Advertisement
E-Paper

প্রকল্প অনেক, তবু আর্সেনিকের দূষণ

গাইঘাটা ব্লকের গাজনা গ্রামে আমজাদের বাড়ি। বলছিলেন, ‘‘শরীরটা ভাল নেই। মাঝে মধ্যে রাতে জ্বর আসে। বাড়ির টিউবওয়েলের জল খেয়ে আর্সেনিকের কবলে পড়েছি। কিন্তু চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই।’’

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৮ ০২:০৭

বৃদ্ধ আমজাদ সর্দারের স্ত্রী সালেমা বিবি কয়েক বছর আগে আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হয়ে ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। আমজাদের শরীরেও থাবা বসিয়েছে আর্সেনিক। পেশায় খেতমজুর আমজাদ ঠিক মতো কাজকর্ম করতে পারেন না এখন।

গাইঘাটা ব্লকের গাজনা গ্রামে আমজাদের বাড়ি। বলছিলেন, ‘‘শরীরটা ভাল নেই। মাঝে মধ্যে রাতে জ্বর আসে। বাড়ির টিউবওয়েলের জল খেয়ে আর্সেনিকের কবলে পড়েছি। কিন্তু চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই।’’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় আমজাদের মতো বহু মানুষের এখন একই পরিণতি। পানীয় জলে অতিমাত্রায় আর্সেনিক জেলার ২২টি ব্লকের মানুষের কাছেই জীবন-মরণ সমস্যা। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস জানালেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক মিশ্রিত পানীয় জল খেয়ে এখানে মারা গিয়েছেন অন্তত ২১২ জন। এখনও জেলায় হাজারখানেক মানুষ নানা ভাবে অসুস্থ।’’ শুধু গাইঘাটা ব্লকেই মারা গিয়েছেন ৩১ জন। অনেকে মৃত্যুর দিন গুনছেন।

গ্রামবাসীরা জানালেন, অতীতে বাড়ির টিউবওয়েলের জল পান করে আর্সেনিক বিষ তাঁদের শরীরে প্রবেশ করেছে। এখন অবশ্য গ্রামে গ্রামে পানীয় জলের গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। ওই জলেও উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। নিয়মিত পরীক্ষা হয় না। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ওই জলই তাঁরা পান করেন। আর্সেনিক থেকে বাঁচতে অনেকে পানীয় জল কিনছেন কেউ কেউ। অশোকনগরের বিনিময় পাড়া এলাকাতেও আর্সেনিক-আক্রান্ত হয়ে অতীতে কয়েকজন মারা গিয়েছেন। অশোকবাবুর অভিযোগ, আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধে ডান-বাম কোনও সরকারই যথার্থ পদক্ষেপ করেনি। আর্সেনিক রোগীদের চিহ্নিত করে তাঁদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়নি।

কমিটির তরফে বেশ কিছু গভীর নলকূপের জল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাতে আর্সেনিকের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। পাইপ লাইনের জলেরও একই অবস্থা। কমিটির দাবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মতে, প্রতি লিটার জলে ০.০১ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে তা পান বা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায় না। এখানে আর্সেনিক মাত্রা ওই সীমা অতিক্রম করেছে।

গাইঘাটার গুটরি গ্রামের বাসিন্দা প্রৌঢ় অসীম দাসের হাতের তালু ও বুকে কালো-বাদামি রঙের ছোপ। পায়ের তলা গুটি গুটি দানায় ভরে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত আর্সেনিক চিহ্নিতকরণ শিবিরে যোগ দিয়ে মূত্র পরীক্ষা করিয়ে অসীম দাস জানতে পারেন, তাঁর শরীরে আর্সেনিক বিষ প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, ‘‘শরীরটা ভাল যায় না, দুর্বল, পেটের রোগ আছে। লিভারের সমস্যাও রয়েছে।’’

আর্সেনিক বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, জেলায় প্রচুর নদী, খাল, বিল, পকুর রয়েছে। সেই জল ধরে রেখে পানীয় জলের ব্যবস্থা করলে একদিকে যেমন আর্সেনিক সমস্যা মেটানো সম্ভব, তেমনই বন্যা প্রতিরোধও সম্ভব। কারণ, ভূপৃষ্ঠের জলে আর্সেনিকের বিষ নেই। নেই বৃষ্টির জলেও ।

বিষ-জল

• ১৯৯১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত আর্সেনিক দূষণে অসুস্থ হয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় মৃত ২১২ জন। যদিও ১৯৯৫ সালের আগে পর্যন্ত আর্সেনিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না এই জেলার মানুষ। ১৯৯৬ সালে আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি তৈরি হয়।

• জেলার ২২টি ব্লকই আর্সেনিক প্রভাবিত। আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষ আর্সেনিকে অসুস্থ।

• বারাসত জেলা হাসপাতালে আর্সেনিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক থাকলেও বাস্তবে সেখানে পরিষেবা মেলে না।

• জেলায় আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করর জন্য সরকারি উদ্যোগও নেই।

(সূত্র: আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি )

আর্সেনিক সমস্যা মেটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জেলা পরিষদ সূত্রে জানানো হয়েছে। পরিষদের দাবি, নৈহাটি থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গঙ্গার জল নিয়ে আসার কাজ চলছে। ওই জল শোধন করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। হাবড়া ২, গাইঘাটা, দেগঙ্গা ব্লক-সহ ৭টি ব্লকের মানুষ এর ফলে উপকৃত হবেন। এডিবি-র টাকায় জেলায় দু’টি প্রকল্প চলছে। ওই কাজ শেষ হলে রাজারহাট, হাড়োয়া, বাগদা, বনগাঁ পুর এলাকার মানুষ আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল পাবেন।

জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ জ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলায় ৭১টি আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে গাইঘাটাকে আর্সেনিকমুক্ত ব্লক হিসাবে ঘোষণা করা হবে। ওই ব্লকের স্কুলগুলিতে প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। ৪০৩টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে।’’

arsenic pollution Water Supply
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy