Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Prawn Farming

চিংড়ি চাষে টানা লোকসান, পেশা বদলাচ্ছেন বহু চাষি

২০২২ সালে আসে ইয়াস। বহু পুকুরের চাষ নষ্ট হয় নদীর বাঁধ ভেঙে। যে সব জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙে ক্ষতি হয়নি, সেখানেও  বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। ফলে দ্রুত বিক্রি করতে হয় চিংড়ি। তার জেরেও ক্ষতি হয়েছিল।

A Photograph of Prawn Farming

ক্ষতির জেরে এমন অনেক পুকুরেই চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজস্ব চিত্র।

নবেন্দু ঘোষ 
হাসনাবাদ শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৩ ০৬:২৭
Share: Save:

করোনা-কাল থেকে শুরু করে একের পর এক ধাক্কায় ধরাশায়ী কোটি কোটি টাকার চিংড়ি চাষ। এ বার চাষ হচ্ছে না বহু পুকুরে। বহু চিংড়ি চাষি চাষ বন্ধ করে ঋণের দায়ে ভিন্‌ রাজ্যে চলে গিয়েছেন শ্রমিকের কাজ নিয়ে। এই অবস্থা হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি এলাকার।

সূত্রের খবর, ২০১০ সাল থেকে হাসনাবাদ এলাকায় শুরু হয় ভেনামি চিংড়ি চাষ। এরপরে ক্রমশ এই চাষ বাড়তে থাকে। চাষ ছড়িয়ে পড়ে হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালির নদী এলাকায়। কারণ, এই চাষ করতে গেলে নদীর জল প্রয়োজন হয়। চিংড়ি চাষিরা জানালেন, চাষের বিভিন্ন সামগ্রী বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসে। করোনা-কালে সে সব আসা বন্ধ হয়ে যায়। তাই চাষ ভাল হয়নি। তবে জমির লিজ়ের টাকা গুনতে হচ্ছিল। সেই সঙ্গে কর্মীদেরও টাকা দিতে হয়েছে।

২০২১ সালে মাছ চাষ পুরোদমে শুরু হলেও রফতানি হচ্ছিল না বিভিন্ন দেশে। ফলে মাছের দাম তেমন ওঠেনি।

২০২২ সালে আসে ইয়াস। বহু পুকুরের চাষ নষ্ট হয় নদীর বাঁধ ভেঙে। যে সব জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙে ক্ষতি হয়নি, সেখানেও বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। ফলে দ্রুত বিক্রি করতে হয় চিংড়ি। তার জেরেও ক্ষতি হয়েছিল।

২০২২ সালে চিংড়ি উৎপাদন খারাপ হয়নি। কিন্তু দাম খুব কম ছিল বলে জানালেন চাষিরা। ১৫-২০ গ্রাম ওজনের চিংড়ির দাম ছিল কেজি প্রতি প্রায় ১০০ টাকা কম। ২০-২৫ গ্রাম চিংড়ি দাম ছিল ১০০-১৫০ টাকা কম। ৪৫ গ্রাম ওজনের চিংড়ির দাম ছিল প্রায় ৩০০ টাকা কম। ফলে চিংড়ি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। চাষিদের দাবি, চিংড়ি বিক্রির সাত দিনের মধ্যে টাকা দিয়ে দিত কোম্পানি। কিন্তু এ বার মাছ রফতানির সমস্যা ছিল। তাই টাকা পাওয়া যায় ৬-৭ মাস পরে। ফলে ব্যাঙ্ক ঋণের টাকার সুদ দিতে অবস্থা খারাপ হয়েছিল অনেকেরই।

সব মিলিয়ে লাভ হয়নি বহু চাষির। তাই এ বার চাষ করছেন না বেশিরভাগ চাষি। হাসনাবাদ এলাকার চিংড়ি চাষের খাদ্য ও ওষুধ বিক্রির ব্যাবসায়ী গৌতম পাত্র জানান, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ১০ হাজার টন চিংড়ির খাদ্য বিক্রি করেছেন। ২০২২ সালে তা কমে হয় ৯ হাজার টন। এ বার ২ হাজার টনেরও কম বিক্রি হবে বলে তাঁর ধারণা। গত বছর পর্যন্ত অন্তত ৩০০ জন চাষি জিনিসপত্র নিতেন। এ বার তাঁদের মধ্যে মাত্র ৮-১০ জন চাষ করছেন। তাও মাত্র দু’একটি পুকুরে।

গৌতম বলেন, “কয়েক কোটি টাকা পাই চাষিদের কাছে। কিন্তু তাঁরা এমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন, টাকা দেওয়ার ভয়ে চাষের বিভিন্ন জিনিস রাতারাতি বিক্রি করে বাড়ি ছেড়ে ভিন্‌ রাজ্যে চলে যাচ্ছেন।’’

চিংড়ি চাষের খাবার ও ওষুধের দোকানদারদের সংগঠনের সভাপতি নিমাই দাস বলেন, “হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি জুড়ে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতেন অন্তত দেড় হাজার মানুষ। প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা ছিল। মার্চ মাস থেকে চাষ শুরু হত। এ বার এখনও পর্যন্ত ২ শতাংশ পুকুর মালিক দু’চারটি পুকুরে চাষ করছেন।”

হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের বিশপুর পঞ্চায়েত এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে কৃষিজমিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ হচ্ছিল। স্থানীয় চিংড়ি চাষি প্রবীর মণ্ডল বলেন, “বিশপুর ও রূপমারি পঞ্চায়েত জুড়ে প্রায় ৫০০০ হাজার পুকুর ছিল মাছ চাষের। এ বার ৩০০ পুকুরেও চাষ হচ্ছে না।”

বিশপুরের বাসিন্দা পীযূষ পাত্রের কথায়, “আমাদের ১৫ বিঘা জমি ভেনামি চিংড়ি চাষে লিজ়ে দিই। প্রায় দু’বছর ধরে চাষ হচ্ছে না। কোনও টাকা পাচ্ছি না। ধান চাষও করতে পারছি না। খুব বিপাকে পড়েছি।” হাসনাবাদের চিংড়ি চাষি নিমাই দাস জানালেন, ৭০টি পুকুরে চিংড়ি চাষ করতেন। কিন্তু আর্থিক ক্ষতি যা হয়েছে, তাতে এ বার মাত্র ৩টি পুকুরে চাষ করছেন। পরিস্থিতি ভাল থাকলে আরও ৪টি পুকুরে চাষ করার ইচ্ছে আছে বলে জানালেন। নিমাই বলেন, ‘‘আমার কাছে আগে সরাসরি অন্তত ১০০ জন কাজ করতেন। এ বার মাত্র ১০ জন আছেন। বহু মানুষ কাজ পাচ্ছেন না চাষ না হওয়ায়। একই অবস্থার কথা জানালেন বিশপুরের চিংড়ি চাষি প্রসেনজিৎ জানা।

অন্য দিকে, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাষের জমির চরিত্র পরিবর্তন না করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। যা আইনের চোখে অপরাধ। সম্প্রতি সরকার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে, ডেসিবেল প্রতি ২০০ টাকা দিয়ে জমির মালিকেরা জমির চরিত্র বদলে নিতে পারবেন। অর্থাৎ, এক বিঘা কৃষি জমি জলাভূমিতে রূপান্তর করতে খরচ হবে ৬৬০০ টাকা। হিঙ্গলগঞ্জে ১৩২৫ একর জমিতে মাছ চাষ হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি এখনও হয়নি। হলে বিভিন্ন ভাবে জমির মালিকদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হবে। জমির চরিত্র বদল করা হলে সরকারের খাজনা আদায় হবে এই সব জমি থেকে।”

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যেখানে চাষে লাভের মুখ দেখছেন না চাষিরা, সেখানে জমির চরিত্র বদলে কতটা উৎসাহিত হবেন তাঁরা। তাতে চাষে অনুৎসাহ আরও বাড়বে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prawn agriculture Fishermen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE