শিক্ষক ও পড়ুয়াদের সমাবেশে জমে উঠল অনুষ্ঠান। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
ক্লাসে ক্লাসে মনীষীদের ছবি। ঝুলছে বড় মানচিত্র। খুদে ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবি, দেওয়াল পত্রিকা, বাতিল উপকরণ দিয়ে তৈরি শিক্ষার নানা সরঞ্জাম। সে সব নিয়েই স্বরূপনগর ও স্বরূপনগর উত্তর চক্রে শুরু হয়েছে ‘শিশু সাংস্কৃতিক মেলা।’ উদ্যোক্তা ওই দুই চক্রের ১৪৪টি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁদের নিমন্ত্রণে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, বোলপুর, দার্জিলিং থেকেও এসেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
মেলায় শিশুদের হাতের কাজ ছাড়াও আছে নানা রকম প্রদর্শনী, মুক্তমঞ্চে দিনভর চলছে গান, কবিতা, নৃত্যনাট্যের আসর। ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের ভিড়ে মেলা জমজমাট।
স্কুল শিক্ষকদের উদাসীনতা, অবহেলার নানা অভিযোগে রাজ্যের শিক্ষাচিত্র যখন ধূসর, তখন স্বরূপনগরের এই মেলা যেন এক ঝলক আলো। যাঁদের উদ্যোগে এত আয়োজন, সেই শিক্ষকরা জানালেন, তাঁদের প্রেরণা তপন প্রামাণিক। আশেপাশের লোক যাঁকে বলেন, ‘পাগলা মাস্টার।’ ২০০৪ সালে স্বরূপনগরের কাহারপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে আসেন তপনবাবু। তখন স্কুল বলতে স্যঁতস্যাঁতে অন্ধকার দুটো ক্লাস ঘর। ভাঙা বেঞ্চ, নির্জলা শৌচাগার। শুরু হয় ভোলবদল করার লড়াই। সঙ্গী হ’ন অন্য শিক্ষকরাও। কেবল মন দিয়ে লেখাপড়া করানোই নয়, নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে তৈরি করা হল শিক্ষার নানা উপকরণ। ক্রমশ তৈরি হল ঝাঁ চকচকে শৌচাগার, স্কুলের নিজস্ব লাইব্রেরি, কাউন্সেলিং রুম, পরিবেশ ঘর, বিজ্ঞান ঘর। স্কুল থেকেই ছাত্রদের মেলে রঙ-তুলি,বই-খাতা, পেনসিল-রাবার। সব শিক্ষক সিদ্ধান্ত নেন, কোনও অবস্থাতেই শাস্তি দেওয়া হবে না ছাত্রদের। ভুল করলে কাউন্সেলিং করা হবে।
কিন্তু স্কুলের নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এতো সব হয় নাকি? অগত্যা শিক্ষকরা ছুটির দিনেও স্কুলে আসতে লাগলেন। নাটক, গান, ছবি আঁকা, নাচের তালিম চলে স্কুলে। শিশুরা নানা বাতিল জিনিস দিয়ে নতুন জিনিস বানাতে শেখে। ক্রমশ বদলে গিয়েছে কাহারপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। তপনবাবুদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে গোকুলপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, শাঁড়াপুল হাটখোলা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, মেদিয়া ছাত্রকল্যাণ বিদ্যাপীঠ,বাংলানী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়-সহ নানা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ‘নতুন স্কুল’ গড়া শুরু করেন। স্কুলে স্কুলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক শেখার ক্লাস, গান, কবিতা, ছবি আঁকা শুরু করান। শিশুদের লেখা-আঁকা নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ, শিশুদের আঁকা ছবি এবং শিক্ষার উপকরণ নিয়ে প্রদর্শনীও শুরু হয়। অচিরেই হাতে কলমে তৈরির ঝোঁক পেয়ে বসতে লাগে কচিকাঁচাদের। অভিভাবকরাও উৎসাহিত হন। কর্মশালা করে কোন স্কুলের ছেলমেয়েরা নতুন কিছু করে দেখাতে পারে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এর ফলে শিশুদের স্কুলে আসার প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি স্কুলকে বাড়ির মতোই দেখতে শুরু করেছে শিশুরা। আবর্জনা সরিয়ে ক্লাসঘর-সহ আশপাশের উন্নতি ঘটতে থাকে।
এই উদ্যোগের শরিক প্রতীচী ট্রস্টের অধিকর্তা কুমার রানা। তিনি বলেন, “ওঁই শিক্ষকদের দেখে মনে হত, যেন একটা যুদ্ধ শুরু করছেন। এবং তা জিতেই ছাড়বেন। ওঁদের সঙ্গী না হয়ে পারা গেল না।” তিনি জানান, অল্প কয়েকজনকে নিয়ে শুরু হলেও এখন এই উদ্যোগে দুশো-র বেশি শিক্ষক সামিল হয়েছেন। নিঃশব্দ পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজ্যের অন্যান্য এলাকার শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
‘শিশু সাংস্কৃতিক মেলা’ ঘুরে দেখে দক্ষিণ দিনাজপুরের মনোজ বিশ্বাস, বাঁকুড়ার অশোক মুখোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ প্রত্যূষ সরকার, হিঙ্গলগঞ্জ থেকে আসা সীমান্ত গুহঠাকুরতা প্রমুখ শিক্ষকেরা বলেন, “কেবল স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ‘আমার কী করার আছে’ বললে হবে না। আমি নতুন কিছু করতে পারি। কতটা করতে পারি, তা দেখিয়ে দিয়ে তপনবাবুরা অবাক করেছেন।”
শিক্ষকদের উদ্যোগ প্রশাসনের কাছেও মর্যাদা পেয়েছে। এদিনের মেলায় উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক বীনা মণ্ডল, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মিনতি বিশ্বাস, এবং শিক্ষা দফতরের নানা আধিকারিক। জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্ষদের সভাপতি সম্রাট চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমি অভিভূত।” মেলার পরিসর আরও বড় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
যাঁর প্রেরণায় এত কিছু, সেই তপনবাবু কী বলছেন? তাঁর কথায়, “কেবল প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিশেষ উন্নতি সম্ভব নয় বলে মনে হয়েছিল। তাই নতুন পথের সন্ধানে এগিয়েছিলাম। এই ভেবে ভাল লাগছে যে, আমরা আর একা নই। অনেকেই যুক্ত হয়েছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy