Advertisement
E-Paper

বহিরাগত মুখ বসিরহাট-টাকির আনাচ-কানাচে, প্রতিবাদ রূপার

তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। টাকি পুরসভার একটি রাজনৈতিক দলের এক এজেন্টের বাড়িতে কড়া নড়ল। বয়স্ক এজেন্ট বেরিয়ে আসতেই জনা তিনেক যুবক কাকু কেমন আছেন, বলতে বলতে ঢুকে পড়ল ঘরে। তাদের গলায় কয়েক গাছি করে সোনার চেন ঝুলছে। হাতে সোনার মোটা বালা। জামার বোতাম খানকতক খোলা। ‘‘কাকু মেয়ে বাড়ি ফিরেছে?’’— ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আগন্তুকেরা। ‘ইয়ে, না, মানে’— এ সব আমতা আমতা করছিলেন ভদ্রলোক। কোমর থেকে গোঁজা রিভলবারটা বসার ঘরের টেবিলে ঠক করে রেখে বলল এক জন, ‘‘ভোট নিয়ে এত মাথা ঘামাবেন না কাকু। কী দরকার। সুখে-শান্তিতে সংসার করুন।’’

নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০২:২০
পরিস্থিতি দেখে উষ্মা গোপন রাখলেন না নেত্রী। বৃহস্পতিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

পরিস্থিতি দেখে উষ্মা গোপন রাখলেন না নেত্রী। বৃহস্পতিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। টাকি পুরসভার একটি রাজনৈতিক দলের এক এজেন্টের বাড়িতে কড়া নড়ল। বয়স্ক এজেন্ট বেরিয়ে আসতেই জনা তিনেক যুবক কাকু কেমন আছেন, বলতে বলতে ঢুকে পড়ল ঘরে। তাদের গলায় কয়েক গাছি করে সোনার চেন ঝুলছে। হাতে সোনার মোটা বালা। জামার বোতাম খানকতক খোলা। ‘‘কাকু মেয়ে বাড়ি ফিরেছে?’’— ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আগন্তুকেরা। ‘ইয়ে, না, মানে’— এ সব আমতা আমতা করছিলেন ভদ্রলোক। কোমর থেকে গোঁজা রিভলবারটা বসার ঘরের টেবিলে ঠক করে রেখে বলল এক জন, ‘‘ভোট নিয়ে এত মাথা ঘামাবেন না কাকু। কী দরকার। সুখে-শান্তিতে সংসার করুন।’’ রিভলবারের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না বৃদ্ধ। কথা আটকে গিয়েছে গলায়। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী ঢুকলেন বসার ঘরে। ঝপাং করে রিভলবারের উপরে রুমাল ফেলে দিল এক জন। ‘‘কাকিমা, একটু জল খাওয়াবেন?’’ ভদ্রমহিলা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে জল আনতে ভিতরে যেতেই তিন আগন্তুক তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, ‘‘কাকু আসি তা হলে। যা বললাম, একটু মনে রাখবেন।’’

বৃদ্ধ পরে জানালেন, যারা এসেছিল বাড়ি বয়ে, কাউকেই চেনেন না তিনি। বস্তুত, গত কয়েক দিন ধরেই এমন অসংখ্য বহিরাগত মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে বসিরহাট-টাকির আনাচ-কানাচে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিটিং-মিছিলে দেখা যাচ্ছে তাদের। অনেকের কোমরের পিছন থেকে উঁচু হয়ে থাকা জিনিসটা যে আগ্নেয়াস্ত্র, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অস্ত্র এমন ভাবে লুকানো, যেন দেখা দেওয়াই তার কাজ! অনেকের হাতে আবার পেল্লায় লাঠি। কোন কাজে লাগবে সে সব, খোদায় মালুম। কিন্তু বারমুডা পরিহিত গলায় সোনার চেন, হাতে মোটা সোনার বালা ঝুলিয়ে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যটা খুব সৎ নয়, তা মোটামুটি নিশ্চিত।

এলাকার বাসিন্দারা কেউ কেউ সাহস করে জানতে চেয়েছিলেন আগন্তুকদের ঠিকানা-পরিচয়। বিনিময়ে কেউ পেয়েছেন কড়া চোখের বার্তা। অনেক ক্ষেত্রে আমতা আমতা করতে করতে সেখান থেকে সরে গিয়েছে ‘বহিরাগত অতিথি’। বসিরহাট, টাকি-হাসনাবাদের গেস্ট হাউস, লজ, বিয়েবাড়িগুলিতে এখন যাদের ভিড় দেখা যাচ্ছে।

শোনা যাচ্ছে, ভোটে দিন এই বহিরাগত যুবকদের ‘সিভিক পুলিশ’ পরিচয়ে বুথের কাছাকাছি ‘ডিউটি’ দেওয়া হবে।

নভেম্বর মাসে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। ওই ভোটের ফলাফলে বসিরহাট পুরসভার ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টিতেই এগিয়ে বিজেপি। টাকির ক্ষেত্রেও ১৬টি আসনের মধ্যে ১৪টিতে এগিয়ে আছে বিজেপি। ফলে এই সব জায়গায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের কড়া টক্কর দিতে হবে, বলাইবাহুল্য।

নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত দিন কয়েক হল ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন বসিরহাটে। বসিরহাট ও টাকির ভোটটা এ বার শাসক দলের পক্ষে তিনিই দেখছেন। এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, নিউটাউন, রাজারহাট, হাসনাবাদের ভবাণীপুর, সন্দেশখালি থেকে বহিরাগতদের এনেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

বৃহস্পতিবার প্রচারে এসে বহিরাগত-সংক্রান্ত অভিযোগকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

শাসক দলের লোকজনই বহিরাগতদের ঢুকিয়ে সন্ত্রাসের ভোট করতে চাইছে— এই অভিযোগ তুলে তিনি এ দিন বসিরহাটের ইটিন্ডা রোডে ইছামতী সেতুর সামনে বসে পড়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন।

ওই বিক্ষোভ অবশ্য সকাল থেকেই শুরু করেছিলেন বসিরহাটের ২৩টি ওয়ার্ডের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকেরা। রূপা তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে সামিল হওয়ায় দলের মধ্যে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও ছিলেন সেখানে। মোটর বাইকে চড়ে টাকিতে প্রচার করছিলেন দুই নেতা-নেত্রী। বসিরহাটে বিক্ষোভের খবর পেয়ে তাঁরা সেখানে হাজির হন। ‘বহিরাগত হঠাও, বসিরহাট বাঁচাও’ স্লোগান লেখা ব্যানার ছিল বিক্ষোভকারীদের হাতে।

বিজেপির আন্দোলনের জেরে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ অবরোধ তুলতে গেলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে। শেষে জেলা পুলিশের সাথে কথা বলে শমীকবাবু জানান, আগামী ১২ ঘণ্টর মধ্যে বসিরহাট ও টাকির গেস্ট হাউস, হোটেল এবং লজ থেকে বহিরাগতদের বের করে না দিলে শুক্রবার তাঁরা রাজ্যপালের কাছে যাবেন। এরপরেই বেলা দেড়টা নাগাদ ইটিন্ডা রোড অবরোধ মুক্ত হয়। বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘বহিরাগতেরা যে এখানে এসেছে, এমন কোনও লিখিত অভিযোগ কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে করা হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

রূপা বলেন, ‘‘কলকাতার মতো ভোট লুঠ করতে শাসক দল রাজারহাট, নিউটাউন এলাকা থেকে লোক নিয়ে আসছে বসিরহাটে। আমরা কিছুতেই ফের ভোট লুঠ হতে দিতে পারি না।’’ রূপাদেবীর দাবি, তাঁদের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থীর মেয়ের হাত ধরে টানা হচ্ছে। রূপার কথায়, ‘‘আমরা যদি লাঠি ধরি, তা হলে বাইরের ছেলেরা পালানোর পথ পাবে না। কিন্তু আমরা তা করতে পারি না। কারণ, ওটা পুলিশের কাজ।’’ শমীকবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূল এখনে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের এনে ভোটাদের চমকে-ধমকে আতঙ্কিত করছে। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেও কাজ হচ্ছে না দেখে বহিরাগতদের নিয়ে ভোট কেন্দ্রে ছাপ্পা, রিগিংয়ের চেষ্টা করবে।’’ শমীকবাবুর কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশনের উপরে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। তাই পুলিশ বহিরাগতদের না তাড়ালে আমরা রাজ্যপালের কাছে যাব।’’

বসিরহাটের তৃণমূল নেতা দীপেন্দু বিশ্বাস অবশ্য বলেন, ‘‘বিজেপি পায়ের তলার মাটি হারিয়ে ভয় পেয়েছে। সে জন্যই বহিরাগতদের মিথ্যা তথ্য খাড়া করেছে।’’ দীপেন্দুর কথায়, ‘‘বহিরাগতরা যদি এসেই থাকে, তা হলে বিজেপি এত দিন কী করছিল? পুলিশের কাছে কেন একটাও লিখিত অভিযোগ করল না।’’

তবে শুধু বিজেপি নয়, সিপিএম বা কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও দাবি করা হচ্ছে, এলাকায় প্রচুর বাইরের মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা হলে কেউই এর আগে পুলিশের দ্বারস্থ হলেন না কেন? বসিরহাট-টাকির বাতাসে কান পাতলে শোনা যাবে, সব দলই বাইরে থেকে লোকজন এনেছে। কে আর কার বিরুদ্ধে মুখ খুলবে!

nirmal basu basirhat outsiders threat shamik bhattacharya basirhat taki poll violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy