Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিলিগুড়িতে উদ্ধার প্রচুর বিস্ফোরক, ধৃত নেপালি দম্পতি সহ ৩

মাঝে মধ্যেই সাংসারিক নানা কথা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। হোটেলে দু’জনে মিলে ভাত, ডাল, রুটির সঙ্গে মোমো বিক্রি করতেন। তিন মাস আগে শিলিগুড়ির ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় ভাড়া নিয়ে আসা দম্পতিকে নিয়ে তাই এলাকার কারও কোনও রকম সন্দেহ হয়নি।

(বাঁ দিক থেকে) কৃষ্ণপ্রসাদ অধিকারী, পূজা লিম্বু এবং দাওয়া ছেরিং ভোটে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

(বাঁ দিক থেকে) কৃষ্ণপ্রসাদ অধিকারী, পূজা লিম্বু এবং দাওয়া ছেরিং ভোটে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১১
Share: Save:

মাঝে মধ্যেই সাংসারিক নানা কথা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। হোটেলে দু’জনে মিলে ভাত, ডাল, রুটির সঙ্গে মোমো বিক্রি করতেন। তিন মাস আগে শিলিগুড়ির ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় ভাড়া নিয়ে আসা দম্পতিকে নিয়ে তাই এলাকার কারও কোনও রকম সন্দেহ হয়নি। যেমন সন্দেহ হয়নি তাঁদের পড়শিকে নিয়েও। তিনি নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করতেন।

শনিবার রাতে প্রধাননগর থানার দার্জিলিং মোড়ের মাল্লাগুড়ির অসম রেলগেটের পাশে সেই দম্পতির ঘর থেকেই উদ্ধার হল ৬০৯টি জিলেটিন স্টিক, ২০০টি ডিটোনেটর এবং ৬৩০ মিটার কর্ডেক্স তার, যা বিস্ফোরণের কাজে ব্যবহার করা হয়। পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, এই বিস্ফোরক যদি কোনও কারণে ফেটে যেত, তা হলে গোটা এলাকার বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। পিছনেই রয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল। অন্তত পাঁচটি বহুতল ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ওই বিস্ফোরকের রয়েছে। কাছেই রয়েছে দার্জিলিং মোড়ের উড়ালপুল। সেটিও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত।

দাওয়া ছেরিং ভোটে এবং পূজা লিম্বু নামে মধ্যবয়সী ওই দম্পতির বাড়িটি ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক লাগোয়া। উপরতলায় থাকতেন বাড়িওয়ালা বিজয় সুব্বা। রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে দাওয়া-পূজার ঘর। রাস্তা থেকে ঘরটি খুব কাছে না গেলে দেখাই সম্ভব নয়। দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে ঘরের সামনেটা। এমন অনেক ঘরই ওই এলাকায় রয়েছে।

গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, বিস্ফোরক কেনার নাম করেই সাদা পোশাকের পুলিশ শনিবার রাতে দাওয়া-পূজার ঘরে যায়। তাঁদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার করে কৃষ্ণপ্রসাদ অধিকারী বলে তাঁদের এক পড়শিকেও। তিন জনেই নেপালের বাসিন্দা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, দাওয়া সম্প্রতি যেখানেই যেতেন, কৃষ্ণপ্রসাদ তাঁর সঙ্গে থাকতেন।

ধৃতদের সঙ্গে নেপাল বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। মোবাইল ও অন্য সূত্র খতিয়ে দেখে ধৃতদের সঙ্গে ওই দুই এলাকার যোগাযোগ মেলায় পুলিশের ওই সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে। রবিবার ধৃতদের শিলিগুড়ি আদালতে পেশ করে সাত দিনের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি, সেনা, এসএসবি, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অফিসারেরা ধৃতদের জেরা শুরু করেছে।

দু’বছর আগে বর্ধমান শহরেও ঘনবসতিপূর্ণ খাগড়াগড় এলাকাতে ২ অক্টোবর বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে। দু’জন মারা যান। পরে ওই এলাকা থেকেই আইইডি বানানোর প্রচুর রসদ পাওয়া গিয়েছিল। শিলিগুড়ির এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে লুকিয়ে থাকা সহজ। সেটাই ঘটেছে এক্ষেত্রেও।’’ ওই দম্পতির সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই ছোট ছেলে। তাদের পড়াশোনা নিয়ে ওই দম্পতির উদ্বেগ ছিল। এলাকার মানুষ যে কারণে ভাবতেই পারেননি, তাঁদের ঘরে এমন বিস্ফোরক থাকতে পারে।

তাই পুলিশি নজরদারি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কী করে এত বিস্ফোরক নিজের বাড়িতে জমা করতে পারলেন ওই দম্পতি, তা নিয়েও। দাওয়া ও পূজার বাড়ি নেপালের খান্দাবাড়ি জেলার ফাঙথাং এলাকায়। কৃষ্ণপ্রসাদের বাড়ি নেপালের মেচির নানগিং ফাঁড়ি এলাকায়। দাওয়া মেঘালয়ের শিলং লাগোয়া একটি কয়লা খনিতে কাজ করতেন। পুলিশের ধারণা, লোকের চোখে ধুলো দিতেই ওই দম্পতি কিছু দিন আগে দার্জিলিং মোড়ে হোটেলও খোলেন। কৃষ্ণ মাটিগাড়ার একটি সংস্থায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন।

প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, মেঘালয়ের খনি থেকেই বিস্ফোরকগুলো নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এতটা রাস্তা তিনি কী করে সব নজরদারি এড়িয়ে আসতে পারলেন, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন প্রশাসনের কর্তারাও। শিলিগুড়ি অস্ত্র কারবারিদের করিডর হয়ে উঠছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ওই দম্পতির বাড়িওয়ালা বিজয়বাবুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, মাল্লাগুড়ি এলাকাতে ঘরভাড়া দেওয়ার সময় প্রমাণপত্র চাওয়ার তেমন রেওয়াজ নেই।

ওই দম্পতির ঘর থেকে তিনটি বড় ব্যাগ মিলেছে। তাতেই বিস্ফোরকগুলি রাখা ছিল। কারও যাতে সন্দেহ না হয় তাই, বিস্ফোরকগুলো ধীরে ধীরে এনে জমা করা হয়েছিল বলেও মনে করা হচ্ছে। পুলিশের দাবি, ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছে, বিস্ফোরকগুলোর জন্য ভাল খদ্দেরের অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। সেই কথা পুলিশের কানেও যায়। তারপরেই একটি ফাঁদ পাতা হয়। ৫৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কিছু জিলেটিন স্টিক এবং ডিটোনেটর কেনার ছক সাজিয়েই পুলিশ অভিযান চালায়।

এ দিন সকালে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা এবং ডিসি (সদর) ইন্দ্র চক্রবর্তী প্রধাননগর থানায় গিয়ে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘গোপন সূত্রের ভিত্তিতে পুলিশের বিশেষ টিম এই উদ্ধার কাজ চালিয়েছে। যে পরিমাণ বিস্ফোরক সামগ্রী মিলেছে, তাতে বিরাট নাশকতা করা সম্ভব। এই দলটিতে আর কারা রয়েছে, কোথাও ঠিক এগুলি পাঠানো হচ্ছিল, তাই জানার চেষ্টা শুরু হয়েছে।’’

সম্প্রতি উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে অস্ত্র আমদানি করার মামলায় পাহাড়ের এক নেতার ভাই বিজয় থুলুঙ্গকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই চক্রের সঙ্গে ধৃতদের যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা-ও পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

explosive
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE