Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিস্কুট কেনা হয়নি, নিথর কিশোরের পকেটেই থেকে গেল বারোটা টাকা

ভোরবেলা তখনও বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু সকালে ওঠা অভ্যাস রাজেশ শেখের (১১)। খিদে পেয়ে যাওয়ায় পাশের চায়ের দোকান থেকে বিস্কুট কিনতে গিয়েছিল সে। দোকানের সামনে আবার হুকিংয়ের তার বিছিয়ে রেখেছিল দোকানি। অভিযোগ, তাতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় ছেলেটি। গত ১২ ডিসেম্বর ফলতার বারহৈবতপুর গ্রামের এই ঘটনায় সে সময়ে থানা-পুলিশ কিছুই হয়নি।

বাঁ দিকে, এই দোকানের সামনেই মারা গিয়েছিল রাজেশ। ডান দিকে, এখনও শোক সামলে উঠতে পারেননি মা। ইনসেটে, মৃত কিশোর।

বাঁ দিকে, এই দোকানের সামনেই মারা গিয়েছিল রাজেশ। ডান দিকে, এখনও শোক সামলে উঠতে পারেননি মা। ইনসেটে, মৃত কিশোর।

শান্তশ্রী মজুমদার
ফলতা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২৯
Share: Save:

ভোরবেলা তখনও বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু সকালে ওঠা অভ্যাস রাজেশ শেখের (১১)। খিদে পেয়ে যাওয়ায় পাশের চায়ের দোকান থেকে বিস্কুট কিনতে গিয়েছিল সে। দোকানের সামনে আবার হুকিংয়ের তার বিছিয়ে রেখেছিল দোকানি। অভিযোগ, তাতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় ছেলেটি।

গত ১২ ডিসেম্বর ফলতার বারহৈবতপুর গ্রামের এই ঘটনায় সে সময়ে থানা-পুলিশ কিছুই হয়নি। ইতিমধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছিল রাজেশের দেহ। কিন্তু বুধবার ওই কিশোরের বাবা রাজু শেখ থানায় ঘটনার কথা লিখিত ভাবে জানান। শুক্রবার ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দেহ কবর থেকে তুলে ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত দোকান মালিক কালো খাঁ ও তার ছেলেরা পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের খোঁজ চলছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, টিউশন পড়তে যাওয়ার জন্য প্রায়ই ভোরবেলা উঠত বেলসিংহা শিক্ষায়তনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রাজেশ। ঘটনার দিনও উঠেছিল। কালো খাঁয়ের বাড়ি-লাগোয়া তার নিজেরই চায়ের দোকান। সে দিন তখনও দোকান খোলেনি। হাঁকডাক করতে গিয়ে হঠাৎই দোকানের সামনে বিছিয়ে রাখা হুকিংয়ের খোলা তারে জড়িয়ে পড়ে রাজেশ। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছেন, দোকান থেকে মাঝে মধ্যে খাবার চুরি যাচ্ছিল। চোরেদের আটকাতেই কালো এমন মরণ ফাঁদ পেতে রেখেছিল। ঘটনার পর দিন থেকে কালো আর তার দুই ছেলে গা ঢাকা দিয়েছে।

ফলতা-কলকাতা রুটের বাস কন্ডাক্টর রাজু। তিনি বলেন, “ভোরবেলা আমার ডিউটিতে যাওয়ার কথা। তৈরি হচ্ছিলাম। হঠাৎ কালো খবর দিল, আমার ছেলে তার দোকানের পাশে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ওদের হুকিংয়ের তারে জড়িয়েই মারা গিয়েছে সে।”

কিন্তু এত দিন পরে ঘটনা পুলিশকে জানালেন কেন?

রাজুর দাবি, ছেলের মৃত্যু নিয়ে থানা-পুলিশ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর আরও অভিযোগ, বিষয়টি ‘মিটিয়ে নেওয়ার জন্য’ কালো ও তার ছেলে রাকেশ রাজুর পরিবারকে ৫ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল। তৃণমূলের বেলসিংহা ২ পঞ্চায়েত প্রধান জাহাঙ্গির খাঁ-ও বলেছিলেন টাকা নিয়ে বিষয়টি মিটমাট করে নিতে। রাজু বলেন, “তখন ভয়ও পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই পুলিশের কাছে যাইনি। কিন্তু এ বার সাহস করে অভিযোগ জানিয়েছি।”

তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে জাহাঙ্গির বলেন, “মুসলিম পরিবারের অনেকেই ময়না-তদন্ত করাতে চান না। সে কারণেই পুলিশে খবর না দিয়ে দেহ কবর দেওয়া হয়েছিল। নিজের জমিতে ওই বালকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল বলেই কালো ওই পরিবারকে টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কোনও মতামত ছিল না।” হুকিংয়ের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলেও দাবি জাহাঙ্গিরের। যদিও গ্রামের অনেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ নিয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।

এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মাটি খুঁড়ে দেহ বার করতে ব্যস্ত প্রশাসন। সেখানে গ্রামবাসীদের উপচে পড়া ভিড়। কালো খাঁর স্ত্রী লায়লা বিবি বলেন, “শত্রুতার জন্য এ সব বলা হচ্ছে। আমরা হুকিং করি না। আমরা যদি রাজুর ছেলেকে মেরে ফেলতাম, তা হলে দেহ আমাদের দোকানের পাশেই রেখে দেব কেন?”

রাজেশের মা রেহানা বিবি চুপ করে বসেছিলেন বাড়ির দাওয়ায়। বললেন, “বিস্কুট খেতে বড় ভালবাসত ছেলেটা। সে দিন ১২ টাকা নিয়ে বিস্কুট কিনতে গিয়েছিল। বাড়িতে যখন দেহ এল, তখনও দেখি পকেটে বিস্কুট কেনার টাকাটা রয়ে গিয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

santasree majumder rajesh sekh phalta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE