২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে যে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার সূচনা হয়েছিল বনগাঁর সভা থেকেই। সে বার রাজ্যে তৃণমূলের ভরাডুবি হলেও বনগাঁ বিধানসভা আসনে তৃণমূল জয়লাভ করে। ভোটের পরেই মারা যান বিধায়ক ভূপেন শেঠ। উপ নির্বাচনে জয়ী হন তৃণমূলেরই সৌগত রায়। উপ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃণমূল সে বার বিধানসভায় বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল।
২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে বনগাঁ কেন্দ্রটি ভেঙে বনগাঁ উত্তর এবং বনগাঁ দক্ষিণ দু’টি বিধানসভা হয়। ২০১১ সালে এবং ২০১৬ সালে বনগাঁ উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে পর পর দু’বার ভোটে জিতে বিধায়ক হন তৃণমূলের বিশ্বজিৎ দাস।
সুর কাটল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে।
শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় শাসক দলের ভোটব্যাঙ্কে ব্যাপক ধস নামে। বামেদের ভোট বিজেপিতে যাওয়া তার বড় কারণ বলে সে সময়ে দলের অন্তর্তদন্তে উঠে আসে। কিন্তু তৃণমূল নেতাদের একাংশের অনৈক্য, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং ঔদ্ধত্যও ভোট বাক্সে প্রভাব ফেলেছিলে বলে মনে করেন দলের অনেকে। স্থানীয় নেতাদের একাংশের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তৃণমূলের লোকজনও বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘সব থেকে বড় কথা হল, সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতা ছিল না। প্রকাশ্যে মানুষ তাঁদের মতামত জানাতে পারতেন না।’’ পঞ্চায়েত ভোটের গোলমালও শাসক দলের বিরুদ্ধে গিয়েছিল।
সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই দল ছাড়েন বিশ্বজিৎ। জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটর গোপাল শেঠের নেতৃত্বে দল ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই অবশ্য শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী এখানে সভা করেছেন। সভায় ভিড় হয়েছিল প্রচুর। মতুয়াদের কাছে টানতেও কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। পুরনো কর্মীদের সক্রিয় করা হচ্ছে।
তবে বিজেপিও ক্রমশ সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে এলাকায়। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা নিয়মিত এখানে জনসভা, দলীয় কর্মসূচিতে আসছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি থেকে কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছেন। বনগাঁকে আলাদা সাংগঠনিক জেলা তৈরি করা হয়েছে। তবে দলের কোন্দল ভোগাচ্ছে তাদেরও।
বাম-কংগ্রেস জোট যৌথ কর্মসূচির মাধ্যমে আসরে নেমে পড়েছে। তাদের মিছিল-মিটিংয়ে ইদানীং ভিড় জমছে ভালই। নতুন প্রজন্মকেও দেখা যাচ্ছে বামেদের কর্মসূচিতে। করোনা, আমপান পরিস্থিতিতে বামেরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনসংযোগের কাজ করেছেন। কংগ্রেসও তাদের সংগঠন নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছে।
রাজনৈতিক চাপানউতোরের মধ্যে কিছু সমস্যা এখনও ভোগাচ্ছে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের মানুষকে।
বনগাঁ শহরের প্রধান সমস্যা যানজট ও নিকাশি। বাইরে থেকে আসা ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় না বলে অভিযোগ। ঘটছে দুর্ঘটনা। নানা জটিলতায় আটকে আছে শহরে রেলসেতু তৈরি এবং যশোর রোড সম্প্রসারণের কাজ। গোপালনগর বাজারের যানজট সমস্যা নিয়েও মানুষ তিতিবিরক্ত। সড়কের জুড়ে বেআইনি পার্কিং। ইমারতি মালপত্র ফেলে রাখা হয়।
ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি। সংস্কারের অভাবে নদী নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায়। বছরের বেশিরভাগ সময়ে কচুরিপানায় ভরে থাকে। নদী জলধারণের ক্ষমতা হারানোয় ভারী বৃষ্টিতে প্রতি বছর বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েন। বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়। দাবি আছে গড়াইল এবং নাওভাঙা নদী সংস্কারের। আমপানে সরকারি ক্ষতিপূরণ বিলি নিয়ে শাসকদলের নেতাদের নাম জড়িয়েছে।
এখনও শহরে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া যায়নি।
বছর ভর শহরে বেআইনি চোঙার দাপট। অবহেলায় পড়ে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি। মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় বলে অভিযোগ। কৃষিজমি দখল করে চলছে নির্মাণ কাজ।
গত পাঁচ বছরে বিধায়কের কাজ প্রসঙ্গে বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘বনগাঁ-বারাসত যশোর রোড সম্প্রসারণ, বনগাঁকে যানজট মুক্ত করা, ইছামতী নদীর সংস্কার— এ সব সমস্যার সমাধানে বিধায়ক তেমন ছাপ রাখতে পারেননি। জনশ্রুতি আছে, বিধায়ক কাজ করতে চাইলেও তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি।’’
তবে তৃণমূল নেতা গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে বনগাঁর প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। তা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং পুরসভা। বিধায়কের কোনও ভূমিকা ছিল না। তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন।’’ পুরপ্রশাসক শঙ্কর আঢ্য জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসের মধ্যে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ইছামতী নদী সংলগ্ন এলাকা থেকে জল নিয়ে তা পরিস্রুত করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে শীঘ্রই বিনামূল্যে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।
দলবদল প্রসঙ্গে গোপাল বলেন, ‘‘তৃণমূলে কিছু উইপোকা বাসা বেঁধেছিল। তারা চলে গিয়েছে। কে চলে গেলেন, আর কে থাকলেন, তাতে তৃণমূলের কিছু যায় আসে না।’’
কী বলছেন বিধায়ক নিজে?
তাঁর কথায়, ‘‘ইছামতী নদী সংস্কারের বিষয়টি বিধানসভায় তুলেছিলাম। সেচমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম। মহকুমা হাসপাতালে ভেন্টিলেটর, শয্যা ও সংক্রামক রোগে আক্রান্ত মানুষদের জন্য অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য ৪৪ লক্ষ টাকা দিয়েছি। আলো, পানীয় জল-সহ বিভিন্ন কাজের জন্য পঞ্চায়েত সমিতিকে ৯০ লক্ষ টাকা দিয়েছি। ওরা খরচ করেনি। এ ছাড়া, রাস্তা, আলো, নালা, কালভার্ট তৈরির জন্য টাকা দিয়েছি। স্কুলের পরিকাঠামো উন্নতি করেছি।’’
দলবদল প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘লোকসভা ভোটের পরে পুরসভায় তৃণমূলের ১৪ জন কাউন্সিলর পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ তুলে অনাস্থা এনেছিলেন। বনগাঁর মানুষ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। দলকে বার বার জানিয়েও নেতৃত্ব অনাস্থার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করেননি। কাউন্সিলরেরা অনেকে বিজেপিতে যোগদান করেন। আমি তাঁদের সঙ্গে না গেলে বনগাঁর মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতাম।’’