চিকিৎসধীন: হাসপাতালে বিডিও কৌশিক ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র
দুর্নীতি ধরে ফেলেছেন বিডিও, তা বুঝতে পেরে সন্দেশখালি ২ বিডিওর বিরুদ্ধে এলাকা থেকে শ’য়ে শ’য়ে চিঠি জমা পড়েছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলাশাসকের দফতরে। প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে শোকজ করা হয়েছিল বিডিও কৌশিক ভট্টাচার্যকেই।
যদিও পরে ‘পুকুর চুরি’ ধরতে পেরেছিল জেলা প্রশাসন। জানা যায়, বিডিওর দফতরের কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড হ্যাক করে জাল নথি তৈরি করা হয়েছিল। অভিযোগ, এ ভাবে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। থানায় ডেকে এনে কয়েকজন উপভোক্তার স্বীকারোক্তি ভিডিয়োগ্রাফি করে পুলিশ। সে সব পাঠানো হয় জেলাশাসকের কাছে। ক্রমশ সামনে আসে গোটা বিষয়।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের ওই ঘটনার পরে জেলাশাসকের অফিসে ডাকা হয় স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতাকে। সেখানে হাজির ছিলেন জেলাস্তরের শীর্ষ নেতৃত্বও। দফায় দফায় বৈঠকের পরে স্থানীয় এক নেতা প্রশাসনকে টাকা ফেরত দিতে সম্মত হন। তিন দফায় টাকা ফেরতও যায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
কিন্তু অভিযোগ, এ সবের জেরে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন কৌশিক। নানা ভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে। যে কারণে কয়েক মাস আগে তাঁর জন্য একজন সশস্ত্র দেহরক্ষীরও ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন।
যদিও বৃহস্পতিবার দুপুরে বিডিও অফিসে ঢুকে হামলার ঘটনায় কৌশিক ছাড়াও প্রহৃত হয়েছেন সেই দেহরক্ষীও। আতঙ্কিত দফতরের কর্মীরা। তাঁদের অনেককে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। কর্মীদের আটকে রেখে হামলা চলে বিডিওর ঘরে।
শুক্রবার সন্দেশখালির বেড়মজুর এলাকায় গিয়ে জানা গেল, ২০১৮-১৯ সালে এখানকার শ’তিনেক উপভোক্তা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁদের অনেকের নামে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রথম পর্যায়ের ৪৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কারও কারও অভিযোগ ছিল, টাকা তাঁরা পেয়েছেন বটে, কিন্তু বড় অংশ ‘কাটমানি’ দিতে হয়েছে স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতাকে। সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কে প্রায় সওয়া কোটি টাকার দুর্নীতি সামনে আসে। আগের কয়েক বছরেও প্রায় সম পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
পরে তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিডিওর অফিসের কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড হ্যাক করে একজনের বাড়ি অন্যজনের নামে দেখিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছিল ব্যাঙ্ক থেকে। সেই সময় থেকেই বিডিও কৌশিক তৃণমূলের একাংশের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। পরে পরে আরও নানা ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে সন্দেশখালি ২ ব্লক এলাকা থেকে। কখনও বাঁধ সারাই, রাস্তা মেরামত, কখনও গাছ কাটা, কখনও ২ টাকা কেজি দরে আয়লা এলাকায় চালের হিসেবে গরমিল সামনে আসতে থাকে। গ্রামের এক রাস্তার কাজ তিনবার দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে বলেও অভিযোগ করলেন গ্রামের অনেকে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ১০ জনকে কাজ করিয়ে মাস্টাররোলে ৫০ জনের নাম ঢুকিয়ে টাকা গায়েব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের।
এ দিন সন্দেশখালি ২ ব্লকের বিডিওর দফতর সকালে নির্ধারিত সময়ে খোলেনি। বেলা বাড়ার পরে তালা খুললেও কর্মীদের অধিকাংশই আসেননি। ২০১৭ সালে সন্দেশখালি ২ ব্লকে কাজে যোগ দেন কৌশিক। তাঁর পরিবার থাকে রায়গঞ্জে। এলাকার বাসিন্দাদের বড় অংশই নৈতিক ভাবে বিডিও পাশে দাঁড়িয়েছেন। সরাসরি মুখ খুলতে সাহস না পেলেও অনেকে জানালেন, ‘কাজের মানুষ’ হিসাবে কৌশিকের উপরে ভরসা রাখেন তাঁরা। রাতবিরেতে প্রয়োজনে বাইক নিয়ে একাই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান বিডিও। তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে, তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়ে অনেকের কাছেই এখন রীতিমতো ‘হিরো’ কৌশিক।
তবে তৃণমূল ব্লক সভাপতি শেখ সাজাহান দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, এলাকায় যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ তা জানেন। বিডিও অন্য কারও প্ররোচনায় মিথ্যা অভিযোগ করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy