Advertisement
E-Paper

নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে শুনলে ভিরমি খান রোগী

গঙ্গাসাগর মেলার কয়েকটা দিন বুকে বল-ভরসা পান সাগর ব্লকের মানুষ। প্রাণভরে বাঁচেন কয়েকটা দিন। দুশ্চিন্তামুক্ত রাত কাটে। ঘরে অসুস্থ রোগী থাকলে তাঁদের তো সারা বছর হাজারটা চিন্তা। আশঙ্কাজনক কিছু ঘটে গেলে সাগর গ্রামীণ হাসপাতাল রেফার করে দেবে কাকদ্বীপ না হলে ডায়মন্ড হারবারে। কিন্তু ভেসেল পার হওয়ার চিন্তা থাকে। মেলা উপলক্ষে অবশ্য সাগরের ভোল বদলে যায়। ড্রেজিং করে লঞ্চ পরিষেবা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় তীর্থযাত্রীদের জন্য। কিন্তু বছরের অন্য সময়ে জোয়ার-ভাটার হাতে জীবন সঁপে দিয়ে বসবাস করতে হয় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে।

শান্তশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৩৮
সাগর গ্রামীণ হাসপাতালে ওষুধের তালিকা থাকলেও তা বোঝার উপায় নেই।

সাগর গ্রামীণ হাসপাতালে ওষুধের তালিকা থাকলেও তা বোঝার উপায় নেই।

গঙ্গাসাগর মেলার কয়েকটা দিন বুকে বল-ভরসা পান সাগর ব্লকের মানুষ। প্রাণভরে বাঁচেন কয়েকটা দিন। দুশ্চিন্তামুক্ত রাত কাটে। ঘরে অসুস্থ রোগী থাকলে তাঁদের তো সারা বছর হাজারটা চিন্তা। আশঙ্কাজনক কিছু ঘটে গেলে সাগর গ্রামীণ হাসপাতাল রেফার করে দেবে কাকদ্বীপ না হলে ডায়মন্ড হারবারে। কিন্তু ভেসেল পার হওয়ার চিন্তা থাকে। মেলা উপলক্ষে অবশ্য সাগরের ভোল বদলে যায়। ড্রেজিং করে লঞ্চ পরিষেবা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় তীর্থযাত্রীদের জন্য। কিন্তু বছরের অন্য সময়ে জোয়ার-ভাটার হাতে জীবন সঁপে দিয়ে বসবাস করতে হয় প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে।

কথা হচ্ছিল সাগর গ্রামীণ হাসপাতালে আসা উত্তর সাগরের বাসিন্দা শরিফা বিবির সঙ্গে। ছোট মেয়েকে এসেছিলেন। বললেন, “বড় কিছু হলে সেই বাইরেই ছুটতে হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে আরও অসুবিধা।” জানা গেল, প্রসূতি মায়েরা মনেপ্রাণে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করেন, যাতে বাচ্চার স্বাভাবিক প্রসব হয়। অস্ত্রোপচার করানোর থাকলেই চিন্তার ব্যাপার। কারণ, পুরো সাগর দ্বীপের এই একমাত্র বড় হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞই নেই।

৬০ শয্যার হাসপাতালে অ্যানাস্থেটিস্টের পদটিও খালি। সন্তানসম্ভবাদের কাছে চিন্তার ব্যাপার তো বটেই। প্রসূতির অস্ত্রোপচার করাতে হলে নিশ্চয়যান বা অ্যাম্বু‌ল্যান্সে করে কচুবেড়িয়া ঘাট পর্যন্ত যেতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সেখান থেকে ও পারে যাওয়াটাই সমস্যার। এলাকার কয়েক জন অ্যাম্বুল্যান্স চালক জানালেন, অনেক সময়ে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে বা ঘাটে পার হওয়ার আগেই প্রসব হয়ে যায়।

ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক তথা হাসপাতালের সুপার পরিমল ডাকুয়া বলেন, “শীঘ্রই এই দুই পদে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যোগ দেওয়ার কথা। এ ব্যাপারে একটি সরকারি নির্দেশও বেরিয়েছে। বদলির একটি সমস্যা থাকায় তাঁরা এখনও যোগ দিতে পারছেন না। আশা করছি শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

হাসপাতালে সিজারের যাবতীয় যন্ত্রপাতি মজুত রয়েছে। কেবলমাত্র ডাক্তার না থাকার জন্য বড় অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাকি কয়েকটি বিভাগে ডাক্তার রয়েছেন। কিন্তু সার্বিক ভাবে পদের তুলনায় ডাক্তার কম থাকায় ইমারজেন্সি আউটডোর সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে অনেক সময়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, আউটডোরে রোজ কম করে প্রায় সাড়ে তিনশো রোগী আসেন। কিন্তু একজন ডাক্তারই দায়িত্বে থাকেন। গঙ্গাসাগর মেলার আগে-পরে ইদানীং রোজ গড়ে ১৫-২০ জন কুকুরে কামড়ানো রোগী আসছেন বলে জানা গেল হাসপাতাল সূত্রে।

সাগর ব্লকে এই গ্রামীণ হাসপাতালের অধীনে রয়েছে মাত্র তিনটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এর মধ্যে কালীবাজারে গঙ্গাসাগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো নড়বড়ে। মহেন্দ্রগঞ্জ এবং মুড়িগঙ্গা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও কোনও রকমে এক-দু’জন ডাক্তার দিয়ে চলছে।

সমস্যার কথা অস্বীকার করেননি রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা এলাকার বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা। তিনি বলেন, “পর্যাপ্ত ডাক্তার পাঠানোর জন্য মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক ছাড়াও বার বার স্বাস্থ্য দফতরে দরবার করেছি। ব্যবস্থা না হলে আবারও চেষ্টা করব। অন্তত প্রসূতির অস্ত্রোপচার যাতে চালু করা যায়, তা দেখব।”

এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, সুসংহত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রামীণ হাসপাতালকে ১০০ শয্যার স্টেট জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করা হোক। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, কর্তৃপক্ষ এ রকম প্রস্তাব দীর্ঘদিন আগে দিলেও তাতে বিশেষ আমল দেয়নি স্বাস্থ্য দফতর। উত্তর হারাধনপুর থেকে বাবাকে হাসপাতালে চিকিত্‌সার জন্য এনেছিলেন অজয় ঘোষ। তাঁর কথায়, “আমরা ধরেই নিই, আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগী নিয়ে এলে জরুরিভিত্তিতে চিকিত্‌সা এখানে হবে না। তাই আর এখানে আনার জন্য সময় নষ্ট করি না। নেহাতই ছোটখাট সমস্যা হলে এই হাসপাতালে চিকিত্‌সা করানো যায় বলে এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতা।

পরিকাঠামো ছাড়াও পরিচ্ছন্নতা নিয়েও অভিযোগ আছে। হাসপাতাল চত্বরে খুব বেশি নোংরা জঞ্জাল চোখে না পড়লেও, পুরুষদের শৌচাগারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। শিশুবিভাগ-সহ হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় পরিবার নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতে দেখা গেল নেড়ি কুকুরদের। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান এখনও চালু হয়নি। তবে ওষুধ পেতে তেমন সমস্যা হয় না বলে জানালেন সাধারণ মানুষ।

জেলা পরিষদের ‘ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স’-এর উদ্যোগও তেমন সফল হয়নি। তার পিছনে আবার রাজনৈতিক কারণ আছে বলে মনে করেন অনেকে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, রোগীকে হঠাত্‌ স্থানান্তর করতে হলে ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া যায় না। মাসে গড়ে কুড়ি দিনই তা খারাপ থাকে। রোগীর অবস্থা তুলনায় ভাল থাকলে বা জোয়ার থাকলে অনেক সময়েই চালকরা যেতে চান না বলে অভিযোগ। যন্ত্রচালিত নৌকোয় রোগী পার করার ক্ষেত্রে আবার নিরাপত্তা কারণে পুলিশ আপত্তি করে বলে জানা গেল।


শিশু বিভাগের সামনে অবাধে ঘুরছে কুকুরছানা।

দিনের বেলা কাকদ্বীপের লট ৮ ঘাট থেকে ও পারে সাগরের কচুবেড়িয়া পর্যন্ত ভেসেল চলে। তাতে কোনও রকমে ‘ম্যানেজ’ করে ফেললেও একটু রাত হলে রোগী পার করার সময়ে গায়ে জ্বর আসে অনেকের। কারণ, নদীতে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা পাওয়া না গেলে কম করে হাজার টাকা দিয়ে নৌকো ভাড়া করতে হয়। অল্প সময়ের মধ্যে আশঙ্কাজনক রোগী নিয়ে অনেক সময়ে দরাদরির সময়ও থাকে না। ফলে দরিব মানুষ সমস্যায় পড়েন।

কলকাতার এক তৃণমূল নেতা জেলা পরিষদের থেকে ওই ঘাটে ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স চালানোর বরাত পেয়েছেন। ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে সমস্যার কথা স্বীকার করতে চাননি ওই দায়িত্বে থাকা জেলার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রীতম জানা। তবে সাগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অনিতা মাইতি অবশ্য সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “ওয়াটার অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা নিয়ে অনেক অভিযোগ উঠছে। আমরা জেলা পরিষদের সঙ্গে কথা বলে নতুন টেন্ডার করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সাগরদ্বীপ নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন প্রাক্তন শিক্ষক জগন্নাথ মাইতি। তাঁর কথায়, “রাজ্য সরকারের উন্নয়ন বড়ই শহরমুখী। সুন্দরবন-সাগরের প্রান্তিক মানুষের দিকে নজরই পড়ছে না। রোগীদের অসুবিধা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা উচিত।” সাগরের সাহিত্যিক ভাগ্যধর বারিক বলেন, “স্বাস্থ্য পরিষেবা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ এই এলাকায় তেমন নেই। গ্রামীণ হাসপাতালে যাতে সিজার হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই।” সাহিত্য কর্মী আশিস দলুই বলেন, “মেলা পার হলেই আবার বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় সাগর। এর স্থায়ী সমাধান দরকার। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব বিপদে।”

নিজস্ব চিত্র।

amar shohor sagar santashri majumder sagar gramin hospital southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy