়ে রাস্তাতেই পড়ে গেলাম। আমার সামনে ছিল দাদা-বৌদি আর দিদি। তাঁদেরকেও দেখলাম পড়ে যেতে। সবাইকে মাড়িয়েই যে যার মতো চলে যেতে লাগল। এর পর আর আমার জ্ঞান ছিল না।

জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলাম আমি নিজে শুয়ে রয়েছি। কিন্তু দাদা-বৌদিকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। পরে শুনলাম দাদা-বৌদি, দিদি কেউ আর বেঁচে নেই। অথচ আমাদের দিনের শুরুটা হয়েছিল অনেক উৎসাহ নিয়ে। পানিহাটির দণ্ডমহোৎসবে আসব বলে পরিকল্পনা করে তোড়জোড় চলেছিল কয়েক দিন আগে থেকেই।

পূর্বস্থলীর বেলেরহাটের বাড়ি থেকে রবিবার ভোর চারটেয় আমরা বেরিয়ে ছিলাম। দলে ছিলাম ছ’জন। সকলের একই পাড়ায় বাড়ি। দাদা (সুভাষ পাল) আর বৌদি (শুক্লা পাল) এক দিন আগেই পানিহাটিতে নিজের নতুন ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলেন। তবে দিদি (ছায়া দাস) এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে। ভোরের ট্রেন ধরে আমরা সবাই কোন্নগর স্টেশনে নামি। সেখান থেকে গঙ্গা পেরিয়ে পানিহাটি আসি। কাল রাতেও ফোন করে কথা হয়েছিল দাদার সঙ্গে। দাদা আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তাঁর নতুন ফ্ল্যাটে থাকতে হবে। গঙ্গা পেরিয়ে যখন পানিহাটি পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। আমাদের নিয়ে আসতে সকালেই দাদা নিজে গঙ্গার ঘাটে চলে গিয়েছিলেন। নিজেই আমাদের সবাইকে ফেরিঘাট থেকে ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। ওখানেই খাওয়াদাওয়া করে সকলে একসঙ্গে বেরোলাম। সেই বেরোনোই যে দাদা-বৌদি ও দিদির শেষ বারের মতো হবে, কে জানত!

তখন প্রায় সকাল দশটা হবে। সকালের দিকে যে রাস্তা দিয়ে তা-ও আসা যাচ্ছিল, দ্বিতীয় বার যখন সেই পথে বেরোলাম, দেখি বদলে গেছে তার চেহারা। জনারণ্য কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। দাদারফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায় তখন হাজার হাজার মানুষের ভিড়। এমন ভিড় যে, ফ্ল্যাটের দরজা থেকে রাস্তায় পা ফেলাই দুরূহ হয়ে গিয়েছিল। সেই ভিড় ঠেলেই দাদা-বৌদি আমাদের সকলকে প্রথমে রঘুনাথ মন্দিরে নিয়ে গেল। সেখানে ভিড় থাকলেও তবু কোনও রকমে মন্দিরে যাওয়া যাচ্ছিল। এর পরে গঙ্গার তীরের মূল মন্দির দেখব বলে সকলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে যে এমন হবে তা তো বুঝতেই পারিনি।

মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় কাতারে কাতারে লোক। কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে, কে কোন দিকে যাচ্ছে— কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।মন্দিরের দিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরেও যে ভিড়ের জন্য বেরিয়ে আসব সেই উপায়ও ছিল না। পিছন থেকে যেন মানুষের ঢেউ ঠেলে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।বলতে গেলে ওই ভিড়ই আমাদের ঠেলে নিয়ে গেল। কিন্তু মন্দিরের সামনে আর যাওয়ার উপায় ছিল না। হাজার হাজার লোক মন্দির থেকে বেরোচ্ছে, কেউ ঢোকার চেষ্টা করছে। এই ঠেলাঠেলি কিছু সময় ধরেই চলছিল।

হঠাৎ এমন একটা চাপ এল, যেটা আর সামলাতে পারলাম না। এক সঙ্গে প্রায় কয়েকশো মানুষরাস্তাতেই পড়ে গেলাম। আমাদের মাড়িয়েই কয়েকশো লোক চলে গেল। এর পরে আর আমার কিছু মনে নেই। চোখে-মুখে জল দেওয়ার পরে আমার জ্ঞান যখন ফিরল, দেখি পাশেই দাদা-বৌদি, দিদি শুয়ে রয়েছেন। আমার স্যালাইন চলছে। বাকিদের কারও কোনও জ্ঞান নেই। এর পরেগাড়িতে করে তিন জনকে হাসপাতালে নিয়ে চলে গেল। পরে শুনলাম, তিন জনের কেউ বেঁচে নেই। বাড়িতে গিয়ে কী বলব আমি, সেটাই জানি না।

(মৃতদের পরিজন)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

Panihati Incident
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy