Advertisement
E-Paper

অসুখে গোবরডাঙার ভরসা হাবরা-বারাসত

গোবরডাঙা হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে গেল। শহরের একমাত্র সরকারি হাসপাতালে আর নেওয়া হচ্ছে না রোগীদের। যে কোনও শহরে এমন হলে বিক্ষোভ-অবরোধে হইচই পড়ে যেত। গোবরডাঙার মানুষদের কিন্তু হেলদোল নেই। কেন? গৈপুর এলাকার বাসিন্দা সুখরঞ্জন হালদার বললেন, “ও তো নামেই হাসপাতাল। অমন হাসপাতাল না থাকাই ভালো।”

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:২৭
গোবরডাঙা হাসপাতাল।

গোবরডাঙা হাসপাতাল।

গোবরডাঙা হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে গেল। শহরের একমাত্র সরকারি হাসপাতালে আর নেওয়া হচ্ছে না রোগীদের।

যে কোনও শহরে এমন হলে বিক্ষোভ-অবরোধে হইচই পড়ে যেত। গোবরডাঙার মানুষদের কিন্তু হেলদোল নেই। কেন? গৈপুর এলাকার বাসিন্দা সুখরঞ্জন হালদার বললেন, “ও তো নামেই হাসপাতাল। অমন হাসপাতাল না থাকাই ভালো।”

বছর চোদ্দ আগে তৈরি গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে প্রায় কোনও চিকিত্‌সাই পাওয়া যায় না, জানালেন শহরবাসী। অপারেশন থিয়েটার থাকলেও কোনও অস্ত্রোপচার হয় না। আলট্রা-সোনোগ্রাফি, ইসিজি, এমন কী এক্স-রে পর্যন্ত হয় না। তাই জেলা পরিষদের নির্দেশে ৩ নভেম্বর থেকে রোগী বন্ধ হয়ে গেলেও, তা নিয়ে কেউ বিচলিত নন। রোগী নিয়ে ১৪ কিলোমিটার দূরের হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, বা ৩৮ কিলোমিটার দূরে বারাসত জেলা হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে গোবরডাঙার মানুষ অভ্যস্ত।

গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতালটি জেলা পরিষদ পরিচালিত। রাজ্যের অন্য সরকারি হাসপাতালগুলিতে যে ধরনের চিকিত্‌সা পরিষেবা পাওয়া যায়, এখানে তা মেলে না। বেহাল চিকিত্‌সা পরিষেবার উন্নতির জন্য হাসপাতালটি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন। বিক্ষোভ, অবরোধ, স্মারকলিপি কোনও কিছু করতেই তাঁরা বাকি রাখেননি। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই ভেবেছিলেন এবার হয়তো হাসপাতালটির দায়িত্ব নেবে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য গোবরডাঙায় এক অনুষ্ঠানে এসে প্রকাশ্যে ঘোষণাও করে গিয়েছিলেন যে, তাঁরা হাসপাতালটি নিজেদের হাতে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতিই সার। কাজের কাজ হয়নি।

গোবরডাঙা শহরের প্রায় ৪৬ হাজার মানুষের চিকিত্‌সা পরিষেবার এক মাত্র ভরসা ওই হাসপাতাল। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটা নাগাদ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, বহির্বিভাগে চিকিত্‌সক রয়েছেন। কিন্তু রোগী নেই। শয্যা সংখ্যা মোট ত্রিশ, কিন্তু রোগী নেই একজনও। মেডিক্যাল ডিরেক্টর জর্জ অগাস্টিন বলেন, “জেলা পরিষদের নির্দেশে ৩ নভেম্বর থেকে হাসপাতালের রোগী ভর্তি বন্ধ। এখন প্রতি দিন সকাল ন’টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগী দেখা হচ্ছে।” তবে বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিকেল তিনটের পর চিকিত্‌সকদের পাওয়া যায় না। এখন বহির্বিভাগে গড়ে দৈনিক ১৩০ জন রোগী আসেন।

রোগী নেই। শূন্য ওয়ার্ড।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অগস্ট মাসে এক্স-রে টেকনিশিয়ান চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। তার পর থেকেই এক্স রে বন্ধ। হাসপাতালের হাসপাতালে এখন কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিত্‌সক নেই। যে পাঁচ জন রয়েছেন, তার মধ্যে দু’জন আবার চুক্তি ভিত্তিক। জিডিএ (জেনারেল ডিউটি অ্যাটেন্ডেট) রয়েছেন দশ জন, সাফাই কর্মী চার জন, নিরাপত্তা কর্মী চার জন, স্টোরকিপার এক জন, ল্যাব টেকনিশিয়ান এক জন ও ফার্মাসিস্ট এক জন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক দিন আগে পর্যন্তও এখানে পাঁচ জন নার্স ছিলেন। তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতর দু’জনকে এখান থেকে অন্যত্র বদলি করে দিয়েছে। যা নিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারণ তিন জন নার্সকে নিয়ে ২৪ ঘন্টা হাসপাতাল চালানো সম্ভব নয় বলে তাঁদের কি বলছে জেলা পরিষদ? জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা মণ্ডল বলেন, “ওই হাসপাতালে চিকিত্‌সক-সহ অন্য কর্মী নিয়োগ করার মতো ফান্ড আমাদের নেই। জেলাপরিষদের সভায় বৈঠক করে হাসপাতালটির দায়িত্ব স্বাস্থ্য দফতরকে নিতে বলে আবেদন করা হয়েছে।”

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় কুমার আচার্য জানিয়েছেন, “হাসপাতালটির সমস্যা কী ভাবে মিটবে, তা জেলা পরিষদের বিষয়। আমাদের কাছে ওরা আবেদন করেছে হাসপাতালটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। আমরা ওই আবেদন স্বাস্থ্য ভবনে পাঠিয়ে দিয়েছি।” গোবরডাঙা পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূলের সুভাষ দত্ত হতাশ। তিনি বলেন, “রাজ্যে আর কোথাও জেলা পরিষদ পরিচালিত হাসপাতাল নেই। পুরসভা ও জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে যৌথ ভাবে হাসপাতালটির দায়িত্ব নিতে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আবেদন করেছি।”


বন্ধ অপারেশন থিয়েটার।

অন্যত্র রোগী নিয়ে যাওয়ার উপায় কী? পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, মানুষের সুবিধার কথা ভেবে চারটি অ্যাম্বুল্যান্স চালু করা হয়েছে। পুরসভার অ্যাম্বুল্যন্সের ভাড়া হাবরা পর্যন্ত ৪০০ টাকা, বারাসত পর্যন্ত ৮০০ টাকা। গরিবদের জন্য ছাড়ের ব্যবস্থা নেই। পুর এলাকার মোট ১৪ হাজার পরিবারের মধ্যে পাঁচ হাজার দারিদ্র্যসীমার নীচে। সুভাষবাবু বলেন, “বিনামূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা দেওয়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতি আমাদের নেই।” মহাদেব দাস নামে এলাকার এক বাসিন্দা জানালেন, “হাসপাতালে রোগী নিয়ে এলেই অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। হাবরা বা বারাসতে রোগী নিয়ে যেতে ধার দেনা করে অ্যাম্বুল্যান্সের টাকা জোগাড় করতে হয়। তবে ফোন করলেই অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া যায়।” অনেকে ট্রেনে করে রোগী নিয়ে হাবরা বা বারাসতে যান। হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মী অঞ্জন তরফদারের সন্তানের রাতে শ্বাসকষ্ট হয়। তাঁকেও বাইরে থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করতে হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় হাসপাতালের হাল।

এলাকায় দুটি নার্সিংহোম রয়েছে। সেখানে সিজার ছাড়া বিশেষ কিছু হয় না। তার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য যোজনা প্রকল্পে এলাকায় চারটি (হায়দাদপুরে, বাদে খাঁটুরা, হিন্দু কলেজের কাছে ও জমিদার বাড়ির কাছে) উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। সপ্তাহে সেখানে পাঁচ দিন মূলত প্রসূতি ও শিশুদের টিকাকরণ হয়। বিকেলের পর ভরসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিত্‌সক, হাতুড়ে বা হোমিওপ্যাথি চিকিত্‌সক।

সুভাষ বাবু বললেন, “পুরসভার পক্ষ থেকে কোনও হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। আমাদের ছোট পুরসভার পক্ষে এত টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়। এলাকায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শিশু হাসপাতাল রয়েছে। তার অবস্থাও ভাল নয়।” সব মিলিয়ে নিজেদের সুস্থ রাখার ভার ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন এখানকার মানুষ। (চলবে)

ছবি: নির্মাল্য প্রমাণিক।

gobardanga habra-barasat simanta moitra medical facilities southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy