Advertisement
E-Paper

আর্সেনিকের দূষণে জেরবার মানুষ

কেমন আছেন? প্রশ্ন শুনেই তিরিক্ষি হয়ে ওঠেন গ্রামের মানুষ। এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানীয় জল মেলে না যেখানে, সেখানকার মানুষের ভাল-মন্দ নিয়ে খোঁজ নিতে গেলে তাঁদের বিরক্তি উত্‌পাদন অস্বাভাবিকও নয়! বসিরহাট শহর ও লাগোয়া বহু এলাকায় আর্সেনিকের দূষণ নিয়ে বহু ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে।

নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৫
আঁধানিতে অকেজো আর্সেনিক-মুক্ত জলপ্রকল্পের মেশিন।—নিজস্ব চিত্র।

আঁধানিতে অকেজো আর্সেনিক-মুক্ত জলপ্রকল্পের মেশিন।—নিজস্ব চিত্র।

কেমন আছেন? প্রশ্ন শুনেই তিরিক্ষি হয়ে ওঠেন গ্রামের মানুষ। এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানীয় জল মেলে না যেখানে, সেখানকার মানুষের ভাল-মন্দ নিয়ে খোঁজ নিতে গেলে তাঁদের বিরক্তি উত্‌পাদন অস্বাভাবিকও নয়!

বসিরহাট শহর ও লাগোয়া বহু এলাকায় আর্সেনিকের দূষণ নিয়ে বহু ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। প্রতিবারই পুরভোটের আগে এই সব বিষয়ে মুখর হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ বারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কিন্তু ভোট মিটলে অবস্থার হেরফের হয় না, এটাই এখানকার মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

বসিরহাট শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদী। যা উপরের সেতু পেরোলেই সংগ্রামপুর-শিবহাটি, একেবারেই শহর-লাগোয়া এলাকা। সেখানকার অধিকাংশ এলাকার জলে ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের দূষণ। ইতিমধ্যে কয়েকশো মানুষ শরীরে আর্সেনিকের চিহ্ন বহন করে বেড়াচ্ছেন। গত তেরো বছরে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে আর্সেনিকের বিষে। সারা গায়ে ঘা নিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী অনেকেই। তবুও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে বিষ-জলই পান করতে বাধ্য হন এখানকার হাজার হাজার মানুষ। ২০০৬ সালে শিবহাটি স্লুইস গেটের পাশে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আর্সেনিক রিমুভ্যাল প্ল্যান্টের শিলান্যাস করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই কাজ আর বিশেষ এগোয়নি।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আর্সেনিকের পরিমাণ বহু এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত। যারমধ্যে আছে বসিরহাটের নলকোড়া, শিবহাটি, মেরুদণ্ডী, আঁধানি, সংগ্রামপুর, কামারডাঙা, বিরামনগর, অমরকাটি এবং চৌরাচর, এলাকার জলে আর্সেনিকের পরিমাণ অনেকটাই বেশি। যাদবপুর এসআইওএস, ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটি এবং শিবপুর বিই কলেজ ওই এলাকায় পরীক্ষা করে দেখেছে, ৯৯ শতাংশ নলকূপের জল তীব্র মাত্রায় আর্সেনিক আছে। বিভিন্ন সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে নানা ধরনের কল পোঁতা হলেও সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাসিন্দাদের দাবি, পুকুর কিংবা খালে বৃষ্টির জল ধরে রাখলে হয়। কিন্তু সে সব করবে কে?

পিঠে-হাতে মারাত্মক আর্সেনিকের ঘা দেখিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য তথা তৃণমূল ব্লক সভাপতি শচীন পাত্র জানালেন, দীর্ঘদিন থেকে এখানকার মানুষ তীব্র আর্সেনিকের বিষে কষ্ট পাচ্ছেন। বিভিন্ন সংগঠন এসে কতই না কলের ব্যবস্থা করলেন। ওষুধ দিলেন। কিন্তু আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল মিলল না। কামারডাঙায় তো শুধু আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের পাইপ পুঁতেই কাজ শেষ হয়েছে। শরত্‌খালে জল জমিয়ে রাখার প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। সংগ্রামপুর থেকে কয়েকটি স্ট্যান্ড পোস্টের মাধ্যমে জল দেওয়া হলেও তা খাওয়ার অযোগ্য। ১০ লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে তৈরি আঁধানি প্রাথমিক স্কুলের মাঠে আর্সেনিক রিমুভ্যাল প্ল্যান্টটি বর্তমানে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। এক হাজারেরও বেশি টিউবয়েল বসানো হলেও তার এখন কোনও অস্তিত্ব নেই।

চম্পা বিশ্বাস বলেন, “আর্সেনিক দূষণ থেকে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। হয় তো কোনও দিন এসে শুনবেন, আমিও আর নেই। বাইরের অনেকে এখানে বিয়ে-থা দিতে চান না।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, একমাত্র খালে কিংবা পুকুরে বৃষ্টির জল ধরে রাখলে সমস্যার সুরাহা হতে পারে। নদীর জল পরিস্রুত করলেও আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা হতে পারে। মেরুদণ্ডীতে শরত্‌খালের পাশে ২৬ বিঘা জমি নিয়ে বাধাখাল নামে একটি অগভীর জলাধার আছে। সেখানে বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা পরিস্রুত করে দীর্ঘ মেয়াদী আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল এলাকার মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা যেতে পারে।

এলাকার কলগুলির ফিল্টার বদলানোর দায়িত্বে থাকা কোম্পানির কর্মী মুক্তার আলি এবং ইয়ার আলির বক্তব্য, “দীর্ঘদিন কলগুলি শোধন না করায় এবং ফিল্টার চুরি কিংবা খারাপ হওয়ার জন্য অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তবে বেশিরভাগ কল ভেঙে ফেলা হয়েছে।”

গ্রামবাসীরা জানান, কাজে না লাগায় শিবহাটি হাইস্কুলের সামনে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ট্যাঙ্ক সিস্টেম পানীয় জলের কলটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে কলগুলি শিশুদের খেলার সরঞ্জামে পরিণত হয়েছে। আধানি স্কুল মাঠে বর্ডার ডেভলেপমেন্টের টাকায় তৈরি জলপ্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। মেরুদণ্ডীতে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের পরিস্রুত পানীয় জলের কল খারাপ। গত ৮ বছর আগে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে শিবহাটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভিতরে তৈরি করা হয়েছিল সজলধারা আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের প্রকল্প। বর্তমানে সেটিও খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। ওই হাসপাতালের চিকিত্‌সক মনোজকুমার মুরারি বলেন, “এখানকার জলে মারাত্মক মাত্রায় আর্সেনিক থাকায় আমরা সকলে বাইরে থেকে জল কিনে খাই।”

জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের বসিরহাটের সহকারী বাস্তুকার জয়দেব মণ্ডল জানান, আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের জন্য ইছামতীর দু’পাড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩৩টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে গেলেও কোথাও জমিজট, কোথাও বিদ্যুতের অভাবে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারছে না।”

রাজনীতির কারবারিরা যে যার উপরে দায় চাপিয়েছেন। প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন দেদার।

বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পুর ও আশপাশের এলাকায় বহু কল পোঁতা হয়েছে। কিন্তু আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়নি। আমরা ক্ষমতায় এলে আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে আমাদের প্রথম দায়িত্ব।”

সিপিএম নেতা নিরঞ্জন সাহার বক্তব্য, “ইছামতীর দু’পাড়ের মানুষের কথা ভেবেই আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের একাধিক প্রকল্প করা হয়েছিল বাম আমলে। মানুষ যদি ফের ক্ষমতায় আনেন, ইছামতীর জল পরিস্রুত করে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হবে।”

কংগ্রেস নেতা অমিত মজুমদার বলেন, “বাম আমলে বসিরহাটের মানুষের জন্য পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা যে হয়নি, তার প্রমাণ, এখনও লোকে পানীয় জল কিনে খাচ্ছেন। ক্ষমতায় এলে এই কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।”

তৃণমূল নেতা দীপেন্দু বিশ্বাসের বক্তব্য, “বাম-কংগ্রেস কেউই কথ রাখেনি। নদীর দু’পাড়ের মানুষকেই আর্সেনিক-যুক্ত জল খেতে হচ্ছে। মানুষ যাতে পরিস্রুত জল পান, সে জন্য ইতিমধ্যেই ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এলে প্রথম কাজ হবে পরিস্রুত জলের ব্যবস্থা করা।”

তবে সাধারণ মানুষের একটাই কথা, আশ্বাস ঢের হয়েছে। এ বার কিছু কাজের কাজ হোক।

arsenic pollution basirhat nirmal basu amar shohor southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy