Advertisement
০২ মে ২০২৪
Bangaon

সমিতি থেকে চড়া সুদে  টাকা নিয়ে বিপাকে বহু মানুষ

এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এলাকায় এলাকায় গজিয়ে ওঠা সমিতি বা গ্রামে গ্রামে সুদের কারবারিদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই চাপে পড়েন।

ঋণ নিয়ে বিপাকে মানুষ।

ঋণ নিয়ে বিপাকে মানুষ। প্রতীকী চিত্র।

সীমান্ত মৈত্র  
বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ০৭:৫৭
Share: Save:

বছর দু’য়েক আগের ঘটনা। হাবড়ার বাসিন্দা এক যুবকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল ঘর থেকে। চব্বিশ বছরের ওই যুবকের একটি ছোট ট্রাক ছিল। নিজেই গাড়ি চালাতেন। করোনা-পরিস্থিতিতে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সে সময়ে সুদে টাকা ধার করতে হয়েছিল। সেই টাকা শোধ করতে পারছিলেন না। পাওনাদারেরা বাড়িতে এসে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল বলে অভিযোগ। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন যুবক। পরিবারের সদস্যদের দাবি, টাকা দিতে না পারায়, মানসিক চাপে যুবক আত্মহত্যা করেন।

অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার ছিল বনগাঁর আর এক যুবকের। এলাকার একটি সমিতি থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। সমিতির লোকজন যুবকের পরিচিত ছিলেন বলে সুদের পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু সেই টাকাও শোধ করতে পারছিলেন না যুবক। শেষে বাড়ির গাছ বিক্রি করে যুবক ১৭ হাজার টাকা শোধ করেন।

এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এলাকায় এলাকায় গজিয়ে ওঠা সমিতি বা গ্রামে গ্রামে সুদের কারবারিদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই চাপে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা সুদে ঋণ কিনে মানুষকে সপ্তাহে ৩০০ টাকা করে ৪০ সপ্তাহ দিতে হয়। কোনও দু’সপ্তাহ টাকা দিতে না পারলে অতিরিক্ত এক সপ্তাহের টাকা দিতে হয়। দিনে-সপ্তাহে-মাসের হিসাবে সুদ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

বনগাঁর ভাগচাষি সাহেব আলি মণ্ডল সুদে টাকা নিয়ে চাষবাস করেছেন আগে। কেন মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়েছিলেন? সাহেবের যুক্তি, ‘‘ব্যাঙ্কঋণ পেতে কালঘাম ছুটে যায়। তা ছাড়া, দ্রুত খেতে সার বা সেচের জল দিতে হয় যখন, তখন কোথায় টাকা পাব? সুদের টাকা সময় মতো পরিশোধ করতে না পারলে চাপ দেওয়া হয় জেনেও টাকা নিয়েছিলাম। খেতমজুরি করে বা অন্য কোনও কাজ করে টাকা শোধ করতে হয়।’’ চাষিরা অনেকে জানালেন, গাছগাছালি বিক্রি করে, গয়না বিক্রি করেও ঋণের টাকা শোধ করতে হয়।

সন্ধ্যা হলেই দেখা যায়, গ্রামে কয়েকজন যুবক চেয়ার-টেবিল পেতে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে পড়েন। কোথাও কোথাও যুেবকেরা অস্থায়ী গুমটি ঘর খুলে ফেলেছেন। সেখানে চলে টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশ। কে টাকা দিয়ে গেল, কে দিনের সুদের টাকা ফেরত দিতে পারল না— সে সব তথ্য রাখা হয়।

বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় চোখে পড়ে বেআইনি এই কারবার। সাধারণ মানুষের কথায়, এগুলির পোশাকি নাম, ‘সমিতি।’ পাড়ার কিছু যুবক চালান সে সব সমিতি। সদস্যেরা নিজেরা টাকা দিয়ে একটি তহবিল গড়েন। সেখান থেকে চড়া সুদে ঋণ দেওয়া হয়। সমিতিগুলির বৈধ সরকারি নথিপত্র থাকে না বলেই অভিযোগ। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বনগাঁ শাখার ম্যানেজার দীপককুমার গায়েন বলেন, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ও সেবির অনুমতি ছাড়া আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত কাজকর্ম করা যায় না। করা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি।’’ গ্রামাঞ্চলে সুদের কারবার, মহাজনী কারবার বা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সমিতিগুলির আরবিআই বা সেবির অনুমোদন থাকে না বলেই জানালেন কয়েকটি ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা।

দীপক বলেন, ‘‘বেআইনি আর্থিক কারবারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে আমরা গ্রামে গ্রামে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট করেছি। সেখান থেকে কেউ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লেনদেন করতে পারেন।’’

বনগাঁর একটি সমিতি সূত্রে জানা গেল, কেউ ১ হাজার টাকা ঋণ নিলে, পরবর্তী ৫৫ দিনে প্রতিদিন ২০ টাকা করে শোধ করতে হয়। একদিন টাকা দিতে না পারলে পর দিন তাঁকে ৩০ টাকা দিতে হয়। দু’দিন টাকা দিতে না পারলে পর দিন ৪০ টাকা দিতে হয়। বিভিন্ন সমিতির ঋণের হার অবশ্য বিভিন্ন রকম।

অভিযোগ, সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে সমিতির সদস্যেরা ওই ব্যক্তির বাড়িতে হাজির হয়ে শাসানি দেন। বাড়ির জিনিসপত্রও তুলে আনা হয় কখনও কখনও।

বাসিন্দারা জানালেন, গ্রামের নিরক্ষর মানুষের পক্ষে সব সময়ে ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে গিয়ে টাকা জমা দেওয়া বা ঋণ নেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁরা বাড়ির কাছের সমিতির সাহায্য নেন। কাগজপত্র ছাড়া কার্যত হাতে হাতেই টাকা মেলে।

বহু মানুষ এ ভাবে সুদে টাকা খাটিয়ে মোটা টাকা আয় করেন। তাঁরা সেই টাকা সমিতিতে রাখতেও পছন্দ করেন। বনগাঁ শহরে কিছু শিক্ষিত বেকার যুবকেরাও সমিতি তৈরি করে কারবার করছেন বলে জানা গেল। চাকরি-বাকরি করেন এমন অনেকেও সমিতির মাধ্যমে সুদে টাকা খাটান বলে জানা গেল।

দীপক বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কের ঋণপ্রক্রিয়া এখন অনেক সরলীকরণ করা হয়েছে।’’ কিন্তু তারপরেও বিপদের আশঙ্কা জেনেও বহু মানুষের আশা-ভরসার জায়গা ছোট সমিতি, মহাজনেরাই।

পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বেআইনি অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ পেলেই কড়া পদক্ষেপ করা হয়। কেউ আর্থিক ভাবে প্রতারিত হলে বা কাউকে টাকা আদায়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ পেলেই পদক্ষেপ করা হয়। অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। তবে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘সুদের কারবার বা বেআইনি ভাবে টাকার লেনদেনের বিরুদ্ধে সুয়ো মোটো করা যায় না তা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মানুষ যতক্ষণ না প্রতারিত হচ্ছেন বা সুদে টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন— ততক্ষণ পুলিশের পক্ষে তা জানা সম্ভব হয় না।’’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangaon Loans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE