Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দমবন্ধ যশোহর রোড, হাতে সময় নিয়ে বেরোনই দস্তুর

ঝাঁ চকচকে রাতের ত্রিকোণ পার্ক। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

ঝাঁ চকচকে রাতের ত্রিকোণ পার্ক। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৩১
Share: Save:

ইছামতীর মজে যাওয়া যদি হয় শহরবাসীর অভিমানের জায়গা, যানজট তা হলে তাঁদের নিত্য শিরোঃপীড়ার কারণ।

বনগাঁ শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক। সংকীর্ণ ওই রাস্তায় ফুটপাথ বলে কিছু নেই। সবটাই দখল হয়ে গিয়েছে। শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোল। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রয়োজনে রোজই দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে পণ্য-ভর্তি ট্রাক এই শহরে ঢোকে। এমনিতেই জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির ফলে যানবাহনের সংখ্যা দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে যানজট, যা শহরবাসীর কাছে রীতিমতো বিড়ম্বনার। দুর্ঘটনাও ঘটে আকছার।

যশোহর রোডে যানজটের কারণ কী? শহরের মধ্যে রাস্তাটি অপরিসর। তা ছাড়া, অনুমোদনহীন ভ্যানের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার ভ্যান শহরে চলাচল করে। গ্রামীণ এলাকা থেকেও প্রচুর ভ্যান ঢুকে পড়ে শহরে। বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে এখানে এসে ভ্যান ভাড়া নিয়ে ভাড়া খেটে সন্ধ্যায় ফিরে যান অনেকে। যত্রতত্র রাস্তার উপরে ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে।

শহরের মধ্যে কোনও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাস না থাকায় রাস্তার ধারে যত্রতত্র গাড়িঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকে। মতিগঞ্জ, টাউনহল এলাকা, বনগাঁ মহকুমা আদালতের পাশে, থানার সামনে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকে বাস। নিউ মার্কেট এলাকায় সড়কের গা ঘেঁষেই রয়েছে বাস টার্মিনাস। বাটার মোড় এলাকায় যাত্রী তোলার জন্য বাস দীর্ঘ ক্ষণ রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের মধ্যে সড়কের পাশে কয়েকটি পেট্রল পাম্প রয়েছে। সেখানে তেল নিতে ঢোকে গাড়িগুলি। তার জেরেও যানজট হয়ে যায়।

এ ছাড়াও, বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙের ছাতার মতো শহর জুড়ে রাস্তার উপরে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য অটো স্ট্যান্ড। জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ সংস্থার সরকারি সদস্য গোপাল শেঠ বলেন, “আমরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে বনগাঁ শহরে নতুন করে কোনও অটোর পারমিট দিইনি। যে সব বেআইনি অটো চলছে, তা তুলে দিয়ে অটোচালকদের নতুন আইনি অটো দেওয়া হবে।”

শহরের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সেতু, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রায়ব্রিজের উপরে অস্থায়ী ফল-সহ নানা পসরা সাজিয়ে বসেন হকারেরা। বিএস ক্যাম্পের মোড়ের কাছে বনগাঁ-চাকদহ সড়ক জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি ট্রাক। পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে এ সব কিছু ঘটলেও চোখ বুজে থাকাটা তাঁরা দস্তুর করে ফেলেছেন। বিষয়টা গা-সওয়া হয়ে উঠেছে শহরবাসীর কাছেও। হাতে সময় নিয়ে বেরোতে গত কয়েক বছরে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন সকলে।

বনগাঁ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ ঘোষ বলেন, “শহরের মধ্যে যশোহর রোডে দিনের বেলায় যানজটের জেরে স্কুল পড়ুয়া থেকে সরকারি কর্মীদের কাজের জায়গায় পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। অনেকে ট্রেন মিস করেন। যশোহর রোড চওড়া না করলে উপায় নেই। সরকারি খাতায় যশোহর রোড যতটা চওড়া, সেই আকারেই ফেরাতে হবে রাস্তাকে। অনেকটা অংশ জবরদখল হয়ে আছে। শিক্ষক অজয় মজুমদার জানিয়েছেন গত দশ বছরে যানজট সমস্যা খুবই বেড়ে গিয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা ঠিকঠাক করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। তবে সাহিত্যিক দেবাশিস রায়চৌধুরী মনে করেন, শহরে একটি উড়ালপুল তৈরি করে তার সঙ্গে বিভিন্ন রাস্তার সংযোগ থাকলে যানজট সমস্যা মিটতে পারে।

দিনের বেলা এই হাঁসফাঁসে দশা হয় যশোহর রোডে।

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, যানজট সমস্যা মেটাতে সম্প্রতি বনগাঁ-চাকদহ সড়কের সঙ্গে যশোহর রোডকে রাখালদাস সেতুর কাছে যুক্ত করে দেওয়ার প্রকল্প শুরু করা হয়েছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনগাঁয় এসে একটি উড়ালপুল তৈরির জন্য ১০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে গিয়েছেন। পুরসভার পক্ষ থেকে অনুমতিহীন ভ্যানের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। আর্থিক জরিমানাও করা হয়। তা সত্ত্বেও ভ্যানের দাপট কমানো যায়নি। পুরসভার পক্ষ থেকে বাইরের রাজ্য থেকে আসা পণ্য-ভর্তি ট্রাক শহরে চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পুরসভার চেয়ারম্যান জ্যোত্‌স্না আঢ্য বলেন, “শহরের যানজট সমস্যা মেটাতে বিভিন্ন রাস্তায় পুরসভার পক্ষ থেকে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৫৫ জন ট্র্যাফিক কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। শহরের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাক দিনের বেলায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। রাতে চলাচল করে।” কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড তৈরির বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “শহরের মধ্যে ওই প্রকল্পের জন্য কোনও জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যশোহর রোড চওড়া করতে চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।” যানজট নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-প্রশাসনকেও আরও সক্রিয় হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। চাপাবেড়িয়া এলাকায় পূর্ত দফতরের একটি জায়গায় কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড তৈরির দাবিতে এক সময়ে এলাকার মানুষ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পুরসভাও ওই জায়গায় তা করতে রাজি ছিল। এমনকী, পুরসভার পক্ষ থেকে ওই জায়গার বদলে পাশেই পুরসভার অন্য একটি জমিও দিতে চেয়েছিল পূর্ত দফতরকে। তা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় ওই প্রকল্প থেকে পুরসভাকে সরে আসতে হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাসস্ট্যান্ড নয়, ওখানে মোটেল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যা শুনে হতাশ সাধারণ মানুষ। জ্যোত্‌স্নাদেবী জানিয়েছেন, “চেষ্টা করছি, বাসস্ট্যান্ড তৈরি করবই।”

যানজট নিয়ে ভোগান্তি হলেও ১৯৫৪ সালে তৈরি পুরসভা উন্নতির পথে অনেকটাই এগিয়েছে। গ্রামীণ পরিবেশ বদলে ফেলে বনগাঁ ইদানীং বেশ ঝাঁ চকচকে। এখানে প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন কালীপদ ঘোষ। তিনি অবশ্য সরকার মনোনীত ছিলেন। প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন কংগ্রেসের কালীপদ ভৌমিক।

২০১০ সালের পর থেকে শহরে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়েছে। ইছামতীর তীরে খয়রামারি এলাকায় শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসেছে। স্বাধীনতার আগে তৈরি হয়েছিল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ললিতমোহন বাণীভবন। জনৈক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দানের জমিতে সেটি তৈরি হয়। জরাজীর্ণ সেই ভবন ভেঙে বর্তমান পুরবোর্ড সেখানে কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্যে তৈরি করছে আধুনিক অডিটোরিয়াম। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘পথের পাঁচালী ললিতমোহন সাংস্কৃতিক মঞ্চ’। শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বনগাঁ-চাকদহ সড়কের উপরে তৈরি ‘মনীষাঙ্গণ’ পার্ক। জীর্ণ প্রশাসনিক ভবনের বদলে আধুনিক চেহারার নতুন পুরভবনের শীঘ্রই উদ্বোধন হবে। পুরসভা তৈরি করেছে ‘স্বাস্থ্যদ্বীপ’। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিত্‌সকেরা ন্যূনতম খরচে রোগী দেখেন। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয় বাজার দরের থেকে অনেক কম টাকায়। গরিব মানুষের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের দুঃস্থ ও মেধাবী পড়ুয়াদের (নবম-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) বিনামূল্যে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে পড়ানোর জন্য পুরসভার পক্ষ থেকে চালু করা হয়েছে ‘অবৈতনিক শিক্ষা সহায়তা কেন্দ্র’। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঢালাই রাস্তা, শিশু উদ্যান, ভেপার ও হ্যালোজেন আলো বসানো হয়েছে। রাস্তায় আধুনিক আলো বসেছে। বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের জন্য ২৫ কিলোমিটার পাইপ লাইন সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সুকান্তপল্লিতে তৈরি হচ্ছে ১০ লক্ষ লিটার জল ধরার ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়াটার রির্জাভার। আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বসানো হয়েছে ডিপ টিউবয়েল। স্থানীয় বিএস ক্যাম্পের মোড়ে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি মাতৃভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে স্মারক তৈরি করা হয়েছে।

উন্নয়নের কথা স্বীকার করলেও পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলর পার্থ সাহা বলেন, “গ্রামীণ এলাকা-সংলগ্ন ওয়ার্ডগুলিতে রাস্তা, পানীয় জল, আলো, নিকাশির ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল।” এলাকার মানুষের আরও বক্তব্য, পরিকল্পিত নিকাশি ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। নালাগুলিও নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। বিভিন্ন ওয়ার্ডে বেশ কিছু রাস্তা এখনও বেহাল।

চিরুণী ছাড়া তেমন কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি বনগাঁয়। ফলে কর্মসংস্থানের জন্য বহু মানুষকে প্রতিদিন শহরে ছুটতে হয়। অনেকে আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাচার, চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়েন। পাচারের হাত ধরেই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। চুরি-ছিনতাই-কেপমারির মতো ঘটনা আকছার ঘটে। এলাকার প্রবীণ মানুষেরা জানালেন, অতীতে লবঙ্গ, ইলিশ মাছ, মশারি, ভিসিপি চোরাচালান হত। এখন গরু, কাফ সিরাফ, ধুর (মানুষ), সোনার বিস্কুট পাচার হচ্ছে। অতীতে যারা ওই সব অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তারা এলাকার শিক্ষিত যুবকদের কাজে ঢুকতে দিত না। কিন্তু ইদানীং শুনছি বহু শিক্ষিত বেকারও চোরাচালানের মতো অসামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

(চলবে)

কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বনগাঁ’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। www.facebook.com/anadabazar.abp

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bongaon jessore road simanta moitra southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE