সভামঞ্চ তৈরির কাজ তদারকিতে সরকারি কর্তারা।
সরকারি কাজে সোমবার বনগাঁয় আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি সফর হলেও, তা নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয়েছে নানা কারণে। কয়েক মাসের মধ্যেই বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। সে দিকে তাকিয়ে মমতার সফরে রাজনৈতিক বক্তব্য কিছু উঠে আসে কিনা, তা জানার আগ্রহ আছে শাসক-বিরোধী সকলেরই। এলাকায় রীতিমতো দেওয়াল লিখে মমতার সরকারি সফরকে ‘সভা’ বলেই উল্লেখ করে সেখানে ‘দলে দলে যোগ’ দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। মিটিং-মিছিল, পথসভা হচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক মহল সরগরম।
গত কয়েক মাসে রাজ্যের সাম্প্রতিক বহু ঘটনায় শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে গোটা রাজ্য জুড়ে। সারদা কাণ্ডে তৃণমূলের যোগসূত্র আছে, এই অভিযোগে বিরোধী দলগুলি সমালোচনায় মুখর। বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের সঙ্গে তৃণমূলের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের একটি অংশের যোগ আছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে বার বার। রাজ্যে নানা ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, পুলিশ পেটানোর ঘটনায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগও উঠছে। এই আবহে কয়েক মাসের মধ্যে লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘিরে তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বনগাঁর সাংসদ তথা সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে ঠাকুর পরিবারের বিভাজন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কপালে বাড়তি ভাঁজ ফেলেছে বলে মনে করেন দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্বের একটি অংশও। এ সবের মধ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তও ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে।
এই পরিস্থিতিতেই বনগাঁয় সরকারি কর্মসূচিতে আসছেন মমতা। অনুষ্ঠান হবে বনগাঁ স্টেডিয়ামে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, ইতিমধ্যেই মঞ্চ বাঁধার কাজ শুরু হয়েছে। স্টেডিয়ামের পাশে মাঠে হেলিপ্যাড তৈরি হচ্ছে। সভাস্থল ঘুরে গিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী, জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল। দফায় দফায় নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও তৃণমূল সূত্রের খবর মুখ্যমন্ত্রী ওই দিন বনগাঁ মহকুমায় কিষাণ মাণ্ডি, খাদ্যভবন-সহ বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করবেন। বিলি করবেন কয়েক হাজার সাইকেল। বিলি করা হবে ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার। মত্স্যজীবীদের মাছ ধরার সরঞ্জাম বিলিও করবেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের চেকও বিলি করার কথা তাঁর।
ইতিমধ্যেই সভার জন্য তৃণমূলের পক্ষ থেকে পথসভা, দেওয়াল লিখন, মিছিল শুরু হয়েছে। ১৫ নভেম্বর বনগাঁ শহরে এসে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় ও জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে গিয়েছেন। দলীয় সূত্রের খবর, ওই সভায় জন-প্রতিনিধিদের বিজেপির ‘বাড়বাড়ন্ত’ সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। সভায় উপস্থিত এক জনপ্রতিনিধির কথায়, “বৈঠকে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, বিজেপিকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না। বিজেপি যেখানে পথসভা-জনসভা-মিছিল করবে, সেখানেই তৃণমূল পাল্টা কর্মসূচি নেবে।”
জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “বিজেপির জন্য আমরা ছোট দাওয়াই প্রস্তুত করেছি। যে দাওয়াই প্রয়োগ করলে রক্ত ঝরবে না, আগুন জ্বলবে না, অথচ রাজনৈতিক ভাবে তা খুবই কার্যকরী হবে।” তাঁর মতে, জেলায় এখনও সিপিএম তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তবে সিপিএম তাদের দল ধরে রাখতে পারছে না। বাম কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপিতে ভিড় করছে। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশকে যা ভাবাচ্ছে বলেই দলীয় সূত্রের খবর।
প্রকাশ্যে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য আসন্ন লোকসভা উপনির্বাচনে বিজেপিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা বললেও ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উড়িয়েও দিতে পারছেন না। দলের নেতা-কর্মীদের সেই মতো বার্তাও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি মধ্যমগ্রামে দলের জেলা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সভাতেও জেলা নেতৃত্ব ওই বার্তা দিয়েছেন। জেলা নেতারা অনেকেই মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সভাকে ঘিরে কর্মীদের মধ্যে উত্সাহ ফিরে এসেছে, যা ভোটের কাজে দলকে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করবে। স্থানীয় স্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটাতেও যা কাজে আসতে পারে বলে তাঁদের আশা। দলের নিচুতলার একটি অংশ আবার জেলা নেতৃত্বের উপরেও নানা কারণে বিরক্ত। সে সব নিয়ে দলের শীর্ষস্তরে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না বলে অভিযোগ বিস্তর। আসন্ন উপনির্বাচনকে ঘিরে সেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামাল দেওয়ারও দায় আছে জেলা নেতৃত্বের। দলনেত্রীর সরকারি কর্মসূচি থেকে সাংগঠনিক স্তরে দল কোনও ভাবে উপকৃত হয় কিনা, সে দিকেও তাকিয়ে তাঁরা।
গত লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ কেন্দ্র থেকে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬০১ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন ৫,৫১,২১৩টি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন সিপিএমের দেবেশ দাস। তিনি পেয়েছিলেন ৪,০৪,৬১২টি ভোট। গত লোকসভা ভোটে বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস পেয়েছিলেন ২,৪৪,৭৮৩টি ভোট। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৪২,৬১০টি ভোট। শতাংশের হিসাবে এ বার বিজেপি পেয়েছে ১৯.০৭ শতাংশ ভোট। ২০০৯ সালের তুলনায় যা প্রায় ১৫.১২ শতাংশ বেশি।
বনগাঁ কেন্দ্রে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বড় নির্ণায়ক। তৃণমূল গত বার প্রার্থী করেছিল মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির বড় ছেলে তথা সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণকে। পাল্টা হিসাবে বিজেপি প্রার্থী করে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের তত্কালীন সম্পাদক কেডি বিশ্বাসকে। সম্প্রতি মতুয়া পরিবারের মধ্যেও ভাঙন স্পষ্ট হয়েছে। মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকবে, নাকি সেখানেও চিড় ধরবে, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।
লোকসভা ভোটের পর থেকে বনগাঁ-সহ গোটা জেলাতেই বিজেপির প্রভাব বাড়ছে বলে মনে করেন সব পক্ষই। নানা বিষয়ে ইদানীং বিজেপি জেলা জুড়ে যে ভাবে আন্দোলনে নেমেছে, অতীতে তা কখনও দেখা যায়নি। বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য জয়ীও হয়েছেন। জেলা বিজেপি সভাপতি কামদেব দত্তের দাবি, “লোকসভা ভোটের পরে বনগাঁ ও বারাসত মহকুমায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তারমধ্যে ২০ হাজার মানুষকে লিখিত ভাবে সদস্য করা হয়েছে। যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরেই বেশি। ফরওয়ার্ড ব্লক ও তৃণমূলের লোকজনও আছেন।” কামদেববাবু বলেন, “বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে কর্মীরা একটু চেষ্টা করলেই আমরা জয়লাভ করব। লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে এখানে সভা করানোর জন্য রাজ্য নেতৃত্বের কাছে আবেদন করা হয়েছে।”
সিপিএম গত লোকসভা ভোটে এখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে তারা ১০.৫৬ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। ওই ভোট ফিরিয়ে আনা সিপিএম নেতৃত্বের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ, সে কথা মানছেন দলের নেতারাও।
গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে জয়ী হলেও তারা পেয়েছে ৪২.৯৮ শতাংশ ভোট, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ৭.৭৫ শতাংশ কম। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থীরা বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই জয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু লোকসভা ভোটে তারা স্বরূপনগর কেন্দ্রে পিছিয়ে।
যদিও লোকসভার উপনির্বাচনে তাঁরা পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী বলেই দাবি করেছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। তিনি বলেন, “যে যা-ই ভাবুক, বিরোধীরা সকলে একত্রিত হলেও লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে কেউ হারাতে পারবে না। অনেক দলের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।”
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy