মৃত চন্দ্রাণী ঘোষ।
ফের ওঝা-গুণিনের চক্করে পড়ে প্রাণ হারালেন সর্পদষ্টা মহিলা। সাপের ছোবলে অসুস্থ তাঁর স্বামী-ছেলেও। মেয়ের দুই বন্ধুর তৎপরতায় তিনজনকেই গুণিনের হাত থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তবে মহিলার মৃত্যু হলেও বাকি দু’জন চিকিৎসাধীন।
ক্যানিং হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সমর রায় বলেন, ‘‘সাপে কাটার প্রায় ৬ ঘণ্টা পরে রোগীদের হাসপাতালে আনা হয়েছিল। যদি সাপে কাটার দু’তিন ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনা হতো, তা হলে হয় সকলকেই বাঁচানো সম্ভব ছিল।’’
রবিবার রাতে ঘটনাটি ঘটে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির জেলিয়াখালিতে। ক্যানিং মহকুমা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সাপের ছোবলে মৃত মহিলার নাম চন্দ্রাণী ঘোষ (৫০)। সিসিইউতে ভর্তি তাঁর ছেলে সৈকত। চিকিৎসাধীন স্বামী মহাদেববাবুও।
হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পেশায় স্কুল শিক্ষক মহাদেববাবুর মেয়ে পল্লবীর জন্মদিন ছিল রবিবার। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা এসেছিলেন। অ্যাসবেস্টসের চাল, দরমার বেড়া দেওয়া বাড়িতে অনেকে মিলে কেউ খাটে, কেউ মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিলেন। মহাদেববাবু, চন্দ্রাণীদেবী ও সৈকত ছিলেন একটি বিছানায়।
অভীক ও সুদীপ্ত।
মাঝরাতে ধড়ফড় করে ঘুম ভাঙে মহাদেববাবুর। বুঝতে পারেন, কিছু একটা কামড়েছে। স্ত্রী-ছেলেকেও বলেন সে কথা। ওই দু’জনও একই রকম বোধ করছিলেন। ইতিমধ্যে ঘুম ভাঙে সৈকত-পল্লবীর বন্ধু অভীক বাইনের। তিনি থাকেন গড়িয়ায়। তিনজনকে ছটফট করতে দেখে অভীকই বাড়ির লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন।
আত্মীয়-স্বজন মিলে সকলকে নিয়ে যায় স্থানীয় এক গুণিনের কাছে। পরিস্থিতির কিছুমাত্র উন্নতি হচ্ছে না বুঝে অভীক ও তাঁদের আর এক বন্ধু সুদীপ্ত মণ্ডল বলা শুরু করেন, সকলকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। প্রথমটায় নানা মুনির নানা মত থাকা সত্ত্বেও অভীক-সুদীপ্তরা জেদ ধরেন, হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হবে সকলকে। ততক্ষণে বোঝা গিয়েছে, তিনজনকে সাপে ছোবল মেরেছে।
জেলিয়াখালি খেয়াঘাটে নৌকো না থাকায় বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়। তারপর খেয়া পেরিয়ে রামপুর বাজার থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ৩০ কিমি দূরে ক্যানিং হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল প্রায় সাড়ে ৭টা বেজে গিয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, চন্দ্রাণীদেবীকে ১০টির মতো এভিএস দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। মহাদেববাবুকে ১৫টির মতো এভিএস দেওয়ার পরে তাঁর শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। সৈকতকে ৬০টির মতো এভিএস দেওয়ার পরেও ভর্তি রাখা হয়েছে সিসিইউতে।
অভীক ও সুদীপ্ত বলেন, ‘‘কাকু-কাকিমা আর সৈকতকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে বুঝে যাই, এটা গুণিনের কাজ নয়। অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে। সকলকে এক রকম জোর করে বুঝিয়ে হাসপাতালে আনতে হয়েছে।’’
ক্যানিঙে সাপ নিয়ে কাজ করে যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা। তার সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত দুঃখের, যে মানুষ এখনও সাপে ছোবল মারলে হাসপাতালে নিয়ে আসার আগে ওঝা-গুণিনের কাছে ছোটেন। এর ফলে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে মারা যান।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, সুন্দরবনের এমন অনেক প্রত্যন্ত এলাকা আছে, যেখান থেকে সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে আনতে গেলেই ৬-৭ ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারকেও ভাবতে হবে, উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে এভিএস রাখা যায় কিনা। বিজনবাবুর আরও আফসোস, মহাদেববাবুর মতো শিক্ষক মানুষও যদি হাসপাতালে না গিয়ে গুণিনের আশ্রয় নেন, তা হলে সেটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। মহাদেববাবু অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, তাঁরাও চাননি গুণিনের কাছে যেতে। কিন্তু আশপাশের লোকজনের চাপে যেতে হয়। আর তা ছাড়া, বিপদের মুহূর্তে মাথাও কাজ করছিল না তাঁর।
এ বিষয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসীম দাস মালাকার বলেন, ‘‘উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে এভিএস রাখার কোনও সরকারি নির্দেশিকা নেই। তা ছাড়া, এভিএস প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু পদ্ধতি আছে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসক ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা তা প্রয়োগ করতে পারেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy