Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যানজটে নাজেহাল হাবরা, বেহাল নিকাশিও

যে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা পরিকাঠামো নিয়ে হাবরাবাসীর গর্বের অন্ত নেই, সেই শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছতে প্রাণান্ত হতে হয় শহরবাসীকে। শহরের বাইরে থেকেও বহু শিক্ষার্থী আসেন হাবরার বাণীপুরে। কিন্তু যশোহর রোডের যানজট ঠেলে সেখান পর্যন্ত পৌঁছতে হিমসিম খেতে হয়। হাবরার যানজটের ‘নামডাক’ আছে গোটা জেলা জুড়ে। এ ছাড়াও আছে নিকাশির সমস্যা। পদ্মা নদী উবে যাওয়ার পর থেকে শহরের মূল নিকাশি ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে।

সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০১:০৩
Share: Save:

যে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা পরিকাঠামো নিয়ে হাবরাবাসীর গর্বের অন্ত নেই, সেই শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছতে প্রাণান্ত হতে হয় শহরবাসীকে। শহরের বাইরে থেকেও বহু শিক্ষার্থী আসেন হাবরার বাণীপুরে। কিন্তু যশোহর রোডের যানজট ঠেলে সেখান পর্যন্ত পৌঁছতে হিমসিম খেতে হয়। হাবরার যানজটের ‘নামডাক’ আছে গোটা জেলা জুড়ে। এ ছাড়াও আছে নিকাশির সমস্যা। পদ্মা নদী উবে যাওয়ার পর থেকে শহরের মূল নিকাশি ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। অল্প বৃষ্টিতেও জল জমার হাত থেকে রেহাই মেলে না শহর হাবরার মানুষকে।

হাবরা শহরের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক। অতীতে যশোহর রোডের যানজট সমস্যা সমাধানের দাবিতে হাবরার মানুষ বহু বিক্ষোভ-আন্দোলন করেছেন। বিনিময়ে মিলেছে শুধু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। ইদানীং সবই যেন গা-সওয়া করে নিয়েছেন নাগরিকেরা। যানজটে পড়ে নাভিঃশ্বাস উঠলেও বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না কেউ। বহু কাল কাল ধরেই শহরের বাসিন্দারা শুনে আসছেন, যানজট সমস্যা মেটাতে যশোহর রোডে তৈরি হবে উড়ালপুল। নিয়ম করে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে কোনও নির্বাচনের আগে শহরবাসীকে সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ভোট মিটলে অবস্থা যে কে সেই।

শহরের বুক চিরে চলে যাওয়া যশোহর রোড পৌঁছে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা পেট্রাপোলে। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলপথে বাণিজ্যের জন্য পণ্য-বোঝাই ট্রাক এই শহরের উপর দিয়েই যাতায়াত করে। ঢাকা-কলকাতা বাসও চলে। বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ চালু হওয়ার পড়ে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল প্রশাসন। মনে করা হয়েছিল, এ বার হয় তো সমাধান সূত্র মিলবে। কিন্তু কোথায় কী!

হাবরা শহরের ২ নম্বর রেলগেট থেকে চোংদা মোড় পর্যন্ত যশোহর রোডের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। কিন্তু সামান্য এই পথটুকু পেরোতেই দিনের কোনও কোনও সময়ে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরে যানজটের অন্যতম কারণ অপরিসর রাস্তা। আর রাস্তার দু’ধারের দোকানপাট। রাস্তার উপরে যাত্রী তোলার জন্য দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বাস-ট্রেকার-অটো। যত্রতত্র দাঁড়িয়ে থাকে শ’য়ে শ’য়ে ভ্যানরিকশা। বাসিন্দারা জানালেন, লাইসেন্সহীন ভ্যানের দাপট এখনও কমেনি। সড়কের পাশে মোটরবাইক, সাইকেল দাঁড় করিয়ে মানুষ দোকান-বাজারে ঢোকেন। জ্যাম বাড়ে তার জেরেও।

ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে পুরসভার তরফে অভিযান চলে মাঝে মধ্যে। কয়েক দিনের মধ্যে ফের ফুটপাথ দখল হয়ে যায় বলে অভিযোগ। বনগাঁ, বাগদা, গাইঘাটা, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, গোবরডাঙার মানুষকে সড়ক পথে কলকাতায় যেতে হলে হাবরা হয়েই যেতে হয়। রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল, গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতাল বা হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে কলকাতায় যেতে হলে যানজটে আটকে পড়তে হয়। তাতে রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে, অতীতে এমন ঘটনা বহু দেখা গিয়েছে। হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে প্রসূতিকে নিয়ে আসার পথে যানজটে আটকে অটোর মধ্যে প্রসব হয়েছে, এমন ঘটনারও সাক্ষী হাবরা। আবার অনেক ক্ষণ যানজটে দাঁড়িয়ে থাকার পরে জট ছাড়লে হঠাৎ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন চালকেরা। এর জেরে দুর্ঘটনা ঘটে।

তবে পুলিশ-প্রশাসন, ব্যবসায়ী সংগঠন-সহ সব পক্ষের আলোচনায় সড়কের দু’ধার কমবেশি হকারমুক্ত করা হয়েছে। হকারদের পুনবার্সন দেওয়ার জন্য ১ নম্বর রেলগেটের কাছে তৈরি হয়েছে হকার্স মার্কেট। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তৃণমূলের নীলিমেশ দাস বলেন “শহরকে যানজট মুক্ত করতে তৈরি হওয়া হকার্স মার্কেটে ৮৮ জনকে ইতিমধ্যেই পুনবার্সন দেওয়া হয়েছে। জয়গাছিতে আরও একটি মার্কেট তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।” দুর্ঘটনা রুখতে সড়কে বসানো হয়েছে গার্ডরেল। পুরসভার তরফে মাঝেমধ্যে বেআইনি গাড়ি ও ভ্যানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় বলেও পুরসভা সূত্রের খবর।

যানজট সমস্যা মেটাতে ১৯৯২ সালে অশোকনগরের শেরপুর কালীবাড়ি মোড় থেকে হাবরার বেলঘরিয়া মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা হয়। কয়েকবার শিলান্যাস ও উদ্বোধনও হয়েছে। কাজও শেষ। কিন্তু যানবাহন ওই বাইপাস দিয়ে যাতায়াত করে না। ফলে বাইপাস কোনও কাজেই আসেনি।

২০০৮ সালে বাম আমলে তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী এক অনুষ্ঠানে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ওই বছরের মার্চ মাসেই শুরু হবে হাবরা শহরে উড়ালপুল তৈরির কাজ। দু’কিলোমিটার লম্বা প্রস্তাবিত ওই উড়ালপুলের জন্য ১৩০ কোটি টাকা করচ হবে বলেও মন্ত্রী জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন সে সময়ে। দমদমের প্রাক্তন সাংসদ, সদ্য প্রয়াত সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দীও একাধিকবার এখানে উড়ালপুল তৈরি হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

গত বিধানসভা ভোটে হাবরা থেকে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনিও নির্বাচনের আগে উড়ালপুল তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভোটের পরে তিনি সে বিষয়ে উদ্যোগীও হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও উড়ালপুল তৈরির কাজ থমকে রয়েছে। মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শহরের মধ্যে ১ ও ২ নম্বর রেলগেটে যশোহর রোডে দু’টি উড়ালপুল তৈরি হবে। যার একটি দৈর্ঘ্যে ১১০ মিটার। অন্যটি ১২৫ মিটারের। জ্যোতিপ্রিয়বাবু মঙ্গলবার বলেন, “ওই দু’টি উড়ালপুল তৈরির জন্য রাজ্য সরকার ৩২ কোটি ও রেল ৩২ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। রেল ও জাতীয় সড়ক কতৃর্পক্ষ একবার করে মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ করেছে। সমীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে।” তা হলে আটকাচ্ছে কীসে? মন্ত্রী জানিয়েছেন, রেল নতুন নিয়ম করেছে, যে রাজ্যে কাজ হবে সেই কাজ করবে ওই রাজ্যের পূর্ত দফতর। তাঁর আশ্বাস, “রেল আমাদের হাতে প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। রেল দিতে দেরি করছে।” এ দিনও রেলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

হাবরা শহরের আরও একটি প্রধান সমস্যা নিকাশি। বেশি বৃষ্টি হলেই পুর এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে জল দাঁড়িয়ে যায়। এমনকী, দমকল বিভাগের অফিস চত্বরও জলে থইথই করে। এলাকার মানুষের দাবি, ১৯৭৯ সালে পুরসভা তৈরি হওয়ার পর থেকে কখনও সিপিএম, কখনও বিরোধীরা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু কোনও দলই সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়নি। জলাভূমি ভরাট করে বেআইনি নির্মাণও চলছে অবাধে। শহরে একটি বিল ছিল, তার অবস্থাও পদ্মানদীর মতো শোচনীয়। এক প্রবীণ নাগরিক জানালেন, হাবরা শহরের আকৃতি কড়াইয়ের মতো। তাই অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। জল বের করতে নদী খাল সংস্কার করতে হবে। নিকাশির জন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে হবে। এলাকার মানুষ জানালেন, শহরের অন্যতম সড়ক হাবরা-নগরউখরায় বৃষ্টি হলেই এক হাঁটু জল দাঁড়িয়ে যায়। অপরিকল্পিত ভাবে নিকাশি নালা তৈরির ফলে তা দিয়ে জল সরে না। উল্টে, নালাগুলিতে মশার বংশবৃদ্ধি হয় তরতরিয়ে।

মাস্টার প্ল্যান তৈরি না করলে নিকাশির স্থায়ী সমাধান হবে না বলেই মনে করেন পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের ঋজিনন্দন বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “পুরসভা এখন নিকাশি সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করছে। মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে পাঠানো হয়েছে আমাদের সহমতের ভিত্তিতেই।” নীলিমেশবাবু জানিয়েছেন, নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজতে ৮৯ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে পুর দফতরে পাঠান হয়েছে। অনুমোদনও হয়েছে। এখন প্রস্তাব কেন্দ্রের অনুমোদনের জন্য পাঠাবে রাজ্য। ১২৫ কোটির টাকার ওই প্রকল্প তৈরি হলে নিকাশি সমস্যা মিটে যাবে বলে তাঁর আশা।

সমস্যা আছে আরও। এলাকায় খেলাধূলার ভাল চর্চা থাকলেও স্টেডিয়াম হয়নি। হাবরা স্টেশন-সংলগ্ন খেলার মাঠে স্টেডিয়াম তৈরির একটি উদ্যোগ করা হয়েছিল ২০০২ সালে। শিলান্যাসও হয়। কিন্তু কাজ এগোয়নি। এখনও সব বাড়িতে পানীয় জলের লাইন পৌঁছয়নি। অনেক বাড়িতে এখনও সাধারণ টিউবয়েলের জল পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পুর এলাকার কিছু রাস্তা ভাঙাচোরা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে হাবরাবাসীর ক্ষোভ সেই যানজট ও নিকাশি নিয়েই।

(চলবে)
ছবি তুলেছেন শান্তনু হালদার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal simanta maitra habra amar sohor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE